ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সংসদে সমাপনী বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী

গণতন্ত্র আছে বলেই দেশের এত উন্নয়ন

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ১০ মার্চ ২০১৭

গণতন্ত্র আছে বলেই দেশের এত উন্নয়ন

সংসদ রিপোর্টার ॥ সর্বসম্মতিক্রমে জাতীয় সংসদে রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর আনীত ধন্যবাদ প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। সমাপনী বক্তব্যে অংশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা সমালোচকদের উদ্দেশ করে বলেছেন, দেশে গণতন্ত্র এবং গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা আছে বলেই দেশের এত উন্নয়ন হচ্ছে। অনেকে বলেন-শুধু উন্নয়ন করলে হবে না, গণতন্ত্র থাকতে হবে। দেশে এত উন্নয়ন ও অগ্রগতির পরও যারা কিছুই দেখতে পান না তারা আসলে কী চায়? কাদের মুখে আমরা গণতন্ত্রের কথা শুনি? যাদের মার্শাল ’ল বা অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী সামরিক স্বৈরাচার আসলে তাদের পদলেহন করতে ভাল লাগে, পতাকা ও মন্ত্রী হতে পারে, তারাই অবৈধ ক্ষমতা দখলকার থাকলে গণতান্ত্রিক পরিবেশ দেখতে পায়। যদি দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ নাই-ই থাকে তবে সরকারের এত সমালোচনা তারা করেন কীভাবে? বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদ অধিবেশনে প্রথমে স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর ধন্যবাদ প্রস্তাবের সমাপনী বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। সমাপনী দিনে আরও আলোচনায় অংশ নেন চীফ হুইপ আ স ম ফিরোজ ও সাবেক ডেপুটি স্পীকার কর্নেল (অব) শওকত আলী খান। আলোচনা শেষে স্পীকার প্রস্তাবটি ভোটে দিলে তা সর্বসম্মতিক্রমে কণ্ঠভোটে পাস হয়। এর পর স্পীকার সংসদের অধিবেশন আগামীকাল শনিবার বেলা ৩টা পর্যন্ত মুলতবি ঘোষণা করেন। দারিদ্র্য বিমোচন নিয়ে গ্রামীণ ব্যাংক, ব্র্যাকসহ অন্যান্য এনজিওর দাবি নাকচ করে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ক্ষুদ্র ঋণ নয়, দেশে দ্রুত গতিতে দারিদ্র্য বিমোচন হচ্ছে সরকারের গৃহীত ১৪২টি সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচী বাস্তবায়নের ফলে। একটি ব্যাংকসহ প্রায় আড়াই হাজার এনজিও আছে, তারা ক্ষুদ্র ঋণ দিয়ে দেশে কতভাগ দারিদ্র্য বিমোচন করেছে? তারা ক্ষুদ্র ঋণ দিয়ে দারিদ্র্য বিমোচন করেছে নাকি যারা এর ব্যবসা করেন তারাই ধনশালী ও সম্পদশালী হয়েছে; এ বিষয়ে গবেষণা করা দরকার। প্রধানমন্ত্রী এ প্রসঙ্গে বলেন, গ্রামীণ ব্যাংক ও ব্র্যাক নাকি প্রতিবছর এক ভাগ হারে দারিদ্র্যতা কমাচ্ছে! গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা হয়েছে ’৮৫ সালে, আর ব্র্যাক প্রতিষ্ঠা হয়েছে ৮২ সালে। এ দুটি সংস্থা যদি দুই ভাগ হারে বছরে দারিদ্র্য দূর করে থাকে তা হলে এই ৪৫ বছরে দেশে তো দারিদ্র্যতাই থাকা উচিত নয়। দেশ অনেক আগেই একেবারে দারিদ্র্যশূন্য হয়ে যাওয়া উচিত। তবে গেল না কেন? দেশে কোন্ সরকারের আমলে কত হারে দারিদ্র্য হ্রাস পেয়েছে তা নিয়ে গবেষণার আহ্বান জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে যত দ্রুত দারিদ্র্য হ্রাস পেয়েছে, অতীতের কোন সরকার তা পারেনি। ’৯৬ সালে আমরা যখন ক্ষমতা গ্রহণ করি তখন দেশের দারিদ্র্যতা ছিল ৫৭ ভাগ। এখন আমরা দারিদ্র্যতা ১২ ভাগে নেমে এনেছি। তিনি বলেন, আমরা একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের মাধ্যমে ক্ষুদ্র ঋণ নয়, ক্ষুদ্র সঞ্চয়ের ব্যবস্থা করেছি। এখান থেকে ঋণ নিয়ে কাউকে সুদের জন্য বাড়ি-ঘর, গরু বেচতে হয় না। আমাদের দৃঢ় পদক্ষেপের ফলেই এই ৮ বছরে দেশের ৫ লাখ মানুষ নি¤œ আয় থেকে মধ্যম আয়ে উঠে এসেছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশকে আর হাত পেতে বা ভিক্ষা নিয়ে চলতে হয় না। আমরা প্রায় ৯০ ভাগ প্রকল্প বাস্তবায়ন করি নিজেদের অর্থায়নে। পদ্মা সেতুতেও আমরা তা প্রমাণ করেছি। তাই যে যত কথাই বলুক না কেন, এনজিওগুলোর একভাগ হারে দারিদ্র্য হ্রাসের অস্বাভাবিক দাবি মানলে তো দেশে দারিদ্র্যতাই থাকে না। বাস্তবতা হচ্ছে, দেশে দ্রুত দারিদ্র্যতা কমেছে সরকারের গৃহীত সামাজিক নিরাপত্তামূলক পদক্ষেপ বাস্তবায়নের মাধ্যমে। আমরা ১৪২টি কর্মসূচী বাস্তবায়ন করছি দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য। তিনি বলেন, দেশে খাদ্য ঘাটতি রেখে হাড্ডিসার, কঙ্কালসার মানুষকে দেখিয়ে বিদেশ থেকে ভিক্ষা এনে নিজেদের পকেট ভারি করার সুযোগ ক্রমেই সংকুচিত হয়ে আসছে- এটাই যেন অনেকের ভাল লাগছে না। কারণ, এরা দেশের ও দেশের মানুষের উন্নয়ন ও কল্যাণ হোক তা চায় না। সমালোচনাকারীদের উদ্দেশ করে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, দেশের কিছু মানুষ আছে যারা উন্নয়ন দেখলেই সমালোচনা করে। যারা গণতন্ত্রের কথা বলেন তাদের জরুরী অবস্থা কিংবা সামরিক স্বৈরাচার যখন আসে তখন তাদের কাছে খুব গণতান্ত্রিক মনে হয়। তাদের সঙ্গে একেবারে বিগলিত প্রাণ হয়ে পদলেহন করতে শুরু করে। কারণ একটা অস্বাভাবিক ক্ষমতা আসলেই ওনাদের একটু গুরুত্ব বাড়ে। তিনি বলেন, যদি ক্ষমতায় যাওয়ার উনাদের এতই আকাক্সক্ষা তাহলে তাদের রাজনীতি করলেই হয়। জনগণের কাছে গেলেই হয়। ভোটে নির্বাচিত হয়ে তারা সংসদে আসুক। প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, বাংলাদেশে কোন প্রাইভেট টেলিভিশন চ্যানেল ছিল না। আমরাই প্রথম বেসরকারী খাতে প্রাইভেট টেলিভিশন উন্মুক্ত করে দিয়েছি বলেই তারা (সমালোচক) এত কথা বলার সুযোগ পাচ্ছেন। তারা কিন্তু উন্নয়ন চান না, গণতন্ত্র চান না। দেশে গণতন্ত্র আছে বলেই তো উন্নয়ন হচ্ছে। আজকে আমরা গণতন্ত্রের মধ্য দিয়ে সরকার পরিচালনা করছি বলেই তো দেশের উন্নয়নটা হচ্ছে। আমাদের পূর্বে ২১ বছর যারা ক্ষমতায় ছিল, তাদের আমলে এত উন্নয়ন হয়নি কেন? সেটাই আমার প্রশ্ন। সমালোচনা করতে হলে এই প্রশ্নের জবাব দিতে হবে। তিনি বলেন, আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে প্রতিটি কর্মকা-ে জনগণকে সম্পৃক্ত করি; যা কিছু করি জনগণের স্বার্থে, জনগণের কল্যাণে, জনগণের ভাগ্য পরিবর্তনে; নিজের ভাগ্য পরিবর্তনের কথা চিন্তা করি না। নিজের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য করি না। এই পতাকা পেলাম কি পেলাম না সেটা নিয়ে আমার কোন মাথা ব্যথা নেই। তা যদি থাকত তবে ২০০১ সালে যখন আমাকে বলা হলো, আমার গ্যাস বিক্রি করতে হবে? আমি রাজি হইনি। বিএনপি নেত্রী গ্যাস বিক্রির মুচলেকা দিয়ে ক্ষমতায় এসেও গ্যাস কিন্তু বিক্রি করতে পারেননি। তিনি বলেন, আমার রাজনীতিই হচ্ছে জনগণের কল্যাণে, দেশের উন্নয়নে। সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে সরকারের জিরো টলারেন্স নীতির কথা পুনর্ব্যক্ত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ইসলাম শান্তির ধর্ম। ইসলাম ধর্ম মানুষ হত্যার প্রশ্রয় বা সমর্থন করে না। কিন্তু দুর্ভাগ্য হচ্ছে, ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া অনেক উচ্চবিত্ত ঘরের সন্ত্রানও জঙ্গীবাদের পথে পা বাড়াচ্ছে। কিন্তু আমাদের অবস্থান পরিষ্কারÑ আমরা কোন জঙ্গীবাদ-সন্ত্রাসবাদকে প্রশ্রয় দেব না। যে কোন উপায়ে আমরা এসব দমন করবই। তিনি এ সময় ছেলেমেয়েরা যাতে বিপথে না যায়, জঙ্গীবাদের সর্বনাশা পথে পা না বাড়ায় সেজন্য অভিভাবকসহ দেশবাসীকে সজাগ ও সতর্ক থাকার আহ্বান জানান। রামপাল বিদ্যুত কেন্দ্র নিয়ে বিরোধী দলের নেতার বক্তব্যের জবাব দিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, পরমাণু বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ করা অত সহজ কাজ নয়। অত্যন্ত আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে এটি নির্মাণ করা হচ্ছে। এটা নিয়ে কোন দুশ্চিন্তার কিছু নেই। আর রামপালে যে বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে তার থেকে সুন্দরবন ১৪ কিলোমিটার দূরে। সুন্দরবনে নয়, বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ হচ্ছে রামপালে। আর এটি হচ্ছে সুপার ক্রিটিক্যাল পাওয়ার প্লান্ট। বিদ্যুত কেন্দ্রের ধোঁয়া কোনভাবেই সুন্দরবনের দিকে যাবে না। আর এই প্রকল্প এলাকায় ৫ লাখ বৃক্ষ লাগানো হবে, ইতোমধ্যে দেড় লাখ গাছ লাগানো হয়ে গেছে। এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশের কিছু লোক আছে কোন কিছু করতে গেলেই বাধা দেয়। জার্মানির মিউনিখ শহরের মধ্যে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্র আছে। সেখানে কী পরিবেশে ক্ষতি হয়েছে? দিনাজপুরেও কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্র রয়েছে। সেখানে কী পরিবেশ নষ্ট হয়েছে? সেখানে কী ধান চাষ হচ্ছে না? গাছপালা কিংবা মানুষের জীবনযাত্রা স্বাভাবিক নেই? আসলে মানুষকে বিভ্রান্ত করা এবং উন্নয়ন কাজে বাধা দেয়াই কিছু মানুষের চরিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রধানমন্ত্রী দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবেই। আমাদের দেশের প্রবৃদ্ধি ৭ ভাগের ওপর উঠে গেছে। এটা দেখে বিশ্বের অনেক নেতাই বিস্ময় প্রকাশ করে উন্নয়নের ম্যাজিক জানতে চান। আমি তাদের বলেছি, কোন ম্যাজিক নয়, জনগণের কল্যাণে ও তাদের ভাগ্য পরিবর্তনে আন্তরিকতা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি বলেই দেশের এত উন্নয়ন হচ্ছে। ইনশাল্লাহ! ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে এবং ২০৪১ সালের মধ্যে বিশ্বের মধ্যে উন্নত-সমৃদ্ধ বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা হিসেবে আমরা বাংলাদেশকে গড়ে তুলবই।
×