ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

অনাস্থা দিতে বাধ্য হব ॥ সিনহার প্রতি এ্যাটর্নি জেনারেল

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ১০ মে ২০১৭

অনাস্থা দিতে বাধ্য হব ॥ সিনহার প্রতি এ্যাটর্নি জেনারেল

স্টাফ রিপোর্টার ॥ সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী হাইকোর্টে বাতিল সংক্রান্ত আপীল আবেদনের শুনানিতে সময় চাওয়া নিয়ে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা ও এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের মধ্যে বাগ্বিত-ার সৃষ্টি হয়েছে। সাংবিধানিক এই আপীল শুনানিতে আপীল বিভাগের সব বিচারপতি যোগ না দিলে এ মামলা থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেয়ার কথাও জানান এ্যাটর্নি জেনারেল। পরে এই আপীল আবেদনের দ্বিতীয় দিনের মতো শুনানি শেষে আগামী ২১ মে পর্যন্ত মুলতবি শুনানি মুলতবি করেন সুপ্রীমকোর্ট। মঙ্গলবার শুনানির শুরুতে এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম আপীল বিভাগে দুটি আবেদন উপস্থাপন করেন। এর মধ্যে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী হাইকোর্টে বাতিলের রায়ে বলা হয়েছিল সংসদ সদস্যদের মধ্যে একটা বিরাট অংশের বিরুদ্ধে ক্রিমিনাল রেকর্ড রয়েছে, সেই এমপিদের তালিকা চেয়ে একটি আবেদন। অন্যটি আপীল বিভাগের সাত বিচারপতি উপস্থিত না হওয়া পর্যন্ত শুনানি মুলতবির আবেদন। মঙ্গলবার শুনানির প্রথম দিকে এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম আপীল বিভাগের সাত বিচারপতির উপস্থিতিতে শুনানির প্রসঙ্গ টানলে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘বিচারকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তের বিষয়টি জাতীয় সংসদের হাতে নাকি সুপ্রীম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের হাতে থাকা উচিত, তা নির্ধারণ হওয়া দরকার।’ তখন এ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘আপনি তো আগামী জানুয়ারি পর্যন্ত আছেন।’ প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘এ মামলার সঙ্গে বিচারকদের শৃঙ্খলার বিষয়টি জড়িত। এক্ষেত্রে কোন শূন্যতা থাকতে পারে না।’ এ্যাটর্নি জেনারেল আদালতে বলেন, ‘আপীল বিভাগে এখন বিচারপতির সংখ্যা সাতজন। কিন্তু শুনছেন পাঁচজন। এভাবে বিচার চললে আমি অনাস্থা দিতে বাধ্য হব। আপনারা বলেছেন যে সবাই শুনবেন। আজ তা শুনছেন না। সাতজনকে শুনতে বলায় ভুল কোথায়?’ তখন প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আপনি আদালতকে আন্ডার মাইন (খাটো করে) দেখছেন।’ এ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘তা করছি না। আমাদের আবেদন, হাইকোর্টের রায়ে সংসদ সদস্যদের বিরুদ্ধে কিছু মন্তব্য করা হয়েছে।’ হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়েছিল, ‘সংসদের মাধ্যমে বিচারকগণের অপসারণ প্রক্রিয়া ইতিহাসের একটি দুর্ঘটনা।’ এ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘বিতর্কিত কিছু থাকলে সেটা আমরা দেখব।’ বিচারপতি আবদুল ওয়াহহাব মিয়া বলেন, ‘এখনও তো মামলা শুনলামই না।’ প্রধান বিচারপতি এই পর্যায়ে শুনানি শুরু করার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘আপনি শুনানি বিলম্ব করছেন।’ এ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘আমাদের আরেকটি আবেদন আছে। পৃথিবীর কোন দেশেই বিচার বিভাগ (হাইকোর্টের রায় প্রসঙ্গে) এভাবে কথা বলতে পারে না। আমি অসহায়। এভাবে শুনানি অব্যাহত রাখলে ন্যায়বিচার হবে না। শুনানিতে অংশ নিতে আমাকে বাধ্য করবেন না।’ তখন প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আপনি আদালতকে এমন পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছেন যে আপনি নিজেই বিপদে পড়বেন।’ মাহবুবে আলম এর প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘আপনি কি আমাকে ভয় দেখাচ্ছেন? তিনি বলেন, ‘গতকাল (সোমবার) বলেছেন যে সবাই শুনবেন। কিন্তু তা তো দেখছি না। আমরা তো আদালতকে সহযোগিতা করতে চাই।’ প্রধান বিচারপতি তখন শুনানি শুরু করে হাইকোর্টের রায় উপস্থাপন করতে বললে এ্যাটর্নি জেনারেল আবার বলেন, ‘আপনি বলেছিলেন যে সাতজনই শুনবেন। কিন্তু এখন তা শুনছেন না। আমি তো বলেছি মে মাসেই শুনানি শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু এভাবে হলে তো আমি এ মামলা থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করতে বাধ্য হব।’ প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আপনি পীড়াপীড়ি করছেন কেন?’ এরপরও প্রধান বিচারপতি রায় উপস্থাপন করতে বললে এ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘রায় উপস্থাপন করব। তবে আমাকে সময় দিতে হবে।’ প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আমরা আগে বলেছিলাম লিখিত যুক্তিতর্ক প্রস্তুত করে তা দাখিল করতে। আপনার দফতরে ১৫৫ জন আইন কর্মকর্তা আছেন। তাই এটা প্রস্তুত করতে এত সময় লাগবে কেন?’ জবাবে এ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘দুই সপ্তাহ সময় চেয়েছি। এই সময় দিলে আকাশ ভেঙ্গে পড়বে না। আশা করছি, এ সময়ের মধ্যে উনারা (আপীল বিভাগের বাকি দুই বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা ও বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন) ফিরে আসবেন।’ প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আপনি হাইকোর্টে শুনানি করেছেন। আপনার সব মনে থাকার কথা।’ এ সময় বিচারপতি আবদুল ওয়াহহাব মিঞা বলেন, ‘আপনি আদালতের প্রধান আইন কর্মকর্তা। তাই মামলা থেকে প্রত্যাহার করে নেয়ার কথা বলা ঠিক হয়নি।’ এ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘আমি নিরুপায় হয়ে বলেছি। আপনারা যখন পাঁচজন শুনবেন বলেছেন তখন এটা বলেছি।’ এরপর অতিরিক্ত এ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা পেপারবুক থেকে পড়া শুরু করেন। রিটকারী আইনজীবী এ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদের বক্তব্যেও শুনানি চলাকালে সৃষ্টি হওয়া বাগ্বিত-ার চিত্র পাওয়া গেছে। মনজিল মোরসেদ বলেন, এক পর্যায়ে শুনানির জন্য প্রধান বিচারপতি এ্যাটর্নি জেনারেলকে বার বার জোর দিচ্ছিলেন। এ পর্যায়ে এ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, যদি আমাদের সময় না দেয়া হয়, তাহলেতো আপনাদের প্রতি আমাদের আস্থা থাকছে না। মনজিল বলেন, এ্যাটর্নি জেনারেল এক পর্যায়ে মামলা থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেয়ার কথাও আদালতকে জানান। তিনি বলেন, এ পর্যায়ে প্রধান বিচারপতি বলেন, আপনি রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা, আপনি এ ধরনের কথা বলতে পারেন না। জবাবে এ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আপনি কি আমাকে হুমকি দিচ্ছেন? তখন আদালত বলে, না আমরা হুমকি দিচ্ছি না। তবে আপনি যে বক্তব্য দিচ্ছেন তা কি আপনি বুঝে দিচ্ছেন? আমরা এখানে বসেছি এই মামলা চূড়ান্ত শুনানি করার জন্য। এ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তব্য ॥ শুনানি শেষে এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেন, আমরা দুটি দরখাস্ত দাখিল করেছি আদালতে। একটি দরখাস্ত দাখিল করেছি হাইকোর্ট বিভাগ তার রায়ে একটি জায়গায় বলেছে, সংসদ সদস্যদের মধ্যে একটা বিরাট অংশের বিরুদ্ধে ক্রিমিনাল রেকর্ড আছে। আমি দরখাস্ত করে সেই তালিকাই চেয়েছি। আদালত বলেছে, এগুলো আমরা শুনানির সময় বা রায়ের সময় দেখব। আরেকটি দরখাস্ত করেছিলাম দুইজন বিচারপতি বাইরে আছেন তাদের উপস্থিতিতেই যেন শুনানি করা হয়। নিজ কার্যালয়ে তিনি বলেন, এ বিষয়টির ওপর আমি আগা-গোড়াই জোর দিচ্ছি। যেহেতু এটা সাংবিধানিক বিষয়। সেহেতু আপীল বিভাগের সব কয়জন বিচারপতি যাতে শুনানিতে অংশ নেন। এটা কিন্তু আমি প্রথম থেকেই বলে আসছি আজও (মঙ্গলবার) বলছি। তিনি বলেন, বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা ও বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন যাতে শুনানিতে অংশ নেন সেই জন্য তাদের তালিকায় রাখা। ওনারা (বিচারপতিগণ) না আসা পর্যন্ত এবং আমাদের প্রস্তুতির জন্য সময় প্রার্থনা করেছিলাম। কিন্তু শুনানি হয়েছে। আগামী ২১ মে পরবর্তী শুনানির জন্য দিন ধার্য করেছেন। এ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আমি আদালতকে বলেছি সবাই আপীল বিভাগের সব বিচারপতি যদি এই মামলা না শোনেন তাহলে এই মামলা থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেব। তিনি বলেন, গত তারিখে প্রধান বিচারপতি বলেছেন, সব বিচারপতিকে যুক্ত করেই এ মামলাটি শুনবেন। আজকে (মঙ্গলবার) একপর্যায় ওনি (প্রধান বিচারপতি) বললেন না পাঁচজনই শুনবেন। তখন আমি বললাম সে ক্ষেত্রে আপনারা যদি আপনাদের সিদ্ধান্ত থেকে ফিরে আসেন তাহলে আমি অনাস্থা দিতে বাধ্য হব। কোন বিচারপতি এই মামলা শুনতে অপারগতাও প্রকাশ করেননি বলে জানান এ্যাটর্নি জেনারেল। আপনি কি আদালতকে হুমকি দিচ্ছেন সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে এ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, এখানে হুমকি দেয়ার প্রশ্ন আসে না। আদালত যখন বলেছিল তারা পাঁচজনই শুনবেন তখন আমি বলেছি, আপনারা আগের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সাত বিচারপতি নিয়ে শুনবেন, সে অবস্থা থেকে ফিরে আসলে আমিও অনাস্থা দেব। পরে আদালত বলেছে যখন সাবমিশন শুরু হবে তখন সবাইকে যুক্ত করা হবে। আগামী ২১ মে যুক্তিতর্ক শুরু হবে। যারা লিখিত বক্তব্য দিয়েছেন আদালত সুযোগ দিলে তারা মৌখিক সাবমিশন দেবে। তিনি আরও বলেন, কোন বিচারক যদি অসুস্থ থাকেন কোন বিচারক যদি অপারগতা প্রকাশ করতেন সে ক্ষেত্রে তো আমাদের কিছু করার নেই। আমি বলতে চাচ্ছি, যেহেতু বিষয়টি একটি সাংবিধানিক বিষয়। যেহেতু দুটি কোর্ট ভেঙ্গে একটি কোর্টে বিষয়টি শুনানি হচ্ছে। এখানে সবাইকে যুক্ত করতে হবে। তিনি বলেন, প্রধান বিচারপতি বললেন এ অবস্থাতে বিচারপতিদের অপসারণ বা ইত্যাদির বিষয়ে কোন আইন নাই। কাজেই এ বিষয়টিকে ত্বরিত গতিতে সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত। আমি বলছি হ্যাঁ নেয়া উচিত সবাইকে যুক্ত করে এবং আমাকে কিছু সময় দিয়ে। গত ৮ ফেব্রুয়ারি বিষয়টির ওপর মতামত দিতে ১২ বিশিষ্ট আইনজীবীকে এমিকাস কিউরি হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। নিয়োগ পাওয়া সিনিয়র ও বিশিষ্ট আইনজীবী হচ্ছেনÑ টিএইচ খান, ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার রফিক-উল হক, ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম, ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ, এ এফ হাসান আরিফ, আজমালুল হোসেন কিউসি, আবদুল ওয়াদুদ ভূঁইয়া, ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ, এম আই ফারুকী, এ জে মোহাম্মদ আলী ও ব্যারিস্টার ফিদা এম কামাল। এর মধ্যে ইতোমধ্যে আদালতে লিখিত মতামত দাখিল করেছেন ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম, আবদুল ওয়াদুদ ভূঁইয়া ও এম আই ফারুকী। উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণ ক্ষমতা সংসদের হাতে অর্পণ সংক্রান্ত সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীকে অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করে হাইকোর্টের ১৬৫ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় গত বছর ১১ আগস্ট প্রকাশ করা হয়। বিচারপতি মঈনুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত বৃহত্তর বেঞ্চ গত বছর ৫ মে বিষয়টির ওপর সংক্ষিপ্ত রায় দেয়। বেঞ্চের অপর দুই সদস্য ছিলেনÑ বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক ও বিচারপতি মোঃ আশরাফুল কামাল। রায়টি লিখেছেন, বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী। রায়ের সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন বেঞ্চের অপর বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক। তবে বেঞ্চের কনিষ্ঠ বিচারপতি মোঃ আশরাফুল কামাল রায়ের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে আরেকটি রায় দিয়েছেন। উচ্চ আদালতের রুলস অনুযায়ী, সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে যে রায় দেয়া হয়, সেটাই চূড়ান্ত হবে। উল্লেখ্য, সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর আলোকে বিচারপতি অপসারণের জন্য একটি খসড়া আইন প্রস্তত করা হয়েছে। অসদাচরণের জন্য সুপ্রীমকোর্টের কোন বিচারকের বিরুদ্ধে তদন্ত ও তাকে অপসারণের প্রক্রিয়া নির্ধারণ করে ‘বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্ট বিচারক (তদন্ত) আইন’-এর খসড়ার গত বছর ২৫ এপ্রিল মন্ত্রিসভা নীতিগত অনুমোদন দেয়। সর্বোচ্চ আদালতের বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা সংসদের কাছে ফিরিয়ে নিতে ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী আনা হয়। বিলটি পাসের পর ওই বছরের ২২ সেপ্টেম্বর তা গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়। পরে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী আইন-২০১৪-এর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ওই বছরের ৫ নবেম্বর সুপ্রীমকোর্টের নয়জন আইনজীবী রিট আবেদনটি করে।
×