ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বাঙালী জাতির ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ২৫ হাজার স্মারক থাকছে

প্রকাশিত: ০৫:৪১, ১৬ এপ্রিল ২০১৭

বাঙালী জাতির ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ২৫ হাজার স্মারক থাকছে

স্টাফ রিপোর্টার ॥ নতুন যাত্রা শুরু করছে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। দীর্ঘ ২১ বছরের সেগুনবাগিচার স্মৃতি রেখে স্থানান্তরিত হচ্ছে শেরে বাংলা নগরের আগারগাঁওয়ে। অস্থায়ী ভবন ছেড়ে ঠাঁই নিচ্ছে স্থায়ী ভবনে। আজ রবিবার মুক্তিযুদ্ধ জাদঘরের এই নতুন ভবনের উদ্বোধন হবে। সকাল সাড়ে ১০টায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নতুন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের উদ্বোধন করবেন। বাঙালী জাতির জন্মের সংগ্রামমুখর ইতিহাস এবং ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির এমন স্মৃতিময় প্রায় ২৫ হাজার স্মারক নিয়ে নতুন করে শুরু হবে জাতির গৌরবগাথার কথা বলা; এ সংগ্রহশালার পথচলা। উদ্বোধনের আগের দিন শনিবার সেগুনবাগিচার মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের প্রজ্বলিত ‘শিখা চির অম্লান’ আগারগাঁওয়ে স্থাপিত নতুন জাদুঘরে স্থানান্তরিত হয়। এদিন ভোরে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ পরিবারের চতুর্থ প্রজন্মের সদস্যরা শিখা চির অম্লান থেকে অগ্নি মশাল জ্বালিয়ে একাত্তর সদস্যবিশিষ্ট অভিযাত্রী দলের হাতে তুলে দেন। অভিযাত্রী দলের নেতৃত্বে ছিলেন পর্বতারোহী নিশাত মজুমদার। তার নেতৃত্বে অভিযাত্রী দলের সঙ্গে ৭১ সাইক্লিস্ট মশালটি বয়ে নিয়ে যান আগারগাঁওয়ের নতুন ভবনে। শনিবার ভোর সাড়ে ৬টায় অগ্নি মশালটির যাত্রা শুরু হয়। এটি ঘুরে আসে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, স্বাধীনতা স্তম্ভ, বঙ্গবন্ধু জাদুঘর, কলেজ গেটের মুক্তিযোদ্ধা টাওয়ারে। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অগ্নি মশালটি পৌঁছলে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর শ্রদ্ধা নিবেদন করে বায়ান্নর ভাষা শহীদদের উদ্দেশে। এতে অংশ নেন প্রবীণ আইনজীবী রফিকুল হক, নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার ও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ। শহীদ মিনারের সংক্ষিপ্ত পর্ব শেষে অগ্নি মশাল নিয়ে অভিযাত্রী দল যায় শাহবাগের ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। সেখানে যোগ দেন সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের নেতারা। ফোরামের চেয়ারম্যান কে এম সফিউল্লাহর নেতৃত্বে এতে যোগ দেন মহাসচিব হারুন হাবীব, সহসভাপতি নুরুল আলম ও আনোয়ারুল আলম, যুগ্ম মহাসচিব মেজর জিয়াউদ্দিন আহমেদ। এক মিনিট নীরবতা পালন করে কে এম সফিউল্লাহ বলেন, এই মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর একাত্তরের প্রতিনিধিত্ব করে। মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যবহার্য দুর্লভসব সংগ্রহ এখানে নতুনভাবে সংযুক্ত হতে যাচ্ছে, যা নতুন প্রজন্মের কাছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে আরও বিস্তৃতাবে তুলে ধরবে। তারা মুক্তিযুদ্ধকে আরও ভালভাবে জানতে পারবে। অভিযাত্রী দল শিখা চির অম্লান নিয়ে যাত্রা করে ধানম-ির বঙ্গবন্ধু জাদুঘরে। সকাল সাড়ে ৮টায় জাতির জনকের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করে অভিযাত্রী দলটি। এ সময় উপস্থিত ছিলেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক। পরে মোহাম্মদপুরের কলেজ গেটে অবস্থিত মুক্তিযোদ্ধা টাওয়ার-১ এ বসবাসরত যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করেন নতুন প্রজন্মের সদস্যরা। এ সময় যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন আট নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধা আতিকুর রহমান, ২ নং সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধা মোঃ তারা মিয়া, মোঃ ফরিদ মিয়া, মোঃ হানিফ সরকার, ৬ নং সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধা জি এম জুলফিকার, ৭ নং সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধা অনিল কুমার রায়, ২ নং সেক্টরের বিশেষ বাহিনীর সদস্য বীরবিক্রম মোঃ গোলাম মোস্তফা। মুক্তিযুদ্ধ টাওয়ার ঘুরে অগ্নি মশাল পৌঁছে যায় আগারগাঁওয়ের নতুন ভবনে। সেখানে একাত্তর মুক্তিযোদ্ধার হাত ধরে শিখা চির অম্লান স্থাপিত হয় নতুন ঠিকানায়। আন্তর্জাতিক ও আধুনিক মানদ-ের ভাবনায় নান্দনিকতার মিশেলে গড়া নতুন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে থাকছে চারটি স্থায়ী ও দুটি অস্থায়ী গ্যালারি এবং সেমিনার কক্ষ। চার স্থায়ী গ্যালারিতে প্রদর্শিত হবে দেড় হাজার স্মারক। আর্কাইভে সংরক্ষিত থাকা বাকি স্মারক পর্যায়ক্রমে প্রদর্শিত হবে একটি অস্থায়ী গ্যালারিতে। অপর আরেকটি অস্থায়ী গ্যালারিতে উপস্থাপিত হবে পৃথিবীর নানা দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস। পাশাপাশি এই গ্যালারিটিতে বিভিন্ন সময় শিল্পকর্ম প্রদর্শনীরও আয়োজন করা হবে। এছাড়া থাকবে ২৫০ আসনের একটি আধুনিক অডিটরিয়াম। যেখানে পরিবেশিত হবে সঙ্গীতানুষ্ঠান, নাটক, আবৃত্তিসহ নানা রকম পারফর্মিং আর্ট। নবনির্মিত এ সংগ্রহশালায় নতুন প্রজন্মের জন্য থাকছে ইন্টার-এ্যাকটিভ স্পেস, যেখানে নতুন মুক্তিযুদ্ধসহ নানা বিষয়ের আলাপ-আলোচনা হবে। দর্শনাথীসহ সকলের জন্য থাকবে কাফেটারিয়া এবং সামনের খালি জায়গায় ওপেন এয়ার থিয়েটার। ২১ হাজার স্কয়ার ফুটের বড় পরিসরের চারটি স্থায়ী গ্যালারিতে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে প্রধান্য দিয়ে ধাপে ধাপে বলা হয়েছে ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত জাতির জন্মলাভের ইতিহাস। স্থায়ী গ্যালারিগুলোর উপস্থাপনে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়েছে আলোকচিত্র। সেই সঙ্গে প্রদর্শিত হবে মুক্তিযোদ্ধার লেখা রণাঙ্গনের ঘটনাপ্রবাহিত ডায়রি, মুক্তিযোদ্ধার লেখা চিঠি, রণাঙ্গনে ব্যবহৃত যুদ্ধাস্ত্র, শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যবহৃত স্মৃতিস্মারক এবং সেই সময়ের পেপার কাটিং ও দালিলিক উপস্থাপনে স্বাধীনতা সংগ্রামের তথ্য। একাত্তরে আমেরিকান স্টেট ডিপার্টমেন্টর ‘১৯৭১ মুক্তিযুদ্ধ’ সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ দলিল-দস্তাবেজ প্রথমবারের মতো প্রদর্শন করা হবে। জাতিসংঘের উদ্বাস্তু বা শরণার্থী সংক্রান্ত কিছু দুর্লভ দলিলও প্রদর্শিত হবে। দেখা যাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ জাতীয় চার নেতার অবয়বময় ব্রোঞ্জ নির্মিত মুর‌্যাল। স্বাধীনতার ঘোষণাবিষয়ক জটিলতা দূর করে অডিওসহ বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তের মাধ্যমে উপস্থাপন করা হবে। এছাড়া থাকছে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন বিশ্ব মিডিয়ায় প্রকাশিত সংবাদের সচিত্র সংগ্রহ। ৩টি বেজমেন্ট ও পাঁচটি ফ্লোরে বিন্যস্ত আড়াই বিঘা জমির ওপর নির্মিত ভবনটির নক্সা করেছেন স্থপতি দম্পতি তানজিম হাসান সেলিম ও নাহিদ ফারজানা। স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মের আগের বাঙালীর ইতিহাস ও ঐতিহ্যের কথা বলবে ‘আওয়ার হেরিটেজ‘ নামের চতুর্থ তলার প্রথম স্থায়ী গ্যালারিটি। দ্বিতীয় গ্যালারিটির নাম দেয়া হয়েছে ‘আওয়ার রাইট’। এই প্রদর্শণালয়ে ছবি এবং তথ্যের ভিত্তিতে সত্তরের সাধারণ নির্বাচনের পর বাঙালীর ওপর নেমে আসা নির্মম নিপীড়ন ও ধ্বংসযজ্ঞের পাশাপাশি তুলে ধরা হবে প্রতিরোধের চিত্র। এখানে সবচেয়ে গুরুত্ব নিয়ে স্থান পেয়েছে অপারেশন সার্চলাইট নামে একাত্তরের ২৫ মার্চের কালরাতের বিভীষিকাময় দৃশ্যপট। তৃতীয় স্থায়ী গ্যালারিটির নাম দেয়া হয়েছে ‘আওয়ার ব্যাটল’। এই গ্যালারিতে উপস্থাপিত হবে ১৯৭১ সালের মে থেকে নবেম্বর মাসের খরস্রোতা সময়। চতুর্থ গ্যালারির নাম রাখা হয়েছে ‘আওয়ার ভিক্টোরি’। এই গ্যালারিতে উপস্থাপিত হবে বাঙালীর চূড়ান্ত বিজয়ের নানা স্মৃতিবিজড়িত উপাখ্যান।
×