ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০২ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১

কৃষ্ণচূড়ার লালে ঢাকা পড়েছে আকাশের নীল

প্রকাশিত: ০৫:৩৭, ১০ মে ২০১৭

কৃষ্ণচূড়ার লালে ঢাকা পড়েছে আকাশের নীল

মোরসালিন মিজান ॥ বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। হচ্ছে কি? অফিস ডেস্কের সামনে বিশাল জানালা। জানালার কাচ দিয়ে বাইরে তাকাতে হলো। আর তখনই চোখ ছানাভরা! হ্যাঁ, বৃষ্টি হচ্ছে। কিন্তু বৃষ্টির দিকে চোখ গেল না। অদূরে কৃষ্ণচূড়া। লালে হারালো দৃষ্টি। নতুন পুরনো বহু বিল্ডিং। এলোমেলো দাঁড়িয়ে আছে। সাততলার জানালা থেকে ওসবের কিছুই দেখার আগ্রহ হলো না। সবটুকু মনোযোগ কেড়ে নিল কৃষ্ণচূড়া। একটি গাছ ফ্লাইওভারের কাছাকাছি দূরত্বে দাঁড়ানো। চার-পাঁচ বাড়ি পর আরেকটি। ওপর থেকে দুটিকে এক মনে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল আগুন লেগেছে! এরপর আর পরিপার্শ্ব দেখার যায়? ফুলের আগুনে মনের আনন্দে মন পুড়ে মরে! না, শহর ঢাকার একটি দুটি জানালা থেকে নয়, বহু জায়গা থেকে এখন দেখা যাচ্ছে কৃষ্ণচূড়া। রাজধানী ঢাকার প্রধান প্রধান সড়কের দুই ধারে, পার্কে-উদ্যানে, পুরনো ভবনের কার্নিশে রঙের ছড়াছড়ি এখন। দেখতে দেখতে বদলে গেছে কদিন আগে দেখা প্রকৃতি। নতুন করে জেগেছে। ১০ থেকে ১২ মিটার উচ্চতার গাছ। শাখা-পল্লব অনেক দূর পর্যন্ত ছড়ানো। বছরের অন্যসময় তেমন চোখে পড়ে না। সামান্যই দৃশ্যমান হয় গাছটি। এপ্রিলে প্রকৃতির সবুজ পেছনে ফেলে সামনে চলে আসে অত্যন্ত আকর্ষণীয় এই ফুল। এখন মে। তাই খুঁজে নিতে হয় না। মাথা সামান্য ওপরে তুললেই চোখে পড়ে কৃষ্ণচূড়া। অনেক দূর থেকে দেখা যায়। চন্দ্রিমা উদ্যানের রাস্তার দুই ধারে কৃষ্ণচূড়ার সারি। যত পথ তত কৃষ্ণচূড়া। আকাশের নীলও যেন ঢাকা পড়েছে কৃষ্ণচূড়ার লালে! সড়ক দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছে। গত কয়েক দিন এলাকাটি ঘুরে দেখা যায়, অসংখ্য প্রকৃতিপ্রেমী এই সৌন্দর্য উপভোগে ব্যস্ত। রমনা পার্কেও উৎসবের রং। বিশাল উদ্যানে সবুজের সমারোহ। আর উৎসবের রং ছড়াচ্ছে কৃষ্ণচূড়া। এখানে প্রচুর গাছ। পার্কের যে গেট দিয়েই প্রবেশ করা যায়, স্বাগত জানায় কৃষ্ণচূড়া। ভেতরেও এর প্রবল উপস্থিতি। নিসর্গপ্রেমীরা তো বটেই, প্রাতঃভ্রমণে আসা মানুষের অনেকেই পথ হাঁটছেন কৃষ্ণচূড়ার পানে তাকিয়ে। পুরনো অফিস বা বাসার পেছন থেকেও উঁকি দিচ্ছে প্রিয় ফুল। কৃষ্ণচূড়ার বৈজ্ঞানিক নাম ডেলোনিক্স রেজিয়া। এটি ফাবাসিয়ি পরিবারের অন্তর্গত। গুলমোহর নামেও ডাকা হয়। এর আদি নিবাস আফ্রিকার মাদাগাস্কার। ১৮২৪ সালে সেখান থেকে প্রথম মুরিটাস, পরে ইংল্যান্ড এবং শেষ পর্যন্ত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বিস্তার ঘটে। এখন জন্মে আমেরিকা, ক্যারাবিয়ান অঞ্চল, হংকং, তাইওয়ান, দক্ষিণ চীন, ভারতসহ বিশ্বের বহু দেশে। ধারণা করা হয়, কৃষ্ণচূড়া ভারত উপমহাদেশে এসেছে তিন থেকে চারশ’ বছর আগে। বহুকাল ধরে আছে বাংলাদেশে। তবে ফুলের নাম কী করে কৃষ্ণচূড়া হলো সে সম্পর্কে নিশ্চিত করে কিছু জানা যায় না। ধারণা করা হয়, সনাতন ধর্মাবলম্বীদের অবতার কৃষ্ণের নামে ফুলটির নামকরণ করা হয়েছে। একটু খেয়াল করলেই চোখে পড়বে, কৃষ্ণের মাথায় চুলের চূড়া বাঁধার ধরনটির সঙ্গে ফুলটির বেশ মিল। সেখান থেকেই কৃষ্ণচূড়া। আবার উদ্ভিদবিজ্ঞানী, নিসর্গপ্রেমী কিংবা কবি সাহিত্যিকরাও এই নামকরণ করে থাকতে পারেন। উদ্ভিদবিদ দ্বিজেন শর্মা জানান, এই ফুল বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময়ে ফোটে থাকে। বাংলাদেশে ফোটে এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত। প্রথম মুকুল ধরার কিছু দিনের মধ্যেই পুরো গাছ ফুলে ফুলে ভরে যায়। ফুলের প্রধান বৈশিষ্ট্য এর উজ্জ্বল রং। তরুরাজ্যে এত উজ্জ্বল রং সত্যি দুর্লভ। ফুলের পাঁপড়ির রং গাঢ় লাল, লাল, কমলা, হলুদ, হালকা হলুদ হয়ে থাকে। প্রস্ফুটিত ফুলের ব্যাস ২ ইঞ্চি থেকে ৩ ইঞ্চি। বৃতির বহিরাংশ সবুজ। ভেতরের অংশ রক্তিম। কৃষ্ণচূড়ার ফুলগুলো বড় চারটি পাপড়িযুক্ত। পাপড়ি প্রায় ৮ সেন্টিমিটারের মতো লম্বা হয়ে থাকে। কৃষ্ণচূড়া জটিল পত্রবিশিষ্ট। প্রতিটি পাতা ৩০ থেকে ৫০ সেন্টিমিটার লম্বা। ২০ থেকে ৪০টি উপপত্র বিশিষ্ট। তবে এসব তথ্য নিয়ে সাধারণ প্রকৃতিপ্রেমীদের তেমন কোন মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না। সবাই মুগ্ধ কৃষ্ণচূড়ার সৌন্দর্যে। কবি শামসুর রাহমান লিখেছিলেন- আবার ফুটেছে দ্যাখো কৃষ্ণচূড়া থরে থরে শহরের পথে/কেমন নিবিড় হয়ে। কখনো মিছিলে কখনো-বা/একা হেঁটে যেতে যেতে মনে হয়- ফুল নয়, ওরা/শহীদের ঝলকিত রক্তের বুদ্বুদ, স্মৃতিগন্ধে ভরপুর।/একুশের কৃষ্ণচূড়া আমাদের চেতনারই রঙ...। অপরূপ সৌন্দর্যের পাশাপাশি কৃষ্ণচূড়ার পাপড়িতে বাঙালীর চেতনার রং দেখেছিলেন নাগরিক কবি। এরপর আর কৃষ্ণচূড়াকে কোন সাধারণ ফুল ভাবা যায় না। যায়?
×