ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০২ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১

হারিয়ে যাচ্ছে কাঠঠোকরা

‘রাজমুকুট’ পরা দৃষ্টিনন্দন পাখিটি আর আগের মতো দেখা যায় না

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ৭ মার্চ ২০১৭

‘রাজমুকুট’ পরা দৃষ্টিনন্দন পাখিটি আর আগের মতো দেখা যায় না

এইচএম এরশাদ ॥ বাতাসি-কানকাটা, মেইট্টা হুন্দুরা, শালিক বা ভাউত্তা, কাক-কোকিল, চড়ুই বা পিঁয়াজ্জা, ধেউচ্চা, পাতিহাঁসসহ নানা পাখির কলতানে জীববৈচিত্র্যসমৃদ্ধ কক্সবাজারে বিভিন্ন পাহাড়-সাগর এখন মুখরিত হলেও গ্রামবাংলার অতিপরিচিত কাঠঠোকরা হারিয়ে যেতে বসেছে। কক্সবাজার জেলার বন, বাগান ও লোকালয়ে সর্বত্র বিচরণ করে, একাকী, জোড়ায় বা পারিবারিক দলে দেখা যেত ওই কাঠঠোকরা। গাছের কাণ্ড ও ডালে হাতুড়ির মতো আঘাত করে অথবা মাটিতে ঝরা পাতা উল্টে এরা খাবার সংগ্রহ করত। এখন সেই কাঠঠোকরা আগের মতো আর চোখে পড়ে না। দেখা যায় না রাজকীয় চালে গাছে গাছে আঘাত হানতে। দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে এই ‘রাজমুকুট পরা’ দৃষ্টিনন্দন পাখি। কাঠঠোকরার খাদ্য তালিকায় রয়েছে পিঁপড়া, শুয়োপোকা, বিছা, মাকড়শা, অন্যান্য পোকামাকড় এবং ফুল ও ফলের রস। শক্ত পা ও অনমনীয় লেজে ভর দিয়ে ছোট ছোট লাফ মেরে এরা গাছের কা- বেয়ে উপরে ওঠে। একটি গাছ থেকে অন্য গাছে ওড়ে যাওয়ার সময় উচ্চ স্বরে ডাকে- কিয়ি কিয়ি-কিয়ি-কিয়ি-রররর-র-র-র। ফেব্রুয়ারি থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত প্রজনন ঋতুতে গাছের কা-ে গর্ত খুঁড়ে বাসা বেঁধে এরা ডিম পাড়ে। ডিমগুলো সাদা। তবে তিনটির বেশি ডিম পাড়ে না কাঠঠোকরা। পুরুষ ও মেয়ে পাখি উভয়ই বাসা বুনতে সব কাজ করে থাকে। কাঠঠোকরা পাখির বাসায় হামলা হলে ছানারা সাপের মতো হিসহিস শব্দ করে। কাঠঠোকরা দেখতে খুবই সুন্দর-সুলভ আবাসিক পাখি। সব বনে ও লোকালয়ে এ পাখি দেখা যায়। তাও আবার খুব নগণ্য। পাখিদের আবাসস্থল দিন দিন নষ্ট হওয়ায় কাঠঠোকরাও নিশ্চিহ্ন হতে চলেছে। কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা আলী কবির বলেন, কাঠঠোকরা বাংলাদেশে বিপদমুক্ত বলে বিবেচিত। বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী আইনে এ প্রজাতি সংরক্ষিত। তিনি বলেন, কাঠঠোকরার বৈজ্ঞানিক নামের অর্থ ‘বাংলার শক্তিমান’। পাখিটি বাংলাদেশে শুধু কাঠঠোকরা নামে পরিচিত। পাখিটি লম্বায় ২৯ সেমি, ওজন শতাধিক গ্রামের মতো হয়ে থাকে। প্রাপ্তবয়স্ক পাখির পিঠ সোনালি-হলুদ, দেহতলে কালো আইশের দাগ। ওড়ার পালক ও লেজ কালো। থুঁতনিতে কালো ডোরা। সাদা ঘাড়ের পাশে কালো দাগ। বুকে মোটা কালো আইশের দাগ। চোখে কালো ডোরা। ডানার গোড়ার ও মধ্য-পালক ঢাকনিতে সাদা বা ফিকে ফুটকি এবং পিঠ ও ডানার অবশেষ সোনালি। সবুজ গোলকসহ এর ঠোঁট লালচে-বাদামী, পা ও পায়ের পাতা ধূসর সবুজ এবং ঠোঁট শিং-রং এবং কালোর মিশ্রণ। ছেলে ও মেয়ে পাখির চেহারায় পার্থক্য তাদের চাঁদি এবং ঝুটির রঙে, ছেলে পাখির চাঁদি ও ঝুটি উজ্জ্বল লাল এবং মেয়ে পাখির সাদা বিন্দুসহ চাঁদির সামনের অংশ কালো ও পেছনের ঝুটি লাল। তরুণ পাখির অনুজ্জ্বল দেহ ও চাঁদির সামনের ভাগের সাদা বিন্দু ছাড়া দেখতে মেয়ে পাখির মতো। বিভাগীয় এ বন কর্মকর্তা আরও বলেন, চার উপ-প্রজাতির কাঠঠোকরা বাংলাদেশে আছে। গ্রামে সাধারণত দুই ধরনের কাঠঠোকরা পাখি বেশি দেখা যায়। পুরুষ কাঠঠোকরা পাখি দেখতে মোগল আমলের রাজাদের মতো মাথার ওপরে স্বর্ণের মুকুট পরা আর মেয়ে পাখি দেখতে রাজ্যের প্রধান সেনাপতির মতো। কাঠঠোকরা নয়, বনের সব ধরনের পশু-পাখি, জীবজন্তুর আবাসস্থল টিকিয়ে রাখতে বনায়ন রক্ষার আবেদন জানান তিনি। শহরের কলাতলী মোড় থেকে প্রায় আড়াই কিলোমিটার দক্ষিণে মেরিন ড্রাইভ ও সমুদ্র সৈকতসংলগ্ন দরিয়ানগর পাহাড়টি বড়ছড়া খালের উত্তর পাশ থেকে শুকনাছড়ি পর্যন্ত প্রায় ১০ একর এলাকাজুড়ে অবস্থিত। জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ এ পাহাড়ে রয়েছে ঘন বাঁশবন ও সেগুনবাগান ছাড়াও নানা প্রজাতির বৃক্ষ ও গুল্মের সমাহার। পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে বাস করে নানা প্রজাতির পাখি। বিভিন্ন গাছেও বাসা বেঁধে থাকে পাখির দল। পাহাড়ের খাঁজে বাসকারী কয়েক প্রজাতির পাখির দলও বর্ষা শুরুর দিকে অন্যত্র পালিয়ে যায়। এদিকে বহু প্রজাতির পাখি ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে শহরের দরিয়ানগরে যথেষ্ট সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। সেখানে গড়ে উঠেছে ভেটেরিনারি ও এ্যানিম্যাল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়। চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও এ্যানিম্যাল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের কক্সবাজার আউটরিচ ক্যাম্পাসের নবনির্মিত সড়ক উদ্বোধনকালে জেলা প্রশাসক মোঃ আলী হোসেন বলেন, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, গবেষণা এবং উৎপাদনসহ সার্বিক বিষয়ে শিক্ষার্থীদের জ্ঞানার্জনের লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় এ ক্যাম্পাস স্থাপন করা হয়েছে। সরকারের উন্নয়নমূলক কাজের অংশ হিসেবে দুর্গম এলাকা পাহাড়ী জনপদে নির্মিত হলো এ সড়কটি। এতে প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্টরাসহ পার্শ্ববর্তী এলাকার জনসাধারণের চলাচলের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। রবিবার সকাল ১০টায় দরিয়ানগরে ক্যাম্পাসের এ সড়ক উদ্বোধন করা হয়।
×