ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

যমুনার ভাঙ্গনরক্ষা বাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ

প্রকাশিত: ০৪:৩১, ১৯ মার্চ ২০১৭

যমুনার ভাঙ্গনরক্ষা বাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ

নিজস্ব সংবাদদাতা, পাবনা, ১৮ মার্চ ॥ বেড়ায় রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে প্রায় ৩৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত যমুনা নদীর স্থায়ী ভাঙ্গনরোধ প্রতিরক্ষা বাঁধের প্রায় তিন কিলোমিটার এলাকা মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। প্রতিরক্ষা বাঁধের টপ কয়েক জায়গায় ৩-৪ ফুট করে দেবে গেছে। প্রতিরক্ষা বাঁধের কোলঘেঁষে যমুনা নদী থেকে বালু উত্তোলন, সিসি ব্লক চুরি ও ধসে যাওয়ায় বাঁধের মাটি বের হয়ে গেছে। ফলে আগামী বর্ষা মৌসুমে প্রচ- ঘূর্ণয়মান স্রোতের টানে ও ঢেউয়ের আঘাতে এসব স্থানে মারাত্মক ভাঙ্গন দেখা দেবে বলে নদীপাড়ের বাসিন্দারা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন। সরেজিমন দেখা গেছে, বেড়ার মোহনগঞ্জ এলাকায় তিনটি পয়েন্টে নদী ভাঙ্গন প্রতিরক্ষা বাঁধের টপ ৮ ফুট দৈর্ঘ্যে ২ থেকে ৩ ফুট করে ধসে গেছে। সিসি ব্লক আলগা হয়ে পড়েছে। মোহনগঞ্জের ভাটিতে মালদাহপাড়ায় দুটি পয়েন্টে ১০ ফুট দৈর্ঘ্যে ৫ থেকে ৬ ফুট পর্যন্ত বাঁধের টপ দেবে গেছে। এর সামান্য দূরে বাঁধের টপ থেকে সেøাপের নিচ পর্যন্ত প্রায় ৫০ ফুট এলাকাজুড়ে ব্লক চুরি হয়ে যাওয়ায় মাটি বেরিয়ে পড়েছে। প্রতিরক্ষা বাঁধের নিচে নদীতে ফেলা সাপোর্টিং ব্লক অনেক জায়গা থেকে চুরি হয়ে গেছে। মোহনগঞ্জ ও মালদাহপাড়ায় প্রতিরক্ষা বাঁধের সঙ্গে লাগানো দুটি ইটভাঁটির লোড ট্রাক চলাচল করছে। ট্রাকের ঝাঁকুনিতে প্রতিরক্ষা বাঁধের সিসি ব্লক ধসে পড়ছে। নাকালিয়া বাজার পয়েন্টে সিসি ব্লক ধসে গেছে। এছাড়া মোহনগঞ্জ থেকে কৈটোলা পর্যন্ত প্রতিরক্ষা বাঁধের কোলঘেঁষে বিভিন্ন পয়েন্টে ১৫টি বোমা মেশিনের (দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি ড্রেজার) সাহায্যে যমুনা নদী থেকে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। নদীর যে স্থান থেকে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে তার চারপাশের এলাকা ধসে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ফলে প্রতিরক্ষা বাঁধটি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। বর্ষা মৌসুমে যমুনা নদীর মূল ধারাটি সরাসরি মোহনগঞ্জ ও মালদাহপাড়ায় আঘাত করে। আগামী বর্ষা মৌসুমের আগে প্রতিরক্ষা বাঁধের ক্ষতিগ্রস্ত পয়েন্টগুলো সংস্কার না করা হলে স্রোতের টানে ও ঢেউয়ের আঘাতে বাঁধটি ভেঙ্গে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে এলাকাবাসী জানিয়েছেন। জানা যায়, ১৯৯৭ সালে বেড়া মোহনগঞ্জ থেকে কাজীরহাট পর্যন্ত ২৫ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে যমুনা নদীতে ভয়াবহ ভাঙ্গন শুরু হয়। সহস্রাধিক বসতভিটা, ফসলি জমি, হাট-বাজার, স্কুল, মাদ্রাসা, মসজিদ, মন্দির নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। ওই বছরের ২৭ এপ্রিল নাকালিয়ায় পাবনা সেচ ও পল্লী উন্নয়ন প্রকল্পের বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ যমুনা নদীতে ভেঙ্গে প্রকল্প অভ্যন্তরে পানি প্রবেশ করে। পানির প্রচ- স্রোতের টানে প্রকল্প অভ্যন্তরে দুই যুগ ধরে গড়ে ওঠা গ্রামীণ অবকাঠামো ৮টি ব্রিজ-কালভাটর্, কাঁচা-পাকা সড়ক, প্রায় ৫ হাজার একর জমির উঠতি ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। পানির তোড়ে ১২টি বাড়িঘর ভেসে যায়। তৎকালীন জেলা প্রশাসকের প্রতিবেদনে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ২০০ কোটি টাকা বলে উল্লেখ করা হয়। পানি উন্নয়ন বোর্ডের ২০০০ সালের এক জরিপ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, পাবনার বেড়ায় গত ৪০ বছরের অব্যাহত নদী ভাঙ্গনে যমুনা ১০ কিলোমিটার পশ্চিমে সরে এসেছে। এ সময়ে যমুনার ভাঙ্গনে ৭২টি গ্রাম, ১০ হাজার একর ফসলি জমি, ১২টি হাট-বাজার, ৩৫টি স্কুল-মাদ্রাসা, ১৫টি মসজিদ-মন্দির, অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাসহ হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। নদী ভাঙ্গনে প্রায় ৩০ হাজার মানুষ গৃহহীন হয়েছেন। এর মধ্যে প্রায় ১০ হাজার মানুষ অন্য এলাকায় বাড়ি করেছেন, সহায়-সম্বল হারিয়ে ১৫ হাজার মানুষ বন্যা নিয়ন্ত্রন বাঁধে আশ্রয় নিয়েছেন। নদী ভাঙ্গনে ভূমিহীন হয়ে ৫ হাজার মানুষ শহরে বস্তিবাসী হয়েছে। ওই প্রতিবেদনে যমুনা নদীর স্থায়ী ভাঙ্গন রোধের সুপারিশ করা হয়। এ আলোকে তৎকালীন সরকার বেড়ার মোহনগঞ্জ থেকে কৈটোলা পর্যন্ত প্রায় ১৩ কিলোমিটার যমুনা নদীর পশ্চিম তীর স্থায়ী ভাঙ্গন রোধ প্রকল্প হাতে নেয়। পানি উন্নয়ন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় তৎকালীন সরকার প্রায় ৩৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে যমুনা-মেঘনা রিভার ইরোশন মিটিগেশন প্রকল্পের আওতায় যমুনা নদীর সবচেয়ে বেশি ভাঙ্গনপ্রবণ পাবনার বেড়া উপজেলার মোহনগঞ্জ থেকে রাকশা পর্যন্ত ১৩ কিলোমিটার এলাকাব্যাপী স্থায়ী ভাঙ্গন রোধ প্রকল্পের কাজ ২০০৪ সালে শুরু হয়ে ২০০৮ সালে শেষ হয়। প্রায় ১৩ কিলোমিটার যমুনা নদীর পশ্চিম পাড়ে (ডান তীর) প্রতিরক্ষা বাঁধ তৈরি করা হয়। প্রতিরক্ষা বাঁধ নির্মাণের ফলে মোহনগঞ্জ থেকে রাকশা পর্যন্ত যমুনা নদীর ভাঙ্গন বন্ধ হয়ে যায়। নদীর পশ্চিম পাড়ে চর জেগে উঠতে থাকে। এ কাজে প্রচলিত পদ্ধতি অনুসরণ না করে গ্লোবাল পজিশনিং (জিপিএস) পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়। সফলভাবে গ্লোবাল পজিশনিং (জিপিএস) পদ্ধতি প্রয়োগ করে স্থায়ী ভাঙ্গন রোধ প্রতিরক্ষা বাঁধ নির্মাণ করায় গত ১০ বছর বেড়াবাসী যমুনা নদী ভাঙ্গনের তা-বলীলা থেকে রক্ষা পেয়েছে। এর ফলে প্রায় ৭০০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত পাবনা সেচ ও পল্লী উন্নয়ন প্রকল্পের বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ, কৈটোলা পাম্পিং স্টেশনসহ ৩০টি গ্রাম ভাঙ্গনের কবল থেকে রক্ষা পেয়েছে। এতে যমুনা নদীতীরবর্তী এলাকাবাসীর মাঝে স্বস্তি ফিরে এসেছিল। কিন্তু প্রতিরক্ষা বাঁধ সংস্কার না করা, সিসি ব্লক চুরিসহ যমুনা নদীর পাড়ঘেঁষে অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলনের ফলে যমুনা নদীতীরবর্তী ৫টি গ্রামে আবারও ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। পানি উন্নয়ন বিভাগের কৈটোলা নির্মাণ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী আহসান হাবীব জানিয়েছেন, প্রতিরক্ষা বাঁধের ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা সার্ভে করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে টাকা বরাদ্দ পাওয়া যায়নি। আগামী অর্থবছরে টাকা বরাদ্দ পাওয়া গেলে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোয় সংস্কারকাজ করা হবে। এলাকার মানুষের মধ্যে গণসচেতনতা সৃষ্টি ছাড়া ব্লক-জিওব্যাগ চুরি ও প্রতিরক্ষা বাঁধের ক্ষতিসাধন ঠেকানো সম্ভব নয় বলে তিনি জানান।
×