ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

কেন্দ্রীয় নেতাদের ফিরে আসতে হয়েছে

বিএনপির হানাহানি জেলায় জেলায় ছড়িয়ে পড়ছে

প্রকাশিত: ০৬:০৩, ৯ মে ২০১৭

বিএনপির হানাহানি জেলায় জেলায় ছড়িয়ে পড়ছে

শরিফুল ইসলাম ॥ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে সারাদেশের সকলস্তরে দল গোছাতে গিয়ে বিপাকে পড়েছে বিএনপি। দল সুসংগঠিত হওয়ার পরিবর্তে জেলায় জেলায় ছড়িয়ে পড়ছে কোন্দল। দলের পরস্পরবিরোধী গ্রুপগুলো সংঘাত-সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ছে। কোন্দলের কারণে কোন কোন জেলায় কর্মিসভা না করেই কেন্দ্রীয় নেতাদের ঢাকায় ফিরে আসতে হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে বিএনপি হাইকমান্ড তৃণমূল নেতাদের ওপর ক্ষুব্ধ। উল্লেখ্য, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি জোরদার করতে ২৪ এপ্রিল থেকে সারাদেশের ৭৭টি সাংগঠনিক জেলার সর্বস্তরে সাংগঠনিক সক্ষমতা বাড়াতে বিএনপির সিনিয়র নেতাদের নিয়ে গঠিত ৫১টি টিম মাঠে নামে। জেলায় জেলায় গিয়ে কর্মিসভা করতে শুরু করে এসব টিমের নেতারা। কিন্তু জেলায় জেলায় কর্মিসভা করতে গিয়ে নতুন করে ঝামেলায় পড়ে বিএনপি। দীর্ঘদিন তৃণমূল পর্যায়ে সাংগঠনিক তৎপরতা না থাকায় তৃণমূল পর্যায়ে বিএনপির কোন্দল লক্ষ্য করা যায়নি। কিন্তু দল গোছানোর জন্য যখনই জেলায় জেলায় কর্মিসভা করা শুরু হয় তখনই দলের প্রতিপক্ষ গ্রুপগুলোর মধ্যে শুরু হয়ে যায় কোন্দল ও সংঘাত-সংঘর্ষ। গত কয়েক বছর নানামুখী চাপ ও মামলার ভয়ে দলীয় কার্যক্রম থেকে বিএনপির তৃণমূল পর্যায়ের বেশিরভাগ নেতাকর্মী নিজেদের গুটিয়ে রাখে। কেউ কেউ দীর্ঘদিন রাজপথ ছেড়ে অনেকটা স্বেচ্ছা অবসরে ছিলেন। এখন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে তারা সরব হয়ে উঠেছেন। তারা আগেভাগে সাংগঠনিক পদ-পদবি রক্ষা করতে এবং নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় রাখতে সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। তাই কেন্দ্রীয় নেতাদের সাংগঠনিক সফরকে কেন্দ্র করে দলের পরস্পরবিরোধী নেতাকর্মীদের শক্তি প্রদর্শনের মহড়া চলছে। আর এ কারণেই উভয় গ্রুপের মধ্যে বেধে যাচ্ছে সংঘর্ষ। সূত্র মতে, দলীয় নেতাদের কোন্দলের কারণে ইতোমধ্যেই চট্টগ্রাম দক্ষিণ, চট্টগ্রাম উত্তর, ঝিনাইদহ ও নীলফামারীসহ বেশ কটি জেলায় বিএনপির কর্মিসভা প- হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে আরও ক’টি জেলায় কর্মিসভা করার কাজ স্থগিত করা হয়েছে। বাগেরহাট জেলার নতুন কমিটি ঘোষণা করা হলেও এ কমিটিকে চ্যালেঞ্জ করে বিএনপির ২ নেতা পদত্যাগ করেছেন। চট্টগ্রামে কেন্দ্রীয় নেতাদের উপস্থিতিতে বিএনপির দু’গ্রুপের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া, ইটপাটকেল নিক্ষেপ, চেয়ার ছোড়াছুড়ি ও ভাংচুরসহ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে উভয় পক্ষের ২৩জন আহত হয়। গাড়ি ভাংচুর, রক্তারক্তি চলছে। ২ মে চট্টগ্রাম মহানগরের নাসিমন ভবনে উত্তর জেলা বিএনপির কর্মিসভার আয়োজন করা হয়। কিন্তু কর্মিসভাকে কেন্দ্র করে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান গিয়াসউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আসলাম চৌধুরীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। দুই নেতার আধিপত্য কেন্দ্র করে এ সংঘর্ষে উভয়পক্ষের ৮ জন আহত হয়। এ সময় কর্মিসভা মঞ্চে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনসহ বিএনপির অন্যান্য নেতারা উপস্থিত ছিলেন। কর্মিসভা প- হয়ে যাওয়ার পর সেখান থেকে ফিরে যান বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা। একই দিনে ঝিনাইদহ শহরের ডাঃ কে আহম্মদ পৌর কমিউনিটি সেন্টারে কর্মিসভা কেন্দ্র করে বিএনপির দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ ঘটে। ৩ মে পটিয়া পৌরসভা সদরে ইন্দ্রপুল এলাকায় একটি কমিউনিটি সেন্টারে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির কর্মিসভার আয়োজন করা হয়। কিন্তু কর্মিসভা শুরুর আগেই দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক গাজী মোহাম্মদ শাহজাহান ও সহসভাপতি এনামুল হকের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ বেধে যায়। এ সময় পরস্পরবিরোধী গ্রুপের নেতাকর্মীরা ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া, ইটপাটকেল নিক্ষেপ, চেয়ার ছোড়াছুড়ি ও ভাংচুরের মাধ্যমে সেখানে তা-ব চালায়। এতে উভয়পক্ষের ১৫ জন আহত হয়। এ ঘটনার পর বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ ও ভাইস চেয়ারম্যান মোর্শেদ খানসহ কেন্দ্রীয় নেতারা আর কর্মিসভাস্থলে যাননি। এক পর্যায়ে বিএনপির একটি গ্রুপ স্থানীয় সড়ক অবরোধ করে। পরে পুলিশ গুলি ছুড়ে ভয় দেখিয়ে বিক্ষুব্ধ বিএনপি নেতাকর্মীদের সেখান থেকে সরিয়ে দেয়। এ ছাড়া সম্প্রতি নীলফামারী জেলার সৈয়দপুর উপজেলা বিএনপি কার্যালয়ে কর্মিসভায় দলের দুই পক্ষের নেতাকর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। উপজেলা বিএনপি নেতা ও উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ওবায়দুর রহমানকে লাঞ্ছিত করার ঘটনার জের ধরে এ ঘটনা ঘটে। এদিকে এম এ সালামকে সভাপতি ও আলী রেজা বাবুকে সাধারণ সম্পাদক করে ৪ মে বাগেরহাট জেলা বিএনপির ২৫১ সদস্যের নতুন কমিটি ঘোষণা করা হলে এ কমিটির ২ নেতা পদত্যাগ করেন। দুই গ্রুপের কোন্দলের জের হিসেবে এই পদত্যাগের ঘটনা ঘটে। পদত্যাগকারী ২ নেতা হলেন নতুন জেলা কমিটির সহসভাপতি ও জেলা শ্রমিক দলের সভাপতি সরদার লিয়াকত আলী এবং নতুন কমিটির সহসাংগঠনিক সম্পাদক ও জেলা ছাত্রদলের সভাপতি সুজাউদ্দিন মোল্লা। এ ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল মাহবুবুর রহমান বলেন, একটি বড় রাজনৈতিক দলে ছোটখাটো কিছু সমস্যা থাকতেই পারে। দীর্ঘদিন পর তৃণমূল পর্যায়ে দলের কমিটি পুনর্গঠন করা হচ্ছে। তাই নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা থাকায় কোন কোন সময় নিজেদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হচ্ছে। রাজনীতি করতে গেলে নেতৃত্বের প্রতিযোগিতার কারণে ছোটখাটো ঝামেলা হতেই পারে। তবে এক সময় তা ঠিক হয়ে যাবে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় সবাই মিলেমিশে দলীয় প্রার্থীর জন্যই কাজ করবে। জানা যায়, গতবছর ১৯ মার্চ জাতীয় কাউন্সিলের পর পূর্ণাঙ্গ নির্বাহী কমিটি করতে না পারাসহ বিভিন্ন কারণে তৃণমূলে কমিটি পুনর্গঠনের কাজ থেমে যায়। এ পরিস্থিতিতে এ বছর ২৪ এপ্রিল থেকে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার নির্দেশে দলের সিনিয়র নেতাদের দিয়ে ৫১টি সাংগঠনিক টিম গঠনের মধ্য দিয়ে সারাদেশে দল গোছানোর কাজ শুরু করা হয়। এ সময় কর্মিসভা করার পাশাপাশি তৃণমূলে দল পুনর্গঠন, পরবর্তী আন্দোলন ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি সম্পর্কে প্রস্তুতি নিয়ে তৃণমূল নেতাকর্মীদের পরামর্শ দেয়া হয়। এ ছাড়া কোন্ এলাকায় কে যোগ্য প্রার্থী সে বিষয়েও কেন্দ্রীয় নেতারা খোঁজখবর নেন। বিএনপি হাইকমান্ড মনে করছে দল গুছিয়ে বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন জোরদার করতে না পারলে পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও সুবিধা করা যাবে না। বিশেষ করে এ সরকারের বিরুদ্ধে আগের ২ দফা আন্দোলন কর্মসূচীতে ব্যর্থতার পর পরবর্তীতে বুঝেশুনেই মাঠে নামতে চায় বিএনপি। এ ছাড়া আন্দোলন সফল না হলেও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি যাতে ধীরে ধীরে জোরদার করা যায় সে বিষয়েও দল গোছানো প্রক্রিয়ায় মাথায় রাখা হচ্ছে। সারাদেশে তৃণমূল পর্যায়ে দল গোছানোর কাজ শেষ করে বিএনপি প্রথমেই জনসম্পৃক্ত বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে আন্দোলন শুরু করতে চায়। তারপর আস্তে আস্তে জনমত তৈরি করে সরকারবিরোধী আন্দোলন করার প্রস্তুতি নেবে। তবে আন্দোলন শুরুর আগে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াসহ দলের সিনিয়র নেতারা দেশের গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলোতে জনসভা করবে। কোথায় কোথায় জনসভা করা যায় সে ব্যাপারে বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদকদের খোঁজখবর নিয়ে জানাতে বলা হয়েছে বলে জানা গেছে। আর পরবর্তী আন্দোলন কর্মসূচী শুরুর আগেই বিএনপির পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের পাশাপাশি সারাদেশের তৃণমূল পর্যায়ের কমিটি এবং সকল অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের কমিটি গঠনের কাজ শেষ করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এর আগে জাতীয় কাউন্সিলকে সামনে রেখে ২০১৫ সালের ৯আগস্ট কেন্দ্র থেকে চিঠি দিয়ে ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে বিএনপির সকল সাংগঠনিক জেলা ও প্রতিটি জেলার বিভিন্ন ইউনিট কমিটি পুনর্গঠন করতে বলা হয়। এর মাসখানেক পর ১৫ সেপ্টেম্বর লন্ডনের উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করার আগে গুলশান কার্যালয়ে সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। বৈঠককালে তিনি বার বার দলের নেতাদের উদ্দেশে বলেন, আপনারা সবাই মিলে তৃণমূল পর্যায়ে দল পুনর্গঠনের কাজে সহযোগিতা করবেন। খালেদা জিয়া লন্ডন সফরে গিয়ে ছেলে তারেক রহমানসহ পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ২ মাস অবস্থান করে দেশে ফেরার পরও তৃণমূলে বিএনপির কমিটি করতে না পারায় দলের সিনিয়র নেতারা তোপের মুখে পড়েন। দলীয় কোন্দলসহ বিভিন্ন কারণে অধিকাংশ জেলা-উপজেলায় কমিটি পুনর্গঠন করা সম্বব হয়নি জানতে পেরে এক পর্যায়ে খালেদা জিয়া যেসব এলাকায় কমিটি পুনর্গঠন হয়নি সেসব এলাকা থেকে মনোনীত প্রতিনিধিদের কাউন্সিলর করার সিদ্ধান্ত নেন। এ কারণে দল পুনর্গঠন কাজ স্থগিত রেখেই গত বছর ১৯ মার্চ বিএনপির জাতীয় কাউন্সিল করা হয়। এদিকে এবার তৃণমূলে দল গোছানোর কাজ করতে গিয়ে কোন্ কোন্ এলাকায় কোন্ কোন্ নেতা প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করছেন তার একটি তালিকা বিএনপি হাইকমান্ডের হাতে দেয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে। এ তালিকায় যাদের নাম থাকবে তাদের বিষয়ে পরবর্তীতে যে কোন সিদ্ধান্ত নেয়ার ব্যাপারে এলাকায় কোন্দলে জড়ানোর বিষয়টি আমলে নেয়া হবে বলেও জানা গেছে।
×