ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

করতোয়া বাঁচাতে শিশুদের উদ্যোগ

নদীতে ভাসাল কাগজের হাজারো নৌকা-ব্যতিক্রমী আয়োজন

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ৯ মে ২০১৭

নদীতে ভাসাল কাগজের হাজারো নৌকা-ব্যতিক্রমী আয়োজন

সমুদ্র হক ॥ ‘কেয়া পাতার নৌকা গড়ে সাজিয়ে দেবো ফুলে/তাল দীঘিতে ভাসিয়ে দেবো চলবে দুলে দুলে...’ রবীন্দ্রনাথের গানের মতোই খুদে শিশুরা এক হাজার কাগজের নৌকা বানিয়ে ভাসিয়ে দিল করতোয়া নদীতে। শিশু তরী, তিবাহ, কথা, গল্প, মিহিম, দিহিম বললোÑ তারা উত্তাল প্রমত্তা সেই করতোয়া নদী ফিরে পেতে চায়। যে গল্প তারা মা-বাবার কাছে শুনেছে। দেখতে চায় দখল ও দূষণমুক্ত করতোয়া নদী। এ যাবত বগুড়ার করতোয়া নদী বাঁচাতে দখলদারের বিরুদ্ধে যত আন্দোলন হয়েছে তার সব ছাপিয়ে খুদে শিশুরা নদী রক্ষায় ব্যতিক্রমী এই আকুল আবেদন জানালো। যা দেখে বগুড়ার সুধীজন বিস্মিত। আগামী প্রজন্মের মনোজগত যে কতটা ক্রিয়েটিভ, উন্নত মেধা, দূরদৃষ্টি সম্পন্ন তার প্রমাণ এটা। আয়োজনটি ছোট, তবে তার ব্যাপ্তি বিশাল। যা প্রকৃতি রক্ষার ভাবনার দুয়ার খুলে দেয়। মাত্র ১২২ জন শিশু। বয়স ৪ থেকে ৭ বছরের মধ্যে। ওরাই কাঁপিয়ে দিল বগুড়া। কেউ ভাবতেও পারেনি ‘মে দিবসে’ এসব খুদে শিশুরা বগুড়া জেলা প্রশাসন অফিসের চত্বরে গিয়ে করতোয়া নদীর তীরে সুশৃঙ্খল হয়ে রঙিন কাগজ দিয়ে এক হাজার নৌকা বানিয়ে মরা গাঙে পরিণত হওয়া করতোয়া নদীতে ভাসিয়ে দিয়ে প্রতিবাদ জানাবে। শিশুদের এমন আয়োজনে জেলা প্রশাসক মোঃ আশরাফ উদ্দিন ঘরে থাকতে পারেননি। শিশুদের সঙ্গে মিশে গিয়ে একাত্মতা প্রকাশ করে বললেন, করতোয়া নদী রক্ষায় যতটা সম্ভব তিনি নিজ উদ্যোগে মাঠে নামবেন। কথা দিলেন নদীর পাড় সংরক্ষণ করে নদী রক্ষায় বিশেষ ধরনের বাঁধ নির্মাণ করবেন। দখলদারদের উচ্ছেদ করে নদী দূষণমুক্ত রাখতে সর্বাত্মক ব্যবস্থা নেবেন। কোন দখলদার নগরীর ভেতরে করতোয়া নদী দখল করতে না পারে সে ব্যবস্থা নেবেন। তিনি জানালেন, পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) দুই তীরে রাস্তা নির্মাণ করে নদী রক্ষায় বড় একটি প্রকল্প তৈরি করে তা ওপর মহলে পাঠিয়েছে। জেলা প্রশাসকের এমন কথায় খুদে শিশুরা করতালি দিয়ে তাকে অভিনন্দিত করে। এই খুদে শিশুরা নগরীর বিভিন্ন স্কুলের শিশু শ্রেণী থেকে ৬ষ্ঠ শ্রেণীর শিক্ষার্থী। তারা বগুড়ায় বাবুই নামের শিশু-কিশোরদের পাঠশালায় আবৃত্তি, ছবি আঁকা ও নাচ শেখে। সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা বাচিক শিল্পী রাকিবুল হাসান জুয়েল পহেলা মে ছুটির দিনে সোমবার কি করা যায় এই ভাবনায় শিশুদের কাছ থেকেই জানতে চান। এ সময় সিডিতে রবীন্দ্র সঙ্গীত বাজানো হয় ‘মেঘের কোলে রোদ হেসেছে বাদল গেছে টুটি/আজ আমাদের ছুটি ও ভাই... আহ হা হা হা/কী করি আজ ভেবে না পাই, পথ হারিয়ে কোন বনে যাই, কোন মাঠে যে ছুটে বেড়াই সকল ছেলে জুটি... কেয়া পাতার নৌকা গড়ে সাজিয়ে দেব ফুলে/তাল দীঘিতে ভাসিয়ে দেবো চলবে দুলে দুলে...’ এই গান শোনার পর শিশুরাই জানিয়ে দিল তাদের লাল-নীল রঙিন কাগজ দিলে কাগজের নৌকা বানিয়ে করতোয়া নদীতে ভাসিয়ে দেবে। নদীর পাড়ে একটি দিন কাটিয়ে চড়ুইভাতি করবে। বাবুইয়ের কর্ণধার রাকিবুল হাসান জুয়েল শিশুদের বললেন, তাদের নগরীতে কেমন নদী দেখতে চায় এর ওপর ছবি আঁকা প্রতিযোগিতা হবে। নদী রক্ষার দাবি জানিয়ে তারা একটি দিন নদীর পাড়ে কাটাবে। এই ভাবনায় সেদিন দিনভর দেশের স্বার্থে শিশুদের মনোজগতের ভাষায় নদী রক্ষার আন্দোলনে শরিক হয় খুদে শিশুরা। নদীর পাড় ভেঙ্গে পড়ায় শিশুরা তীরে নৌকা ভিড়িয়ে কাগজের নৌকা ছেড়ে দেয়। শিশুদের সঙ্গে তাদের বাবা-মাও আসেন। বাবারা চুলা জ্বালিয়ে দেয়। মায়েরা রান্না করে। ছবি আঁকা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে নদীর গান গাওয়া হয়। ও গো নদী আপন বেগে পাগল পাড়া..., ও নদীরে একটি কথা শুধাই শুধু তোমারে...এই গানের সঙ্গে শিশুরা নাচ করে। নদীকে নিয়ে গল্প করে। বাবুইয়ের প্রতিষ্ঠাতা বললেন, প্রতিবছর তারা শিশুদের নিয়ে সৃষ্টিশীল নানা আয়োজন করে। গত বছর শিশুদের মৃত্তিকার সঙ্গে পরিচয় ঘটাতে কাদামাটি হাতে দেয়া হয়। এই কাদামাটি দিয়ে শিশুরা নিজেদের ভাবনায় কিছু বানায়। এভাবে মনোজগতকে সৃষ্টিশীল করে তোলা হয়। তারই ধারাবাহিকতায় এ বছরে তাদের থিম ছিল- করতোয়া নদী বাঁচাতে শিশুদের ভিন্নধর্মী আয়োজন করা। শিশুরা তা করে দেখিয়ে দিয়েছে।
×