ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০২ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১

সীতাকু- অপারেশনে একটি চিরকুটে প্রাপ্ত মোবাইল নম্বর ট্র্যাকিংয়ে জঙ্গী আস্তানা নির্মূলে সফলতা

পাহাড়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে ওরা তৎপরতা চালায় শহরে

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ৩০ মার্চ ২০১৭

পাহাড়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে ওরা তৎপরতা চালায় শহরে

মোয়াজ্জেমুল হক, চট্টগ্রাম অফিস ॥ নব্য জেএমবির শীর্ষ নেতা মাঈনুল ইসলাম ওরফে মুসা সিলেটের আতিয়া মহলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে খতম হয়েছে। তার সেকেন্ড ইন কমান্ড বলে খ্যাত সোহেল রানা ও সাগরের সন্ধানে পুলিশী তৎপরতা চলছে। এদের সঙ্গে প্রশিক্ষিত আত্মঘাতী আরও কিছু জঙ্গী রয়েছে। জঙ্গী সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে সরকার ও জনগণ সচেতন হওয়ায় এরা এখন বিচ্ছিন্নভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি সফিকুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, মুসা শিক্ষিত হলেও প্রকৃতিগতভাবে দুর্ধর্ষ ছিল। নব্য জেএমবিকে সংগঠিত করতে এই মুসা পাহাড়ের বিভিন্ন পয়েন্টে জঙ্গী তৎপরতায় রিক্রুটমেন্টসহ আত্মঘাতী সন্ত্রাসী বানিয়েছে অনেককে। এরাই এখন দেশের বিভিন্ন স্থানে বেপরোয়া তৎপরতা প্রদর্শন করছে। সর্বশেষ সিলেটের মৌলভীবাজার এবং কুমিল্লায় সন্দেহজনক আরও দুটি আস্তানা ঘিরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অবস্থান নিয়েছে। কাউন্টার টেররিজম ইউনিট (সিটিইউ) সূত্রে জানা গেছে, এদের প্রথম ঘাঁটিটি ছিল ঢাকার উত্তরায়। সেখানেই মূলত প্রাথমিক দীক্ষা দেয়া হতো। এরপর প্রশিক্ষণের জন্য পাঠানো হতো মিয়ানমারের সীমান্ত সংলগ্ন নাইক্ষ্যছড়ি ও কক্সবাজারের রামুর দুর্গম পাহাড়ী অঞ্চলে। এরা প্রকৃত নাম গোপন করে ছদ্মনাম নিয়ে চলে। যেমন মুসা তার সাংগঠনিক নাম। প্রকৃত নাম মাঈনুল ইসলাম। তার সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য ইতোমধ্যে প্রকাশ হয়েছে। গোয়েন্দাদের হাতে নব্য জেএমবির শীর্ষ পর্যায়ের দুই নেতা সোহেল রানা ও সাগর এখন টার্গেটে রয়েছে। সিটিইউ সূত্রে জানানো হয়, দেশে জঙ্গীদের ইতোপূর্বেকার ঘটনা এবং নতুনভাবে এর উত্থান নিয়ে নতুন নতুন তথ্য বেরিয়ে আসছে। জঙ্গী সন্ত্রাসে জড়িত জঙ্গীদের গোড়া মূলত এক জায়গায় হলেও এরা ইসলামী ব্যানারের নানা নামে সন্ত্রাসী কর্মকা-ে লিপ্ত। এ পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী জঙ্গীদের প্রশিক্ষণ মূলত পাহাড়ী জঙ্গলাকীর্ণ এলাকাগুলোতে আর অপারেশন চালানো হয় নগর অঞ্চলে। সীতাকু-ের জঙ্গী আস্তানা সাধন কুঠির থেকে গ্রেফতারকৃত জহির ও আরজিনার কাছ থেকে চার টুকরোর একটি চিরকুটের সূত্র ধরেই মূলত সিলেটের আতিয়া ভবনের জঙ্গী আস্তানার সন্ধান মিলেছে বলে পুলিশী সূত্রে জানা গেছে। চিরকুটটিতে একটি মোবাইল নম্বর ছিল। ওই মোবাইল নম্বরটি ট্র্যাকিং করেই মূলত এটির অবস্থান সিলেটের আতিয়া ভবনে বলে নিশ্চিত হওয়ার পর চলে অভিযান। মোবাইলটি মুসার বলেই পুলিশ ধারণা করছে। এ বক্তব্য চট্টগ্রাম রেঞ্জ অফিসের দায়িত্বশীল একটি সূত্রের। উল্লেখ্য, ঢাকার গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারির অভ্যন্তরে জঙ্গীদের উদ্যোগে লোমহর্ষক ঘটনার জন্ম দেয়ার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত বিভিন্ন বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযানে এরা কিছুদিন থমকে ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে আবারও এরা নিজেদের জানান দিচ্ছে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় সন্ত্রাসী তৎপরতার মাধ্যমে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এসব জঙ্গী সন্ত্রাসীদের হাতে প্রাণ হারিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, বুদ্ধিজীবী, বিদেশী নাগরিকসহ অনেকে। হলি আর্টিজান বেকারির ঘটনার পর জঙ্গীদের সৃষ্ট বড় ঘটনার মধ্যে সর্বশেষ সীতাকু-ের দুটি আস্তানা এবং সিলেটের আতিয়া মহলে প্রায় ৫ দিন যে ঘটনার অবতারণা হয়েছে তা নতুন করে সচেতন মহলে উদ্বেগ উৎকণ্ঠার সৃষ্টি করেছে। কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের (সিটিইউ) এক সূত্র জানিয়েছে, মীরসরাই, সীতাকু-ের পাহাড়ী এলাকা এবং বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি ও লামার একাধিক পয়েন্টে জঙ্গীদের অস্ত্র প্রশিক্ষণের পাশাপাশি আত্মঘাতী স্কোয়াড সদস্যদের মনোবল মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার সাহসে বলীয়ান করা হয়। এছাড়া লামার আলীকদম, নাইক্ষ্যংছড়ির বাইশারি, দুছড়িতে জঙ্গীদের প্রশিক্ষণের একাধিক পয়েন্ট রয়েছে। এর পাশাপাশি রামুর ঈদগড় অস্ত্র, গোলাবারুদ ও বিস্ফোরক সরবরাহের একটি রুট হিসাবে চিহ্নিত রয়েছে। সূত্র জানায়, সুইসাইডাল স্কোয়াড সদস্যদের একটি মন্ত্রেই দীক্ষিত করা হয়। তা হচ্ছে ‘অপারেশনের আগে অবস্থান হবে কবরস্থান।’ এ মন্ত্রে দীক্ষিত হয়েই জঙ্গী সন্ত্রাসীরা এ পথে নামে। পাহাড়ী অঞ্চলে প্রশিক্ষণে দক্ষতা অর্জন করলে ওইসব জঙ্গীদের দেশের বিভিন্ন মহানগরে বা আশপাশের ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় বাড়ি ভাড়া নিয়ে আস্তানা গাঁড়ার নির্দেশনা থাকে। সে অনুযায়ী এ পর্যন্ত বড় যে কটি জঙ্গী আস্তানার সন্ধান মিলেছে এতে তারই প্রমাণ মিলছে। দেশের কারা অভ্যন্তরে বর্তমানে জঙ্গী সন্ত্রাসী গ্রুপের বহু সদস্য রয়েছে। এদের কাছ থেকে জিজ্ঞাসাবাদে যে তথ্য বেরিয়ে এসেছে তা অনেকটা একই ধাঁচের। সর্বশেষ নব্য জেএমবির ব্যানারে চট্টগ্রামের সীতাকু- ও সিলেটে আতিয়া ভবনের ঘটনা থেকে অনুরূপ তথ্য বেরিয়ে আসছে। মীরসরাই ও সীতাকু-ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পূর্ব পাশে এমন কিছু এলাকা রয়েছে যেসব স্থানে মানুষের আনাগোনা বলতে একেবারেই নেই। এসব এলাকায় জঙ্গীদের প্রশিক্ষণ ঘাঁটি থাকার কথা বিভিন্নভাবে প্রচার মাধ্যমে এসেছে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত বড় কোন ঘাঁটির সন্ধান মেলেনি। তবে চট্টগ্রামের বাঁশখালীর লটমনি পাহাড়ে জঙ্গীদের বড় একটি আস্তানা ও অস্ত্র প্রশিক্ষণের ঘাঁটির সন্ধান বেরিয়ে এসেছে পুলিশী অভিযানে। হলি আর্টিজান বেকারি ও সিলেটের আতিয়া ভবনের জঙ্গী আস্তানা নির্মূল করতে সামরিক বাহিনীর প্রশিক্ষিত সদস্যদের অংশ নিতে হয়েছে। এরপরও এদের নির্মূল করতে সর্বোচ্চ শক্তি নিয়োগ করতে হয়েছে। সিটিইউ সূত্রে জানানো হয়, এ পর্যন্ত যেসব জঙ্গী আস্তানায় অভিযান পরিচালিত হয়েছে তাতে সর্বাগ্রে সাধারণ মানুষের জানমালের বিষয়টিকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। ফলে সাধারণ মানুষের সহায় সম্পদের ক্ষতি হলেও প্রাণহানির অস্বাভাবিক কোন ঘটনা ঘটেনি। এছাড়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যেসব সদস্য প্রাণ হারিয়েছে তা ভিন্ন ঘটনা। জঙ্গীদের বোমা, গ্রেনেড নিষ্ক্রিয় করতে গিয়ে কেউ কেউ প্রাণ হারিয়েছেন। তবে দুয়েকটি ক্ষেত্রে ভিন্ন তথ্যও রয়েছে। সরকারী ভাষ্যে ও ধরনের কোন তথ্য আসেনি। যাই হোক, এ পর্যন্ত যেখানেই জঙ্গী আস্তানার সন্ধান মিলেছে, সেখানেই অভিযান সফল হয়েছে। এছাড়া কুমিল্লা, মীরসরাই, ঢাকার বিমানবন্দর সন্নিকটস্থ গোল চত্বরে আত্মঘাতীরা বোমার বিস্ফোরণে মৃত্যু হয়েছে বলে এ পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী তাই নিশ্চিত করা হয়েছে। সূত্র মতে, পাহাড়ের বিভিন্ন এলাকায় বিশেষ করে মিয়ানমার সংলগ্ন সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্টে সে দেশের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের তৎপরতা রয়েছে। এদের সঙ্গে দেশীয় জঙ্গীরা সম্পৃক্ত হয়ে গোলাবারুদ, অস্ত্র সংগ্রহের পাশাপাশি প্রশিক্ষণও নিচ্ছে বলে গোয়েন্দা রিপোর্ট রয়েছে। অরণ্যঘেরা এসব পাহাড়ী এলাকায় পাহাড়ীদের পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে অপেক্ষাকৃত দরিদ্র শ্রেণীর লোকজন বসতি গড়ে তুলছে এবং তা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। এদের একটি অংশকে জঙ্গী সন্ত্রাসে প্রলুব্ধ করা হচ্ছে অর্থের বিনিময়ে। এছাড়া ধর্মের দোহাইতো রয়েছেই। সীতাকু-ের সাধনকুঠির থেকে হাতেনাতে ধৃত জঙ্গীদম্পতি জহিরুল ও আরজিনার বসতি নাইক্ষ্যংছড়ির বাইশারিতে। অনুরূপভাবে সিলেটের আতিয়া ভবনে যে জঙ্গী মহিলার লাশ মিলেছে তার নাম মরজিনা বলেই অনেকটা নিশ্চিত। এই মরজিনা সীতাকু-ে গ্রেফতারকৃত আরজিনার বোন বলেও জানা গেছে। পাহাড় অঞ্চলে গড়ে ওঠা বাঙালী জনঅধ্যুষিত এলাকাগুলোতে ইসলামী ব্যানারের বিভিন্ন জঙ্গী সংগঠনের সদস্যদের আনাগোনা ব্যাপক। দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত সদস্যদের তৎপরতা এসব এলাকায় তত জোরালো নয়। এছাড়া ঝুঁকিপূর্ণও বটে। জিজ্ঞাসাবাদ চলছে জঙ্গী জহির ও আরজিনার ॥ সীতাকু-ের আমিরাবাদের সাধন কুঠির থেকে গ্রেফতারকৃত জঙ্গীদম্পতি জহিরুল ও আরজিনা (ছদ্মনাম) কে মঙ্গলবার নতুন করে আরও ৫ দিনের রিমান্ডে আনার পর দ্বিতীয় দিন বুধবার জিজ্ঞাসাবাদ অব্যাহত রয়েছে। ইতোপূর্বে তাদের সন্ত্রাস দমন, হত্যা, বিস্ফোরক আইনে ১২ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। রিমান্ড শেষ হওয়ার পর মঙ্গলবার সীতাকু- পুলিশ আবারও ১৫ দিনের রিমান্ড প্রার্থনা করলে চট্টগ্রামের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট শিবলু কুমার দে’র আদালত ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
×