ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

বগুড়ার নিভৃত পল্লীতে তীর্থভূমি মাতৃসরোবর উদ্বোধন

প্রকাশিত: ০৫:৫১, ২৫ এপ্রিল ২০১৭

বগুড়ার নিভৃত পল্লীতে তীর্থভূমি মাতৃসরোবর উদ্বোধন

সমুদ্র হক ॥ মানব চেতনা ও মানব কল্যাণের সম্প্রীতির বন্ধনের এক তীর্থস্থান উন্মুক্ত হলো বগুড়ার নিভৃত পল্লীতে। যেখানে আছে পুণ্যস্নানের দীঘি। স্বচ্ছ জলের আধার। নামকরণ হয়েছে মাতৃ সরোবর। চারধারে সুদৃশ্য ১৬টি ঘাট। উত্তর ও দক্ষিণ পাড়ে ১২টি বাগান। পূর্বপাড়ে উন্মুক্ত চেতনার প্রতীক পদ্মফুলের বাগান। সরোবরের ভেতরে কেন্দ্রবিন্দুতে স্থাপিত মন্দির। সরোবরের ওপর দিয়ে মন্দিরে প্রবেশের পাকা সড়ক। উদ্যোক্তারা বললেন, এই তীর্থভূমির তত্ত্বগত ভিত্তি হলো শ্রীঅরবিন্দের ‘দ্য আওয়ার অব গড (অরোভিল)’ ও শ্রীঅরবিন্দ আশ্রম। দেশে এ ধরনের তীর্থভূমি এই প্রথম। এই তীর্থভূমির মাতৃ সরোবরের উদ্দেশ্য হলো, সাধারণ মানব চেতনা অতিমানস চেতনার মধ্যে সেতুবন্ধ স্থাপন। এমন তীর্থভূমির মাতৃ সরোবরের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয় ২৪ এপ্রিল সোমবার সকালে। উদ্বোধন করেন শ্রীঅরবিন্দ আশ্রম দিল্লীর চেয়ারপার্সন তারা জৌহর (৮১)। সঙ্গে ছিলেন তপন কুমার প্রামাণিক। বগুড়া জেলা শহর থেকে প্রায় ২১ কিলোমিটার পূর্ব-উত্তরে মহিষাবান গ্রামে এই তীর্থস্থানের অবস্থান। সরু পাকা সড়ক ধরেই পৌঁছতে হয়। সোমবার ভোর থেকেই চারদিক থেকে পুণ্যার্থী নারী-পুরুষের ঢল নামে। বিকেল পর্যন্ত ১৫ হাজারেরও বেশি পুণ্যার্থীর আগমন ঘটে। সবার উদ্দেশ্য এক, সরোবরের জলে স্নান করে অন্তরের প্রার্থনা করা। পুণ্যস্নানে অংশ নিতে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পুণ্যার্থীরা আসেন। পরিণত হয় এক মহোৎসবে। উৎসবকে ঘিরে গ্রামের পথের ধারে মেলা বসে। কার, মাইক্রোবাস, মিনিট্রাক, সিএনজিচালিত অটোরিক্সা, ব্যাটারিচালিত ইজিবাইকে চেপে লোকজন আসতে থাকেন। গ্রামের সরু সড়কেও জ্যাম লেগে যায়। এই তীর্থভূমির নাম শ্রীঅরবিন্দ মীরা শক্তিপীঠ, যা স্থাপিত হয়েছে শ্রীঅরবিন্দ ফাউন্ডেশন বগুড়ার উদ্যোগে। প্রতিষ্ঠায় সবচেয়ে বড় অবদান রেখেছেন ফাউন্ডেশনের সভাপতি ডাঃ বিপুল চন্দ্র রায়। তিনি বললেন, এই মাতৃ সরোবর পবিত্র আধ্যাত্মিক ক্ষেত্র; যেখানে প্রতিদিন সকল মানুষের মঙ্গল কামনায় ধ্যান (মেডিটেশন), প্রার্থনা, পবিত্রতা ও শুদ্ধতার কামনায় অন্তর প্রেরণা পাওয়া যাবে। ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক কাঞ্চন কুমার অধিকারী বললেন, এই তীর্থভূমির পবিত্র বাক্য- ‘তৎ-সৎ-অদিতি-ওম’। এই বাণীর দ্রষ্টা ঋষি শ্রীঅরবিন্দ, যার সংরক্ষিত স্মৃতিচিহ্ন (দেহাংশ) বগুড়ার এই মাটিতেই আছে। এ কারণে মাতৃ সরোবার ও মন্দির এই ভূমিতেই স্থাপিত হয়েছে। উদ্বোধন উপলক্ষে অতিথি হয়ে আরও এসেছিলেন পন্ডিচেরি থেকে সমীর কুমার সেন, কলকাতার শ্রীঅরবিন্দ অনুশীলনের ডাঃ জগন্ময় ব্যানার্জী, মনোজ রায় প্রমুখ। অনুষ্ঠানে এসেছিলেন বাংলাদেশ সরকারের অতিরিক্ত সচিব ইতি রানী পোদ্দার। বললেন, এই তীর্থভূমি বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সম্প্রীতির বন্ধনকে সুদৃঢ় করবে। এই তীর্থভূমিতে একটি লাইব্রেরি স্থাপিত হয়েছে। ডাঃ বিপুল চন্দ্র রায় বললেন, গ্রামরে মানুষের চিকিৎসার জন্য একটি হাসপাতাল নির্মিত হবে। হাসপাতালটির ভিত্তিফলক উন্মোচন করেন তারা জৌহর। তীর্থভূমির কয়েকটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলোÑ মাতৃমন্দির ও সরোবরকে কেন্দ্র করে চারদিকে জলবেষ্টিত। ডাঃ বিপুল চন্দ্র রায় ও ডাঃ জগন্ময় ব্যানার্জী বললেন, শ্রীমা ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন মাতৃমন্দিরের চারদিক জলবেষ্টিত হবে। সরোবরের চারটি পাড় শ্রীঅরবিন্দের চারটি মহাগ্রন্থ সাবিত্রী, দিব্যজীবন, যোগসমন্বয় ও মা নামে পরিচিতি দেয়া হয়েছে; যা আস্পৃহা, পরিবর্জন, সমর্পন ও আরোহণ-অবরোহণের প্রতীক বলা হয়েছে। সরবোরের ১৬ ঘাটের মধ্যে বাকি ১২টি ঘাট ১২টি শক্তির প্রতীক হিসেবে বর্ণিত হয়েছে। সরোবরের গেটে সাতটি সূর্য অতিমানসের প্রতীক হিসেবে রাখা হয়েছে। অষ্টম সূর্যটি তীরচিহ্ন দিয়ে ভূগর্ভের ভেতরে ইঙ্গিত করা হয়েছে। সরোবরের পদ্মফুলের বাগানকে মানব মনের একান্ত গভীরের সমমর্মিতার ও চেতনার বিকাশে মন্ত্রমুগ্ধের মতো গড়ে তোলার প্রতীকী করা হয়েছে। পুণ্যস্নানে অতিথিরা চারধারে বাগান দেখে ধ্যানের মাধ্যমে নিজেদের পবিত্রতা, শুদ্ধতার দিকে লালন করতে পারবেন। মাতৃ সরোবরের আদর্শ বর্ণনায় উল্লেখ করা হয়েছে, মাতৃ সরোবর/ সুশীতল মনোহর/ শক্তিস্বরূপিনী/অশুভনাশিনী-শান্তিময়ী সুধাময়ী/অপার করুণাময়ী/ পবিত্রতম স্থান/অতিমানস ধাম... সবার জন্য অবারিত দ্বার। একজন পুণ্যার্থী বললেন, এই তীর্থভূমিতে এসে মনে হয়েছে মানব মনকে প্রো-এ্যাকটিভ হতে শেখাবে। খুলনা থেকে এসেছিলেন অরবিন্দ সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক মৃণাল কান্তি বড়াল। বললেন, দেশের মধ্যে এত সুন্দর তীর্থস্থান গড়ে তোলা হয়েছে যা দেখে তিনি অভিভূত। এলাকার লোকজন বললেন, এই তীর্থভূমি এ এলাকার গৌরব। অতিথিরা বললেন, প্রবেশের পরই মনের মধ্যে প্রশান্তি চলে আসে। বিশেষ করে সরোবরের চারধারে যে বাগান করা হয়েছে তা দেখে প্রাণ জুড়িয়ে যায়। মনের মধ্যে সুন্দর অবারিত ভাবনার দুয়ার খুলে যায়।
×