ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মহান মে দিবস পালিত

মালিক-শ্রমিক সম্পর্ক দৃঢ় করার ওপর গুরুত্বারোপ

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ৩ মে ২০১৭

মালিক-শ্রমিক সম্পর্ক দৃঢ় করার ওপর গুরুত্বারোপ

স্টাফ রিপোর্টার ॥ মালিক-শ্রমিক সম্পর্কের ওপর গুরুত্ব দিয়ে সারাদেশে পালিত হলো মহান মে দিবস। দিবসটি পালন উপলক্ষে সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে র‌্যালি, আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতি অনুষ্ঠান কবিতা পাঠেরও আয়োজন করা হয়। এসব অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, প্রতিষ্ঠান মালিক-শ্রমিকের সম্পর্ক দৃঢ় করা গুরুত্বপূর্ণ। কারখানায় শ্রমিকের যেমন সততা নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে হবে। তেমনি মালিকদের দায়িত্ব হচ্ছে শ্রমিকদের ভাল-মন্দের বিষয়ের ওপর নজর দেয়া। বিশেষ করে কারখানার কর্মপরিবেশ উন্নত করা, শ্রমিকদের নিরাপত্তার বিষয়টি দেখভাল করা এবং শ্রমিকদের জীবনকে সচ্ছল রাখাও মালিকদের দায়িত্ব। মালিক-শ্রমিক উভয়ের সুস্পর্কের মাধ্যমে দেশ এগিয়ে যাবে বলে তারা উল্লেখ করেন। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও গুরুত্ব দিয়ে দিবসটি পালনে এসব অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। দিবস উপলক্ষে সরকারীভাবে যেমন নেয়া হয় বিভিন্ন কর্মসূচী তেমনি বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের পক্ষ থেকে মে দিবসে আলোচনা সভা ও শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়। বিভিন্ন শ্রমিক সমাবেশ থেকে শ্রমিক নেতারা বলেন, ১৩১ বছর পূর্বে যে লক্ষ্যে মহান মে দিবস সংঘটিত হয়েছিল আজও তা বাস্তবায়ন হয়নি। শ্রমিকেরা কোথাও কোথাও ৮ ঘণ্টার পরিবর্তে ১৮-২০ ঘণ্টা কাজ করে থাকেন নামমাত্র পারিশ্রমিকে। শ্রমিক কর্মচারীদের অধিকার আদায়ের জন্য ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন করার আহ্বান জানান। এসব সমাবেশে তারা ন্যূনতম মুজরি ১৪ হাজার টাকা, নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত, শ্রমিক হয়রানি বন্ধ, মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার, পেশাগত স্বাস্থ্য-নিরাপত্তা, ক্ষতিপূরণের পরিমাণ বৃদ্ধি, ইপিজেডসহ সকল কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার, শ্রমিকদের জন্য আবাসন সুবিধা, আট ঘণ্টার মধ্যে এক ঘণ্টা কর্মবিরতিসহ বিভিন্ন দাবি জানান। মে দিবস উপলক্ষে সোমবার সকালে রাজধানীতে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এক বর্ণাঢ্য র‌্যালির আয়োজন করে। রাজধানীর দৈনিক বাংলা মোড়স্থ শ্রম ভবন এলাকা হতে বের হওয়া এই র‌্যালিতে নেতৃত্ব দেন নৌপরিবহনমন্ত্রী এম শাজাহান খান ও শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক। এ সময় শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব মিকাইল শিপারসহ শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং এর অধীনস্থ বিভিন্ন দফতরের কর্মকর্তা ও শ্রমিক নেতারা অংশ নেন। এদিকে মহান মে দিবস উপলক্ষে সোমবার জাতীয় প্রেসক্লাবে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজের) ও ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (ডিইউজের) যৌথ আয়োজনে এক আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। সংবাদকর্মীদের নিরাপত্তা আর পেনশনের বিষয়টি নবম ওয়েজবোর্ডে যুক্ত করার উদ্যোগ নেয়া হবে বলে জানান সাংবাদিক নেতারা। এ বিষয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার ওপর জোর দেন তারা। বিএফইউজে সভাপতি মঞ্জুরুল আহসান বুলবুলের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর তথ্যবিষয়ক উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী। আলোচনায় সাংবাদিক নেতারা জানান, আগের ওয়েজবোর্ডে যেসব জায়গায় দুর্বলতা ছিল, সেসব বিষয়গুলো চিহ্নিত করে নতুন ওয়েজবোর্ডে সেসব যেন না থাকে সে বিষয়ে সাংবাদিক নেতারা কাজ করছে। সভায় ইকবাল সোবহান চৌধুরী বলেন, স্বৈরাচার উৎখাত করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সাংবাদিক সমাজ সকল পেশাজীবী মানুষকে সঙ্গে নিয়ে আন্দোলন করেছে। আন্দোলনে সফলতা এসেছে ঠিকই, কিন্তু যারা তখন ক্ষমতায় এসেছিল, তারা রাজনৈতিক কারণে ১৯৯১ সালে সাংবাদিক ইউনিয়নকে বিভক্ত করে ফেলে। সেই বিভক্তি আজও রয়েছে। এ বিভক্তির দেয়াল না সরা পর্যন্ত সার্বিকভাবে সাংবাদিক সমাজ বঞ্চিত থাকবে বলে উল্লেখ করেন তিনি। সভায় অন্যদের মধ্যে বিএফইউজের মহাসচিব ওমর ফারুক, সাবেক মহাসচিব আবদুল জলিল ভূইয়া, ডিইউজের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আজিজুল ইসলাম ভূইয়া, ডিইউজের সভাপতি শাবান মাহমুদ, জাতীয় প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ফরিদা ইয়াসমিন, ডিইউজের সাবেক সাধারণ সম্পাদক কুদ্দুস আফ্রাদ, ডিইউজের সাধারণ সম্পাদক সোহেল হায়দার চৌধুরী বক্তব্য রাখেন। জাতীয় শ্রমিক লীগ বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে মহান মে দিবস উপলক্ষে সোমবার এক আলোচনা সভার আয়োজন করে। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেনÑ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এমপি। জাতীয় প্রেসক্লাবে ঢাকা সাব-এডিটরস কাউন্সিলের পক্ষ থেকেও মহান মে দিবস উপলক্ষে এক আলোচনা সভার আয়োজন করে। সংগঠনের সভাপতি কে এম শহীদুল হকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন রেলপথমন্ত্রী মুজিবুল হক। মহান মে দিবস ও আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংহতি দিবস উপলক্ষে রাজধানীর তোপখানা রোডস্থ বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির কার্যালয়ের সামনে জাতীয় শ্রমিক ফেডারেশন শ্রমিক সমাবেশ করে। এতে সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের কার্যনির্বাহী সভাপতি কামরুল আহসান। মহান মে দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ ট্রাস্ট গার্মেন্টস শ্রমিক-কর্মচারী ফেডারেশন জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে সমাবেশ ও মিছিল বের করে। এতে সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের সভাপতি এইচ এম বিল্লাল। সমাবেশে পোশাক শ্রমিকদের জন্য ১৪ দফা দাবিনামা উপস্থাপন করেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক আবিদা সুলতানা দিবা। সমাবেশে ন্যূনতম মুজরি ১৪ হাজার টাকা, নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত, শ্রমিক হয়রানি বন্ধ, মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার, পেশাগত স্বাস্থ্য-নিরাপত্তা, ক্ষতিপূরণের পরিমাণ বৃদ্ধি, ইপিজেডসহ সকল কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার, শ্রমিকদের জন্য আবাসন সুবিধা, আট ঘণ্টার মধ্যে এক ঘণ্টা কর্মবিরতিসহ বিভিন্ন দাবি জানানো হয়। মহান মে দিবস উপলক্ষে গৃহ শ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠা নেটওয়ার্ক জাতীয় প্রেসক্লাব প্রাঙ্গণে আলোচনা সভা ও বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রার আয়োজন করে। এতে বক্তব্য রাখেন মোঃ আবুল হোসেন, সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমদ, নাজমা ইয়াসমিন প্রমুখ। বাংলাদেশ সংযুক্ত গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশন মহান মে দিবস উপলক্ষে আজ সকালে জাতীয় প্রেসক্লাব প্রাঙ্গণে আলোচনা সভা ও বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রার আয়োজন করে। এতে সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের সভাপতি আলী রেজা হায়দার। মে দিবস উপলক্ষে গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র জাতীয় প্রেসক্লাব প্রাঙ্গণে আলোচনা সভা ও বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রার আয়োজন করে। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। বাংলাদেশ শ্রমিক ফেডারেশন সোমবার সকাল ৯টায় জিপিওর সামনে জিরো পয়েন্টে শ্রমিক সমাবেশ করে। এদিকে মে দিবসে প্রাইভেটকার ড্রাইভার ইউনিয়ন জাতীয় প্রেসক্লাব প্রাঙ্গণে আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে সমাবেশ ও র‌্যালি করেছে। এতে বক্তব্য রাখেন তৌফিকুল ইসলাম, তানভীর হাসান, কাশেম সর্দার প্রমুখ। অভিবাসী কর্মীদের অধিকার রক্ষায় জাতিসংঘ ষোষিত সনদ বাস্তবায়ন করার দাবি জানানো হয়েছে। ওয়ারবী ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন ও প্রবাসীদের নিয়ে কাজ করা সাংবাদিকদের সংগঠন রিপোর্টার্স ফর বাংলাদেশী মাইগ্রান্টস (আরবিএম) যৌথভাবে মহান মে দিবসে আলোচনা অনুষ্ঠানে এ দাবি জানানো হয়। সোমবার জাতীয় প্রেসক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে অভিবাসী কর্মীদের অধিকার রক্ষায় ‘অবজারভেশন এ্যান্ড রিকমেন্ডাশন অব ইউএন মাইগ্রান্ট ওয়ার্কার্স কমিটি টু প্রটেক্ট দ্য রাইটস অব মাইগ্রান্ট ওয়ার্কার্স’ শীর্ষক আলোচনা সভার আগে প্রেসক্লাবের সামনে অভিবাসী কর্মীদের অধিকার রক্ষায় সংহতি প্রকাশ করে মানববন্ধনও করা হয়। আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেনÑ সংসদ সদস্য রোকসানা ইয়াসমিন ছুটি (সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য)। তিনি বলেন, সারা বিশ্বজুড়ে সমস্ত কর্মীদের শ্রমকে সম্মান জানান মহান মে দিবসে। অভিবাসী কর্মীদের জন্য সরকার নানা কর্মসূচী বাস্তবায়ন করছে। এরপরও কিছু সমস্যা আছে যা থেকে আমরা পরিত্রাণ পেতে পারি। আমরা সবাই যদি যার যার জায়গা থেকে কাজ করি তাহলে কর্মীদের অনেক সমস্যা দূর হবে। আরবিএম (রিপোর্টার্স অব বাংলাদেশী মাইগ্রেন্টস) সভাপতি ফিরোজ মান্না বলেন, অভিবাসন খরচ কমিয়ে আনা উচিত। আধুনিক দাসত্ব এখনও বিদ্যমান আছে। প্রতিনিয়ত নতুন কৌশলে গরিব কর্মীদের ঠকানো হচ্ছে। এখানে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষই কম-বেশি জড়িত। বাংলাদেশী অভিবাসী কর্মীদের নিরাপত্তাকে একটি বড় চ্যালেঞ্জ বলে আখ্যায়িত করেছেন মাসউদুল হক, সাধারণ সম্পাদক রিপোর্টার্স অব বাংলাদেশী মাইগ্রেন্টস (আরবিএম)। অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ওয়ারবী ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের পরিচালক প্যানেলে আলোচনায় জাতিসংঘের মানবাধিকার কর্মকর্তা জাহিদ হোসেন বলেন, জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে সকল সদস্য রাষ্ট্রের কর্তব্য হলো জাতিসংঘের চার্টার মেনে নিয়ে এর কর্মকা- পরিচালনা করা। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর শিফা হাফিজা বলেন, সিভিল সোসাইটিকে দ্বিপক্ষীয় চুক্তির সঙ্গে জড়িত থাকা উচিত। এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এসডিজির গোলসমূহের অনেকগুলো গোলই অভিবাসনের সঙ্গে সম্পৃক্ত, সেক্ষেত্রে আমরা এসডিজি গোলসমূহকে কাজে লাগাতে পারি। অধ্যাপক ড. সি আর আবরার (নির্বাহী পরিচালক, রিফিউজি এ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিট-রামরু) বলেন, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন (এনএইচআরসি) তাদের স্বাধীনতা-স্বায়ত্তশাসন দেয়ার মাধ্যমে নিজেদের ক্ষমতায়নে থাকা প্রয়োজন। মজুরি আয় কল্যাণ বোর্ডের তদারকি এবং কাজের স্বচ্ছতা থাকা প্রয়োজন। দালালদের আইনের আওতায় বা সমন্বয় করা যায় কিনা ভাবা যেতে পারে। ওয়ারবী ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ও আলোচনা সভার সভাপতি সৈয়দ সাইফুল হক বলেন যে, সরকারের উচিত যেসব দেশে আমাদের কর্মী অভিবাসন করছে সেসব দেশে সরেজমিনে তত্ত্বাবধান করা। যদি তা করা হয় তাহলে অভিবাসী কর্মীদের অধিকার অনেকাংশে রক্ষা হবে। আলোচনা সভায় মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন, জাসিয়া খাতুন ও হেলভেটাস সুইস ইন্টার-কর্পোরেশনের প্রোগ্রাম অফিসার নায়েলা আকতার।
×