ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বৈশাখী মেলা বাংলা একাডেমিতে

লোক ঐতিহ্যের নানা পণ্য, ফেলে আসা দিনের স্মৃতি

প্রকাশিত: ০৬:০৮, ১৭ এপ্রিল ২০১৭

লোক ঐতিহ্যের নানা পণ্য, ফেলে আসা দিনের স্মৃতি

জনকণ্ঠ ফিচার ॥ বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন মানেই হাজারও উৎসব অনুষ্ঠান। তবে ঐতিহ্যের অনুষঙ্গ বৈশাখী মেলা। বাংলাদেশের গ্রামগুলোতে এখনও এই মেলার আয়োজন করা হয়। শহরের উদ্যোগগুলোর মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য বাংলা একাডেমি চত্বরের বৈশাখী মেলা। প্রতিবছরের মতো এবারও এখানে মেলার আয়োজন করেছে বিসিক। বছরের প্রথম দিন এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। মেলার প্রতি স্টলে গ্রামীণ পণ্য। লোকজ সংস্কৃতির নানা উপাদান সুন্দরভাবে সাজানো। শুধু তাই নয়, স্টলে বসেই কাজ করছেন অনেক শিল্পী ও কারিগর। শহুরে মানুষ বিপুল আগ্রহ নিয়ে তাদের কাজ দেখছেন। চলছে সৌখিন কেনাকাটা। তৃতীয় দিন রবিবার একাডেমি চত্বরে গিয়ে দেখা যায়, অন্য বছরের মতোই সাজানো হয়েছে স্টল। শতাধিক স্টলে পসরা সাজিয়ে বসেছেন দেশের প্রসিদ্ধ হস্ত ও কারুশিল্পীরা। মৃৎশিল্প, বাঁশ ও বেতশিল্প, নকশীকাঁথা, শতরঞ্জি, হাতপাখা, ঐতিহ্যবাহী জামদানি, তাঁতের শাড়ি, গহনা, ঝিনুকপণ্য, পুঁথিরমালা সবই পাওয়া যাচ্ছে। এমনকি বাদ যাচ্ছে শৈশবে মেলা ঘুরে কেনা খাবারগুলোও। একটি স্টলে শখের হাঁড়ি। শিকেয় ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। গায়ে কাঁচা হলুদ রং। তার ওপর লাল ও সবুজ রঙে ফুল-লতা-পাতার নক্সা। দেখে মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না। শখের হাঁড়ি এখন মূলত গৃহসজ্জার কাজে ব্যবহৃত হয়। বিভিন্ন আকারের ৪টি হাঁড়ি দিয়ে তৈরি এক সেটের দাম ১০০ টাকা। ৫ হাঁড়ির সেট সংগ্রহ করা যাচ্ছে ২০০ টাকায়। নিজের স্টলের সামনের ফাঁকা জায়গায় বসে শখের হাঁড়ি রং করছিলেন রাজশাহীর সঞ্জয় কুমার পাল। বয়সে তরুণ শিল্পী বললেন, সারাবছর কাজ করি। যেখানে মেলা হয় ছুটে যাই। কিন্তু বিক্রি কম। এটি বাপ-দাদার পেশা। আর কোন কাজ শিখিনি। তাই ছাড়তে পারছি না। পহেলা বৈশাখের মতো বিশেষ দিবসগুলোতে শাহবাগ বা টিএসসি এলাকার কোথাও বসে কাজ করার সুযোগ চান তিনি। মৃৎশিল্পের আরেকটি স্টলের মালিক আবুল কালাম মিয়া। রায়ের বাজারের এই শিল্পী নিজের কাজে ঐতিহ্য আধুনিকতার সমন্বয় ঘটিয়েছেন। স্টলের নাম ‘পোড়া মাটির নকশা ঘর।’ এখানে বিভিন্ন আকার ও আকৃতির পটারি, ফ্লাওয়ারভাস। আছে ঘর সাজানোর নানা পণ্য। কোনটিই নতুন নয়। তবে প্রতিটি কাজ এত সুন্দর আর নিখুঁত যে, দেখে নতুনের মতো মনে হয়। হাতে নিয়ে দেখতে ইচ্ছা করে। প্রতি কাজে নিজের দক্ষতা ও যতেœর ছাপ স্পষ্ট করেছেন শিল্পী। মাটির স্বভাব বোঝেন। তাই হয়ত যেমনটি চাই, গড়ে নিয়েছেন। গড়ে নিতে পেরেছেন। শিল্পীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেল তিনি সেই ১৯৭৫ সাল থেকে কাজ করছেন। রায়েরবাজারের সাড়ে ৭শ’ হিন্দু পরিবার এই কাজ করত জানিয়ে তিনি বলেন, আমি একা ছিলাম মুসলিম। বাপ-দাদার পেশা অনেকেই ছেড়ে দিলেও ভালবাসার কারণে কাজটি ছাড়তে পারেননি বলে জানান তিনি। মেলায় এসেছেন শোলাশিল্পীরাও। একাধিক স্টলে শোলায় তৈরি ফুল। গোলাপ বেলি শাপলা সব শোলায় তৈরি। আছে কয়েক ধরনের পাখি। হাতপাখা। বানর, কুমিরও আছে। আছে গরুর গাড়ি। হিন্দু বিয়েতে বর যে টোপর পরেন, সেটিও দেখা গেল স্টলে। শখের হাঁড়ির পাশে বসেই কাজ করছিলেন শোলাশিল্পী শঙ্কর মালাকার। জানালেন, কয়েক পুরুষ ধরে এই কাজ করছেন। জন্মের পর থেকে একটিই কাজ তার। ছেলে রামপ্রসাদও শিখেছেন বাবার কাছে। তিনিও কাজ করছিলেন পাশে বসে। বললেন, বাপ-দাদার পেশা। না করলে চলে না। কাঁসা ও পিতলের সামগ্রী দিয়ে স্টল সাজিয়েছে পুরনো ঢাকার বেচারাম দেওড়ির এক কারিগর। তার স্টলে দেখা গেল বিখ্যাত সিন্ধী কলসি। একসময় গ্রামের গৃহস্থরা ঘি-দুধ-মাখন ইত্যাদি সংরক্ষণ করতে কারুকার্য খচিত এই কলসি ব্যবহার করত। এখানে আরও আছে পিতলের ঘোড়া, ফ্লাওয়ারভাস, হুঁকোসহ নানা ধরনের পণ্য। কারিগরের নাম মুক্তি। জানালেন, বংশ পরম্পরায় তারা এই কাজ করে আসছেন। তবে এখন সময় মন্দ। বললেন, আগের সেই রমরমা অবস্থা আমাদের নেই। এক সময় কত কাজ করতাম! এখন টিকে থাকতে মূলত শোপিস তৈরির কাজ করি। প্রচুর সময় দিতে হয়। কিন্তু লোকে দাম দিতে চান না। মেলার বড় অংশজুড়ে আছে তাঁতের শাড়ি ও জামদানি। নারায়ণগঞ্জের এক কারিগর জানালেন, একটি শাড়ি তৈরিতে এক মাসও লেগে যায়। কিন্তু সে অনুযায়ী মূল্য পাওয়া যায় না। মেলার একাধিক স্টলে আছে লোকজ বাদ্যযন্ত্র। একটি স্টলে শুধু বাঁশি। বাঁশের বাঁশি। তবে নানান জাত। আকারে ছোট-বড়-মাঝারি। মুখ বাঁশি আছে। আছে আঁড় বাঁশি। এলিফ্যান্ট রোডের লাল মিয়া এই বাঁশি তৈরি করেন। নিজেও বেশ বাজান। কথা বলতে বলতেই বড় বাঁশি হাতে নিয়ে সুর তুললেন। কোথায় যেন হারিয়ে গেলেন। বললেন, প্রেম লাগবে। বাঁশি প্রেম ছাড়া বাজে না। তিনি জানান, বিশেষ একসেট বাঁশি তিনি গত চার বছরে গড়েছেন। ৩৭ সেটের বাঁশির দাম ৬৫ হাজার টাকা। এখানেই শেষ নয়। আছে মিষ্টি, মুড়ি-মুড়কিও। সোনারগাঁওয়ের লাঙ্গলবন্দের কারিগররা বড় দুটি স্টল সাজিয়ে বসেছেন। এখানে কদমা, বাতাসা, মোড়ালি, আঙ্গুরী, আমিরতি, উখড়া, নিমকি, নকুল দানা, লাড্ডু কত কী! মেলায় দেখা যাবে পুতুলনাচ। নাগরদোলায়ও চড়া যাবে। সব মিলিয়ে নগরজীবনে গ্রামীণ অনুভূতি। মেলা আগামী রবিবার পর্যন্ত চলবে।
×