ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

শাহীনা নামের আরেক তরুণীকে খোঁজা হচ্ছে

নাগরী-সুমি পরকীয়ার অনেক অজানা কাহিনী

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ২৩ এপ্রিল ২০১৭

নাগরী-সুমি পরকীয়ার অনেক অজানা কাহিনী

আজাদ সুলায়মান ॥ ব্যবসায়ী নুরুল ইসলাম হত্যা মামলায় রিমান্ডে থাকা আসামিদের আবারও রিমান্ডে আনা হবে। চাঞ্চল্যকর এ মামলায় নিউমার্কেট থানায় রিমান্ডে থাকা তিন আসামি সাবেক কাস্টমস কমিশনার শাহাবুদ্দিন নাগরী, নুরুল ইসলামের স্ত্রী নুরানী আক্তার সুমি ও তাদের চালক সেলিমকে আজ (রবিবার ) আরও সাতদিনের রিমান্ড চেয়ে আদালতে পাঠানো হবে। প্রথম দফা রিমান্ড শেষ হলেও পুলিশ এ হত্যাকা-ের রহস্য উদঘাটন করতে পারছে না। হত্যাকা-ের বিষয়ে তেমন অগ্রগতি না হলেও পুলিশ শাহাবুদ্দিন নাগরী ও তার প্রেমিকা সুমির ব্যক্তিগত জীবনের অনেক অজানা তথ্য সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছে। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে তাদের জীবনের নানা কেলেঙ্কারি বেরিয়ে আসছে । সুমির সঙ্গে পরকীয়ায় জড়ানো ছাড়াও নাগরীর সুদীর্ঘ চাকরি জীবন,ব্যক্তিজীবন ও রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ সম্পর্কেও অনেক তথ্য জানতে পেরেছে পুলিশ। হঠাৎ কবি, সুরকার ও গীতিকার হয়ে ওঠার কাহিনী আরও চমকপ্রদ। আর বিনোদনপাড়ায় নাগরীর বিরুদ্ধে রয়েছে আরও মুখরোচক অভিযোগ। নিউমার্কেট থানার ওসি তদন্ত মাতলাবুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, তদন্তে এখন পর্যন্ত নুরুল ইসলাম হত্যাকা-ের কোন মোটিভ বা হত্যাকা-ের ধরই সম্পর্কে আসামিরা কিছুতেই মুখ খুলছে না। তবে তাদের অনৈতিক জীবনের অনেক অজানা অধ্যায় জানা গেছে। এখন শাহীনা নামের আরও এক তরুণীকে খেটাজা হ”েয়। এই শাহীনার মাধ্যমেই সুমির সঙ্গে পরিচয় ঘটে। পুলিশ জানিয়েছে, মূলত সুমি একজন উঁচু দরের কলগার্ল। তার একাধিক বিয়ে হলেও তার অন্ধকার জীবনের কারণেই সংসার ভেঙ্গেছে। তার ধানম-ির বাসাটি ছিল একটা মধুকুঞ্জ। শাহীনার মাধ্যমেই ওই আস্তানার সন্ধান পান নাগরী। নাগরী ছাড়াও এখানে যাতায়াত ছিল আরও কয়েক ব্যবসায়ী শিল্পপতি ও আমলার। তাদের সবার কাছ থেকে সুমিকে ভাগিয়ে একক নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্যই এলিফ্যান্ট রোডের বর্তমান ফ্ল্যাট ভাড়ার ব্যবস্থা করে দেন। তারপর আর কেউ সুমির নাগাল পাননি। এদিকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের একাধিক সূত্র জানায়, চাকরি জীবনে এই নাগরী ছিলেন খুব বেপরোয়া। তিনি নিজের সিনিয়রকেও মানতেন না। বিশেষ করে বিগত বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন চারদলীয় সরকারের আমলে নাগরী নিজের খেয়ালখুশিমতো অফিস চালাতেন। এ সময় কাউকেই তিনি তোয়াক্কা করতেন না। একবার রাজস্ব বোর্ডের এক সভায় তিনি প্রকাশ্যেই স্বীকার করে নেন, তিনি মনেপ্রাণে বিএনপির রাজনীতি ও আদর্শ ধারণ করেন। এ কারণেই হাওয়া ভবনে তার অবাধ যাতায়াত তার জন্য মামুলি ব্যাপার বলে প্রচার করতেন। এ নিয়ে সে সময় তার নামে অনেক মুখরোচক খবর চাউর হয়েছে। ওয়ান-ইলেভেনের সেনাশাসনের সময় তিনি কিছু সময় আত্মগোপনে কাটান। তখন তাকে শীর্ষ দুর্নীতিবাজদের তালিকাভুক্ত করা হয়। একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনেও নাগরীর রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ ও অঢেল স¤পদের তথ্য উল্লেখ করা হয়। এমনকি আওয়ামী সরকারের আমলেও সরকারী চাকরিতে কর্মরত থেকেও তিনি বিএনপির নেতাদের সঙ্গে সর্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখতেন। নিজের চাকরির প্রভাব খাটিয়ে বড় ব্যবসায়ীদের জিম্মি করতেন। তাদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করে বিএনপির সরকারবিরোধী আন্দোলনে অর্থায়ন করতেন। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির মনোনয়নের জন্য চেষ্টা করছিলেন। সরকারী চাকরিতে থেকে সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকা এবং সীমাহীন দুর্নীতির কারণে মহাজোট সরকার তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠায়। তারপরও তিনি দমেননি। তার বাসায় বেশ কজন বিতর্কিত শিল্পপতি, ব্যবসায়ী ও আমলার গোপন যাতায়াত ছিল। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলাও রয়েছে। চট্টগ্রাম কাস্টমসের নিলাম শাখা থেকে সর্বোচ্চ দরদাতাকে গাড়ি সরবরাহ না করে অন্যজনকে সরবরাহ করার অভিযোগের মামলায় তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছিল। এ ছাড়াও তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনসহ (দুদক) একাধিক মামলা রয়েছে। একজন লেডিকিলার হিসেবেও নাগরীর জীবনে রয়েছে নানা কাহিনী। বিনোদন পাড়ায় এখনও শোনা যায় তার প্রযোজক হয়ে ওঠার নেপথ্য কথা। কিভাবে তিনি দেশের প্রথম প্যাকেজ নাটকে বিনিয়োগ করেছেন, অন্যের লেখা চুরি করে নিজে লেখক সেজেছেন, কবি হয়ে উঠেছেন সেটা তার সহকর্মীরা এখনও চাউর করেন। বিগত চারদলীয় জোট সরকারের সময় ছদ্মনামে নাটক-টেলিফিল্মে বিনিয়োগ শুরু করেন। উঠতি মডেল, অভিনেত্রীদের নিয়ে তিনি নাটক বানান, মোটা অঙ্কের টাকাও দেন। ওসব তরুণীকেই তিনি কাজে সুযোগ দেন, যারা তার সঙ্গে একান্তে সময় কাটাতে রাজি হয়। তিনি শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগে থাকার সময় ব্যবসায়ীদের বাসায় ডেকে নিয়ে যেতেন। বিতর্কিত ব্যবসায়ীদের কালো তালিকাভুক্তির নামে বাণিজ্য করতেন। দুর্নীতি করেই তিনি কোটি কোটি টাকা বানিয়েছেন। বিপুল সম্পদ গড়েছেন। কেবল সুমিই প্রথম নন; এর আগেও বহু সুন্দরী নারীকে তিনি শয্যাসঙ্গী করেছেন। ফ্ল্যাট কিনে দিয়েছেন। তাদের কাছে নিয়মিত যাতায়াতও ছিল তার। নাগরীর পরিবার ও পরিচিতজন তার অবাধ যৌনাচারের কথা জানতেন। কিন্তু কেউ কিছু বলার সাহস করত না। তার দাপটে তটস্থ থাকত অনেকেই্। এক নাট্যপ্রযোজক জানান, নিত্যনতুন নারীর সঙ্গ পেতেই নাটকে বিনিয়োগ করতেন নাগরী। অবৈধপথে অর্জিত বিপুল টাকা খরচের জন্য নারীর নেশায় মাতেন নাগরী। অবৈধ টাকা বৈধ করতেই তিনি হঠাৎ গায়ক বনে যান। শুরু করেন লেখালেখি। তার লেখা গান অধিকাংশই চুরি করা। প্রচুর টাকা খরচ করে গান ও বইয়ের প্রচার চালান তিনি। মূলত, জনপ্রিয়তা নয়, ব্যাপক প্রচারের কারণেই নাগরীকে মানুষ চেনে ও জানে। এ সম্পর্কে রাজস্ব বোর্ডের এক কর্মকর্তা জানান, অসৎ উপায়ে অর্জিত কোটি কোটি কালো টাকা সাদা বানাতেই তিনি সঙ্গীতে প্রবেশ করেন। নাগরী ১২টি গানের এ্যালবাম করেছেন। এসব এ্যালবামের বেশিরভাগ গানের গীতিকার, সুরকার ও গায়ক নাগরী নিজেই। তিনি সবার কাছে প্রচার করতেন তার গানের এ্যালবাম বিক্রি হচ্ছে দেদার। গানের ক্যাসেট বিক্রি করেই তিনি অর্থ-বিত্তের পাহাড় গড়েছেন। বাস্তবে নাগরীর কোন ক্যাসেটই বিক্রি হতো না। নাটক ও গানের এ্যালবাম ফ্লপ হলেও তিনি প্রচার করতেন সুপারহিট। কয়েকটি বিনোদন পত্রিকায় তাকে নিয়ে কাভার স্টোরিও করেছে সে সময়। বাংলাবাজারের এক প্রকাশক জানান, নাগরী অনেক ধূর্ত। বহুমুখী প্রতিভার দাবিদার নাগরী তরুণ লেখকদের লেখা বই আকারে প্রকাশ করার কথা বলে তা হাতিয়ে নেন। পরে সেগুলো নিজে প্রকাশ করতেন। এ নিয়েও একাধিকবার দেনদরবার হয়েছে। নাগরী নিজেকে একাধারে কবি, গীতিকার, ঔপন্যাসিক, ছোট গল্পকার, সুরকার, গায়ক ও নাট্যকার দাবি করেন। এমনকি নিউমার্কেট থানার পুলিশ যখন তাকে গ্রেফতার করতে নিকুঞ্জের বাসায় হানা দেয় তখনও তার পরিবারের সদস্যরা বলেন, উনি একজন নামকরা কবি ও ঔপন্যাসিক। উল্লেখ্য, গত ১২ এপ্রিল এলিফ্যান্ট রোডের ১৭০/১৭১ ডোম-ইনো এ্যাপার্টমেন্টে নিজ বাসার বেডরুমে ব্যবসায়ী নুরুল ইসলামের মরদেহ পাওয়া যায়। এই ঘটনার পরদিন নিউমার্কেট থানায় নিহতের বোন শাহানা রহমান কাজল বাদী হয়ে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলায় নিহতের স্ত্রী নুরানী আকতার সুমি ও তার প্রেমিক শাহাবুদ্দীন নাগরী, চালক সোহাগ ও অজ্ঞাত কয়েক ব্যক্তিকে আসামি করা হয়। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা প্রথমদিনই ঘটনাস্থল পরিদর্শনের পর নিকুঞ্জে শাহাবুদ্দিনের বাসা নজরদারিতে রাখেন। বাসায় তার অবস্থান নিশ্চিত হবার পর সেখানে হানা দিয়ে আটক করা হয় শাহাবুদ্দিন নাগরীকে।
×