ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সুমন্ত গুপ্ত

শিল্পাচাযের্র সংগ্রহশালায়...

প্রকাশিত: ০৬:৫৬, ৫ মে ২০১৭

শিল্পাচাযের্র সংগ্রহশালায়...

শিল্পকলার এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, প্রকৃতি ও মানবতাবাদের শিল্পী শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন। বাংলাদেশের শিল্পচর্চা ও শিল্পকলা আন্দোলনের পথিকৃৎ এ মহীরুহের চিত্রকর্ম ও আনুষঙ্গিক বেশকিছু ব্যবহার্য জিনিসপত্র নিয়ে গড়ে উঠেছে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালা। শিল্পীর জন্মস্থান জেলা শহর ময়মনসিংহের ব্রহ্মপুত্র নদের পাশে ও জয়নুল আবেদিন পার্ক ও সার্কিট হাউজের পাশে এ সংগ্রহশালার অবস্থান। যেন প্রকৃতির মাঝে শুয়ে আছে শিল্পীর অসাধারণ কিছু চিত্রকর্ম। পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি শিল্পী দেশের বিভিন্ন জায়গায় আঁকা তার সমস্ত ছবিগুলোকে একত্রিত করে সংগ্রহশালা গড়ে তোলার চিন্তা করেন; আর শিল্পীর সেসময়কার ভাবনার ফসল বর্তমানের এই সংগ্রহশালাটি। ঘড়ির কাঁটাতে তখন সকাল আটটা গত রাতে ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ শহরে এসেছি। প্রতিদিন সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেই ছুট দিতে হয় অফিস পানে। আর ডিসেম্বর মাসে আমার ওপর কাজের স্টিম রোলার চলবে। তাই ডিসেম্বর আসার আগেই মন কে সতেজ করার জন্য ভ্রমণের বিকল্প নেই। তাই আমি একদিনের ছুটি নিয়ে ছুটে চললাম। সঙ্গী হিসেবে সব সময়ের মতো মাকে সঙ্গে নিলাম। মা প্রথমে যেতে চাইছিল না। পরে অনেকটা জোর করেই মা কে নিয়ে গেলাম। অনেক দিনের সখ ছিল ময়মনসিংহে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালা দেখবো। ব্যাটে বলে মিলে গেল তাই গেলাম ময়মনসিংহে। আমার ছোট ভাই পিকু ময়মনসিংহে থাকে আকুয়া ওয়ারলেসে। পিকুর বাসাতে গিয়ে উঠলাম আমরা। পিকু খুব খুশি ওর বাসায় মাসি এসেছে তাই সকালের খাবার দাবার এর আয়োজনটা বেশ ভাল। লুচি আর আলুর দম সঙ্গে ময়মনসিংহের ঐতিহ্যবাহী মন্ডা। পেট পূজা সেরে আমরা বেরিয়ে পরলাম আমাদের নির্ধারিত গন্তব্যে। বাসা থেকে বের হয়ে আমরা তিন চাকার ব্যাটারি চালিত গাড়িতে উঠলাম। পুরনো রেলস্টেশন পেরিয়ে এগিয়ে চললাম নির্ধারিত গন্তব্যে। আমরা চলছি রেল লাইনের পাশ দিয়ে একদিকে ট্রেনের কু ঝিক ঝিক শব্দে এগিয়ে যাওয়া অন্য দিকে শহরের কোলাহল। পিচ ঢালা রাস্তা পেরিয়ে আমরা এগিয়ে চলছি। দেখতে দেখতে আমরা এসে পৌঁছালাম আমাদের কাক্সিক্ষত শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালা। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত ময়মনসিংহ শহরের সার্কিট হাউসসংলগ্ন ব্রহ্মপুত্র নদকে ঘিরে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালা এলাকায় বাঁধ দিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে পার্ক। আমরা প্রবেশ পথে টিকিট কেটে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে চললাম। চলতি পথে পিকু বললো একটি দোতলা দালান কে আশ্রয় করে ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে এই সংগ্রহশালাটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ এপ্রিল বাংলা ১৩৮২ সালের ১ বৈশাখ তারিখে তৎকালীন বাংলাদেশ সরকারের উপ-রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এই সংগ্রহশালার উদ্বোধন করেন। সে সময় দেশব্যাপী জয়নুল আবেদিনের বিভিন্ন শিল্পকর্ম সংরক্ষণের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। আর তাই প্রথম দিকেই শিল্পীর নিজের এলাকা তথা ময়মনসিংহে এই সংগহশালাটি প্রতিষ্ঠিত হয়। উদ্বোধনের পর ৭ জুলাই সংগ্রহশালার আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়। আমরা দোতলায় অবস্থিত ছবির গ্যালারিতে প্রবেশ করলাম। ভেতরে ছবি তোলা নিষেধ তাই আর ছবি তুলতে পারলাম না। দোতলায় গিয়ে দেখা মিলল প্রবীণ ব্যক্তি আবদুল গফুর ভাইয়ের সঙ্গে। তিনি এসেছে তার নাতি-নাতনিদের সঙ্গে নিয়ে। তিনিই বললেন এই সংগ্রহশালায় প্রথমে ৭০টি চিত্রকর্ম স্থান পেয়েছিল যার বেশিরভাগই ছিল তৈলচিত্র। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছবির মধ্যে ছিল- বিভিন্ন দেশ ভ্রমণকালে শিল্পাচার্যের অঙ্কিত ছবি, গুণটানা, নদী পারাপারের অপেক্ষায় পিতা-পুত্র এবং দুর্ভিক্ষ। এখান ১৭টি অতি আকর্ষণীয় ছবি ১৯৮২ সালে চুরি হয়ে যায়। এর মধ্যে ১০টি ছবি ১৯৯৪ সালে আবার উদ্ধার করা হয়। বর্তমানে তাই এখানে মোট ৬৩টি চিত্রকর্ম রয়েছে। এছাড়াও রয়েছে শিল্পাচার্যের ব্যবহৃত জিনিস এবং তার কিছু স্থিরচিত্র। আমরা ধীর পায়ে এগিয়ে চললাম। গ্যালারিতে চোখে পড়ল শম্ভুগঞ্জ ঘাট, শম্ভুগঞ্জ ব্রিজ, স্কেচ, স্কেচ, স্কেচ, স্কেচ, স্কেচ, স্কেচ (বংশীবাদক), বাস্তুহারা, প্রতিকৃতি, প্রতিকৃতি, স্কেচ, মহিষের বাচ্চা, কাজী নজরুল ইসলাম, কংকালসার, দুর্ভিক্ষ, দুর্ভিক্ষ, দুর্ভিক্ষ, রমণী-১, ১৯৫১, কাগজে টেম্পোরা, মা ও ছেলে- ১৯৫১, কাগজে টেম্পোরা, কলসী কাঁখে- ১৯৫১, কাগজে টেম্পোরা, স্নান শেষে- ১৯৫১, কাগজে টেম্পোরা, মা ও শিশু- ১৯৫৩, কাগজে টেম্পোরা, তিন রক্ষী- ১৯৫৩, কাগজে টেম্পোরা, চিন্তা- ১৯৫৩, কাগজে টেম্পোরা, চিন্তা- ১৯৫৩। আমরা গ্যালারি পরিদর্শন শেষে দেশবরেণ্য অন্যান্য শিল্পীদের চিত্রকর্মের পোস্টার বিক্রি হচ্ছে দেখে সেখান থেকে কয়েকটা পোস্টার কিনলাম। সংগ্রহশালা এলাকার চোখে পড়ল একটি উন্মুক্ত মঞ্চ। পিকু বলল শিল্পীর জন্ম ও মৃত্যুদিবসসহ বিভিন্ন জাতীয় দিবসে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় এ মঞ্চে। এ সব অনুষ্ঠান শুধু দেশী দর্শনাথীরাই নয় বিদেশী চিত্রশিল্পী ও পর্যটকরা উপভোগ করে থাকে। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালা থেকে বের হয়ে আমরা গেলাম ব্রহ্মপুত্র নদের পারে। ব্রহ্মপুত্র শুধু নদ নয়। আর এর জলের ধারাতেই সুন্দরের শেষ নেই । মনে হলো এই নদ ময়মনসিংহ নগরের মানুষের কাছে অনেক কিছুর উৎস এবং নিয়ামক। নির্মল বাতাস আর সবুজের আস্বাদ এখানে অফুরান দিবা নিশি যে কারও মন কে ভরিয়ে তুলতে পারে। পাল তোলা নৌকার অবাধ বিচরণ শিল্পীর মানস পটে আঁকা ছবির মতো। ভ্রমণ পিয়াসি যে কারোর মন ভরিয়ে দিতে পারে এই প্রাকৃতিক পরিবেশ। বলে রাখা ভালো সংগ্রহ শালার ভেতরে কোন প্রকার ক্যামেরা নিয়ে প্রবেশ করতে পাড়বেন না। তাছাড়া দর্শনার্থীদের জন্য সংগ্রহশালাটি শনিবার-বুধবার প্রতিদিন সাড়ে ১০টা থেকে সাড়ে ৪টা এবং শুক্রবার সাড়ে ৩টা থেকে সাড়ে ৭টা পর্যন্ত খোলা থাকে। বৃহস্পতিবার বন্ধ। প্রবেশমূল্য মাত্র ৫ টাকা। এর পাশেই রয়েছে জয়নুল আবেদিন পার্ক। যাবেন কিভাবে : আপনি চাইলে ঢাকা থেকে দিনে এসে ময়মনসিংহ ঘুরে দিনেই ফিরে যেতে পারবেন ঢাকায়। ঢাকার মহাখালী বাসস্ট্যান্ড থেকে ভোর ৫টা থেকে প্রতি আধা ঘণ্টা পরপর ময়মনসিংহের উদ্দেশ্যে শৌখিন, এনা, নিরাপদ বাস ছেড়ে আসে। টিকেটের মূল্য ২২০ টাকা। সময় লাগবে ২ ঘণ্টা অথবা সকাল ৭টা ৩০ মিনিটের তিস্তা এক্সপ্রেস করে ময়মনসিংহে ঘুরে আবার ৫ টা ২০মিনিটের ট্রেনে ফিরে যেতে পারেন ঢাকাতে। ট্রেনের ভাড়া ১২০ টাকা থেকে ২৫০ টাকা। এর পর মাসকান্দা বাস টার্মিনাল অথবা স্টেশন হতে রিক্সা, অটোরিক্সা যোগে যাওয়া যায়।
×