ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

রাজনৈতিক ইন্ধন, জামায়াত কানেকশন খতিয়ে দেখছে গোয়েন্দা সংস্থা

আত্মঘাতী জঙ্গী তৎপরতা পূর্ব পরিকল্পিত নীলনক্সা

প্রকাশিত: ০৫:১৩, ২০ মার্চ ২০১৭

আত্মঘাতী জঙ্গী তৎপরতা পূর্ব পরিকল্পিত নীলনক্সা

শংকর কুমার দে ॥ আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে আওয়ামী লীগ যাতে ক্ষমতায় আসতে না পারে সেজন্য জঙ্গীদের আত্মঘাতী বিস্ফোরণ ঘটানোর ঘটনা পূর্বপরিকল্পিত ‘নীল নকশা’ বলে গোয়েন্দা সংস্থার দাবি। ফাঁসির আসামি হুজিপ্রধান মুফতি হান্নানকে ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টার ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি ঢাকা, চট্টগ্রামে যেসব আত্মঘাতী জঙ্গী হামলা হয়েছে তার নেপথ্যে রাজনৈতিক ইন্ধন, নির্বাচন ইস্যু, যুদ্ধাপরাধীর বিচারের প্রতিশোধ, জামায়াত-শিবির তৎপরতার যোগসূত্র থাকার বিষয়গুলো খতিয়ে দেখছে গোয়েন্দা সংস্থা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর নজরদারি ও তৎপরতার মুখে জঙ্গী সংগঠনগুলো সংগঠিত করতে না পেরে ধর্মের অপব্যাখ্যার মাধ্যমে মগজধোলাই করে যুবক শ্রেণীর আবেগকে পুঁজি করে আত্মঘাতী জঙ্গী তৈরি করা হচ্ছে। সারাদেশে গত এক সপ্তাহে জঙ্গীবিরোধী অভিযানে জঙ্গী সম্পৃক্ততার অভিযোগে অর্ধশতাধিক জনকে গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদ করে ও অনুসন্ধান করে এ ধরনের তথ্য পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট ও গোয়েন্দা সংস্থা। গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মকর্তা বলেন, হঠাৎ জঙ্গীদের আত্মঘাতী হামলার কারণ কী, মদদদাতা কারা, প্রশিক্ষণ নিচ্ছে কোথায়, তাদের মগজধোলাই করছে কারা, অর্থ ও বিস্ফোরক দিচ্ছে কারা, কোথায় পরিকল্পনা করে, বিদেশী জঙ্গীদের সঙ্গে এদের যোগসাজশ আছে কি-না, ইন্টারনেটে নানামুখী যোগাযোগ হচ্ছে কিভাবে, আত্মঘাতী স্কোয়াডের পরবর্তী টার্গেট কী? তারা কখন কোথায় হামলা করবে, আত্মঘাতীদের টার্গেট কারা? ভার্চুয়াল জগৎ নিয়ন্ত্রণে সরকারের ভূমিকা কেমন, আত্মঘাতী জঙ্গী প্রতিরোধে সরকারের ভাবনা কীÑ এসব প্রশ্নকে সামনে রেখেই গ্রেফতারকৃত জঙ্গীদের জিজ্ঞাসাবাদ, তদন্ত ও অনুসন্ধান করা হচ্ছে। আত্মঘাতী জঙ্গী হামলার পর নতুন করে এসব বিষয় এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসার পর তদন্ত করা হচ্ছে। অতীতের নাশকতার ঘটনার তদন্তের ধারাবাহিকতায় দেখা গেছে, এসব ঘটনার পেছনে রাজনৈতিক শক্তির ইন্ধন থাকার কারণেই দেশে ভয়ভীতি, আতঙ্ক, উদ্বেগ ছড়ানো হচ্ছে। নতুবা হঠাৎ এমন কী পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো যে, মাত্র দশ দিনের ব্যবধানে চলতি মাসে ফাঁসির আসামি মুফতি হান্নানকে ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা, কুমিল্লায় পুলিশের ওপর আক্রমণ করতে গিয়ে দুই জঙ্গী গ্রেফতার, সীতাকু-ের এক জঙ্গী আস্তানায় জঙ্গী দম্পতি গ্রেফতার, আরেক জঙ্গী আস্তানায় আত্মঘাতী চার জঙ্গী ও এক শিশু নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে? এসব ঘটনার রেশ না কাটতেই একই সঙ্গে রাজধানীর আশকোনায় র‌্যাব সদর দফতরে আত্মঘাতী জঙ্গী হামলা, এ আত্মঘাতী হামলার ষোলো ঘণ্টার মধ্যেই আবার খিলগাঁও র‌্যাব চেকপোস্টে আত্মঘাতী জঙ্গী হামলার চেষ্টা করা হয়। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, যেহেতু দেড় বছর পর জাতীয় সংসদ নির্বাচন, তাই জঙ্গী হামলা আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য অন্তরায়। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার মোঃ আছাদুজ্জামান মিয়া বলেছেন, সম্প্রতি ঘটে যাওয়া জঙ্গী হামলার ঘটনাগুলোর পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য রয়েছে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও ডিএমপি কমিশনারের একই দিনে এ ধরনের বক্তৃতায় হঠাৎ করে নতুনভাবে আত্মঘাতী জঙ্গী হামলার ঘটনার পেছনের অন্তর্নিহিত কারণগুলো সামনে চলে আসে। গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মকর্তা বলেন, আজ থেকে ১৬ বছর আগে ২০০১ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সারাদেশে এমনভাবে বোমাবাজি ও গ্রেনেড হামলা শুরু হয়, যার টার্গেট ছিল আওয়ামী লীগ ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি এবং নির্বাচনে পরাজিত হয় আওয়ামী লীগ। পরাজিত হওয়ার পরও আওয়ামী লীগ ও তার দলনেত্রী তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে তার মন্ত্রী, এমপি, মেয়র ও দলের নেতাদের আক্রমণ করেছে জঙ্গীগোষ্ঠী। আবার ২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধীর বিচার ও বিচারের রায় বাস্তবায়নকে কেন্দ্র করে সারাদেশে রক্তক্ষয়ী সহিংস সন্ত্রাসের তা-বলীলা চালায় জামায়াত-শিবির। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় বাস্তবায়নের কারণে জামায়াত-শিবিরের মদদে দেশে ব্লগার, প্রগতিশীল লেখক, প্রকাশকদের নির্মমভাবে হত্যা শুরু করে জঙ্গীগোষ্ঠী আনসারুল্লাহ বাংলা টিম ও আনসার আল ইসলাম। এ জঙ্গীগোষ্ঠীর হামলার পর আবার দায় স্বীকার করেছে ইসলামিক স্টেটের (আইএস) মুখপত্র আমাকের বরাত দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সাইট ইন্টেলিজেন্স গ্রুপ। এসব ঘটনা দেখা যাচ্ছে একই সূত্রে গাঁথা। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে ২০১৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সারাদেশে পেট্রোলবোমা হামলার ঘটনা। অতীতের জঙ্গী হামলা, সহিংস সন্ত্রাস, যুদ্ধাপরাধীর বিচারের প্রতিশোধ ইত্যাদির ধারাবাহিকতায় দেখা যাচ্ছে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে এখন থেকেই জঙ্গী হামলা, আত্মঘাতী বিস্ফোরণ ঘটানোর মাধ্যমে পূর্বপরিকল্পিত নীল নকশার বাস্তবায়ন ঘটানোর প্রক্রিয়া চলছে মাত্র। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের একজন কর্মকর্তা বলেন, চট্টগ্রামের ঘটে যাওয়া আত্মঘাতী জঙ্গী হামলা, জঙ্গী দম্পতি গ্রেফতার, কুমিল্লায় গ্রেফতার হওয়া দুই জঙ্গীর ঘটনা তদন্ত করে দেখা গেছে, জঙ্গীরা আত্মীয়তা, পাহাড়ী ও পার্বত্য এলাকাকে বেছে নিয়েছে। জঙ্গীরা প্রশিক্ষণ নেয়ার জন্য ধীরে ধীরে পাহাড়ী ও পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় জড়ো হচ্ছে। এমনকি তারা মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীদেরও দলে ভিড়িয়ে হামলায় ব্যবহারের চেষ্টা করছে। গত বছরের ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজানে জঙ্গী হামলার পর থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর নজরদারি, জঙ্গীবিরোধী অভিযানের কারণে জঙ্গীরা নিহত, গ্রেফতার হয়ে তারা এখন কোণঠাসা। জঙ্গী নেটওয়ার্ক দুর্বল হয়ে পড়েছে। গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মকর্তা জানান, জঙ্গীদের মদদদাতা শক্তি মরণ কামড় দিয়েছে। জঙ্গীরা নিজেদের অস্বিত্ব রক্ষায় মরিয়া হয়ে উঠেছে। এখন তারা বিভিন্ন হামলার মধ্য দিয়ে তাদের শক্তিমত্তা জানান দিতে চাইছে। ইন্টারনেটের নানামুখী যোগাযোগ যা ভার্চুয়াল বা ভিডিও থেকে দেশীয় জঙ্গীদের আত্মঘাতী হামলায় উদ্বুদ্ধ করানো হচ্ছে। আত্মঘাতী হামলায় উদ্বুদ্ধ জঙ্গীদের বিষয়ে নিবিড় গোয়েন্দা অনুসন্ধান চালানো হচ্ছে। দেশীয় পলাতক মাঠপর্যায়ের জঙ্গীদের সমন্বয়ক হিসেবে কারা কাজ করছে এমন তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। সারাদেশে জঙ্গীদের তৎপরতার বিষয়ে আগাম তথ্য সংগ্রহ ও জনগণকে সচেতন করার কর্মসূচী নেয়া হচ্ছে। হঠাৎ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা জঙ্গীদের নেটওয়ার্ক ভেঙ্গে দিতে মাঠপর্যায়ে র‌্যাব, পুলিশ, কাউন্টার টেররিজম ইউনিট, গোয়েন্দা সংস্থা কাজ করছে।
×