ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

প্রতারক চক্রের নেটওয়ার্ক বিদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত

ম্যারেজ মিডিয়া- বিয়ের নামে প্রতারণা, বাণিজ্য

প্রকাশিত: ০৫:২৮, ৭ মার্চ ২০১৭

ম্যারেজ মিডিয়া- বিয়ের নামে প্রতারণা, বাণিজ্য

গাফফার খান চৌধুরী ॥ থেমে নেই বিয়ে নিয়ে প্রতারণা বাণিজ্য। অসংখ্য নারী-পুরুষ সর্বস্ব খুইয়েছেন বিয়ে প্রতারণার কবলে পড়ে। প্রবাসী পাত্র-পাত্রীদের বিয়ে কেন্দ্র করে সবচেয়ে বেশি প্রতারণার ঘটনা ঘটেছে। পরবর্তী সময়ে তদন্তে বেরিয়ে এসেছে অধিকাংশ পাত্র-পাত্রীই প্রকৃতপক্ষে প্রবাসী নন। দেশ ছেড়ে বিদেশ পর্যন্ত এই প্রতারক চক্রের নেটওয়ার্ক বিস্তৃত। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযানের মুখে ভুয়া ম্যারেজ মিডিয়ার ব্যবসা এক প্রকার বন্ধ হয়ে গেছে। হালে চলছে ফেসবুক, মোবাইল ফোন আর পরিচিতজনদের মাধ্যমে বিয়ে নিয়ে প্রতারণার সব অভিনব ঘটনা। এমন প্রতারণার কবলে পড়ে অনেক পরিবার নিঃস্ব হয়ে গেছে। অনেক পাত্র-পাত্রী ও তাদের পরিবার পরিজনকে জেলের ঘানি পর্যন্ত টানতে হচ্ছে। বিয়ে নিয়ে প্রতারণার বেশ কয়েকটি ঘটনার তদন্তে গিয়ে এমন তথ্য পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। গাড়ি বিক্রির নামে আট লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়ার ঘটনায় প্রতারণার মামলায় গুলশান থেকে ইমা নামের এক মেয়ে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়। তার জবানবন্দীতে বেরিয়ে আসে বাংলাদেশে মেয়েদের দিয়ে বিয়ের নামে অভিনব সব প্রতারণার কাহিনী। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ইমা হোন্ডা কোম্পানির সিআরভি লাল রঙের একটি গাড়ি ১২ লাখ টাকায় বিক্রি করতে একজন খ্যাতিমান নাট্যকারের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়। চুক্তি অনুযায়ী গাড়ির ৮ লাখ টাকা পরিশোধ করেন। বাকি ৪ লাখ টাকা নিয়ে গাড়ি আনতে গেলে টালবাহানা শুরু করে ইমা। আজ দেয়, কাল দেয় করে আর গাড়ি দেয় না। শেষ পর্যন্ত এ ব্যাপারে প্রতারণার মামলা হয়। সেই মামলায় গ্রেফতার হয় ইমা। গ্রেফতারের পর বেরিয়ে আসে আসল কাহিনী। গাড়িটি ইমার নয়। বাড়িটি মূলত একজন গাড়ি ব্যবসায়ীর। ডিবি সূত্রে জানা গেছে, আট-দশটা সাধারণ মেয়ের মতোই ছিল ইমার জীবন। পরিবারের সঙ্গে বসবাস করতেন গুলশানের একটি ফ্ল্যাটে। পরিচিত একজনের মাধ্যমে পরিচিত হয় এক গাড়ি ব্যবসায়ীর সঙ্গে। ওই গাড়ি ব্যবসায়ী দামী দামী গাড়ি ইমার বাড়িতে মাঝে মধ্যেই রাখতেন। মাঝে মধ্যে গাড়ি ইমাকে ব্যবহার করতে বলতেন। ইমাও প্রায়ই দামী গাড়ি নিয়ে বের হতো। এমন দামী গাড়িতে যাতায়াতের কারণে ইমার সঙ্গে সম্পর্ক হতে থাকে ধনাঢ্য পরিবারের সন্তানদের। পরিচয় থেকে প্রেম। এভাবে প্রথম প্রথম প্রেম করে ইমা বহু ছেলের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়। পরের ধাপে ইমা বিয়ের প্রতারণা শুরু করে। এ কাজে তাকে সহায়তা করে গুলশানের এক বাড়ির মালিক। এই বাড়ির মালিকও দামী দামী গাড়ির মালিকের সঙ্গে ইমার পরিচয়ের পর থেকেই ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠেছিল। আলিশান বাড়িতে বসবাসরত দামী গাড়িতে বসা অবস্থায় বিভিন্ন ছবি পোস্ট করে ফেসবুকে ছাড়তে থাকে। সেই সঙ্গে ইমার বিয়ের জন্য পাত্র খোঁজা হচ্ছে বলে, প্রচারণা চালানো হয়। স্বাভাবিক কারণেই এমন সুন্দরী মেয়ে, আলিশান বাড়ি আর দামী গাড়ি দেখে স্বাভাবিক কারণেই ধনাঢ্য পরিবারের ছেলেরা পাত্রী হিসেবে ইমাকে দেখতে যেতে থাকে। পাত্ররা বাড়িতে গিয়ে সবই ঠিক ঠিকই পায়। বাড়ির সামনে বিএমডব্লিউ ও মার্সিডিস বেঞ্জের মতো দামী গাড়ি হরহামেশাই দেখা যায়। স্বাভাবিক কারণেই পাত্র পক্ষ গাড়িগুলো মেয়েদের বলে ধারণা করে। এছাড়া গাড়িগুলো দিয়ে ইমার বাড়ির লোকজন ও ইমাকে যাতায়াত করতেও দেখা যায়। এভাবে ইমা সাত ছেলের কাছে বিয়ে হয়েছিল। প্রতি ছেলের কাছ থেকেই লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়ে শেষ পর্যন্ত ডিভোর্স দিয়েছে। সর্বশেষ দেশের একজন শিল্পপতির ছেলের কাছ থেকেও প্রতারণার মাধ্যমে সাত লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। পাত্র হিসেবে চক্রটির পছন্দ ছিল প্রবাসী ছেলে। কারণ, প্রবাসী ছেলের প্রতারণার কবলে ফেলানো তুলনামূলক সহজ। এছাড়া সম্প্রতি বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত এক মার্কিন নাগরিকও প্রতারণার শিকার হয়েছেন। তিনি তিনবার বাংলাদেশে বিয়ে করে তিনবারই প্রতারিত হয়েছেন। এ সংক্রান্ত রাজধানীর হাজারীবাগ থানায় একটি লিখিত অভিযোগ রয়েছে। হাজারীবাগ থানার ওসি মীর আলীমুজ্জামান জনকণ্ঠকে জানান, ওই প্রবাসী বাংলাদেশে তিন নারীকে বিয়ে করেছিলেন। তিনবারই তিন নারীর দ্বারা প্রতারিত হয়েছেন। সর্বশেষ তিনি খুলনার নীলা নামের এক মেয়ের মাধ্যমে প্রতারিত হয়ে মোটা অঙ্কের টাকা খুইয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলে গেছেন। অন্যদিকে রংপুর এলাকার ওয়াহিদা সিফাত নামের এক মেয়েকে লন্ডনপ্রবাসী আসিফ নামের এক ছেলের কাছে বিয়ে দিয়ে চরমভাবে প্রতারিত হয়েছেন এক পরিবার। সিফাতের পিতা আমিনুল ইসলাম জানান, প্রবাসী ছেলে দেখে বিয়ে দিয়েছিলাম, ভেবেছিলাম মেয়ে খুব সুখী হবে। সুখের বদলে যৌতুকের জন্য নির্মম নির্যাতনের পর মেয়ের মৃত্যু হয়েছে। এ মামলায় আসিফের দশ বছরের কারাদ- দিয়েছে আদালত। এমন রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপীল করব। যাতে আসিফ ও তার পিতামাতার সর্বোচ্চ শাস্তি হয়। বিয়ে নিয়ে প্রতারণার বিষয়ে র‌্যাবের লিগ্যাল এ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান জনকণ্ঠকে বলেন, গত কয়েক বছরে অন্তত পাঁচ হাজার অভিযোগ তাদের কাছে এসেছে। একেকটি অভিযোগ একেরটির চেয়ে গুরুতর। অনেক ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটন করা সম্ভব হয়েছে। উদ্ঘাটিত ঘটনা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বিয়ে নিয়ে প্রতারিত হওয়ার মূল কারণ লোভ। এমন সুযোগটিকে কাজে লাগায় চক্রের সদস্যরা। তারা পাত্র বা পাত্রী প্রবাসী চলে ফেসবুকসহ বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচার চালায়। আর পাত্র পক্ষ প্রবাসী পাত্রীর কথা শুনে বিদেশে স্থায়ীভাবে বসবাস ও কর্মস্থানের আশায় বিয়েতে রাজি হয়। আর তখনই নানাভাবে প্রতারণার কবলে পড়ে। চক্রটি পাত্র পক্ষের কাছ থেকে নানা কৌশলে বিদেশ পাঠিয়ে দেয়ার নাম করে হাতিয়ে নেয় লাখ লাখ টাকা। এই চক্রটির সঙ্গে মানব পাচারকারী চক্রেরও যোগাযোগ আছে। ঠিক একইভাবে প্রবাসী পাত্রের কাছে মেয়ে বিয়ে দিয়ে, নিশ্চিন্ত থাকতে চান অভিভাবকরা। আর তাতেই অভিভাবক ও পাত্রীরা পড়েন প্রতারণার কবলে। পাত্রী পক্ষকে তড়িঘড়ি করে বিয়ের আয়োজন করতে বলে প্রতারক চক্র। বিয়ের পরেই পাত্রীকে বিদেশে নিয়ে যাওয়ার নাম করে মোটা অঙ্কের টাকা নানা কৌশলে হাতিয়ে নেয় চক্রটি। চক্রগুলো এতটাই বিশাল যে, বিদেশেও তাদের নেটওয়ার্ক রয়েছে। তারা ফেসবুক ছাড়াও পরিচিতজনদের মাধ্যমেও বিয়ের নামে প্রতারণা করে। এসব ক্ষেত্রে পাত্র বা পাত্রীর সঙ্গে বিদেশে চাকরি করা প্রতারক চক্রের সদস্যরা বিয়ের কথা বলে ওইসব পাত্র-পাত্রীকে দেশে থাকা প্রতারক চক্রের কাছে পাঠায়। তারাই পাত্র-পাত্রীকে বিয়ের নামে প্রতারণার কবলে ফেলে হাতিয়ে নেয় লাখ লাখ টাকা। অনেক সময় অপহরণের ঘটনাও ঘটায়। এসব ক্ষেত্রে বিদেশে থাকা প্রতারক চক্রের সদস্যরা প্রতারণার মাধ্যমে হাতিয়ে নেয়া অর্থের একটি অংশ পেয়ে থাকে। এই র‌্যাব কর্মকর্তা আরও জানান, এমন প্রতারণার নেপথ্যে রয়েছে ম্যারেজ মিডিয়া হাউস। গত কয়েক বছরে বহু ভুয়া ম্যারেজ মিডিয়াকে জেল জরিমানা করা হয়েছে। তারপরেও বিয়ে নিয়ে প্রতারণা থেমে নেই। অনেক ম্যারেজ মিডিয়া গোপনে ও ফেসবুকের মাধ্যমে তৎপরতা চালাচ্ছে। আগের তুলনায় বিয়ে নিয়ে প্রতারণার ঘটনা, অনেক কমে এলেও, পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। এমন প্রতারণার কবল থেকে রক্ষা পেতে সবচেয়ে বেশি জরুরী সচেতনতা। পাত্র বা পাত্রী পক্ষকে অবশ্যই জেনেশুনে বিয়ের বিষয়ে আলাপ-আলোচনা ও খোঁজখবর নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। অন্যথায় প্রতারিত হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যাবে। ঢাকা মহানগর পুলিশের মিডিয়া বিভাগের উপকমিশনার মাসুদুর রহমান জনকণ্ঠকে জানান, প্রবাসী পাত্র-পাত্রীর বিয়ে নিয়ে প্রতারণার অভিযোগ অনেক। অনেক অভিযোগের বিষয়ে শেষ পর্যন্ত মামলা হয়েছে। অনেকেই গ্রেফতার হয়েছে। পাত্র ও পাত্রী উভয়ের ক্ষেত্রেই প্রতারণার ঘটনা ঘটে। পাত্রীরা অনেক সময় বিয়ের পর কয়েক মাস বা বছর খানেক স্বামীর সঙ্গে ভালভাবেই দেশে ঘর সংসার করে। ঘর সংসার করার সময় স্ত্রী নিজের নামে স্বামীকে ব্যাংক এ্যাকাউন্ট খুলে দিতে বলে। আবার স্বামী-স্ত্রীর ভাল সম্পর্কের কারণে স্বামীও অনেক সময় ইচ্ছে করে স্ত্রীর নামেই ব্যাংক এ্যাকাউন্ট খুলে দেয়। এরপর স্বামী বিদেশ চলে যান। সেখান থেকে স্ত্রীর এ্যাকাউন্টে টাকা পাঠান। অনেক সময় স্ত্রী গ্রামের বাড়িতে জমি কেনা, ঘর করা, ব্যবসা বাণিজ্য করার কথা বলে স্বামীর কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা ব্যাংক এ্যাকাউন্টে স্বামীকে পাঠাতে বলেন। স্বামী বিশ্বাস করে পাঠিয়ে দেয়। একপর্যায়ে এ্যাকাউন্টে পর্যাপ্ত পরিমাণ টাকা জমা হওয়ার পর স্ত্রী আর স্বামীর ঘর সংসার করতে রাজি হয় না। পাঠানো টাকা খরচ হয়ে গেছে বলে, নানা অজুহাত দেখান। শেষ পর্যন্ত চরম তিক্ততার মধ্য দিয়ে স্বামী-স্ত্রী আলাদা হয়ে যান। মাঝখান থেকে প্রতারণার কবলে পড়ে পাত্র মোটা অঙ্কের টাকা হারান। এমনকি প্রবাসী এক পাত্র বিশ্বাস করে স্ত্রীর নামে জমি, বাড়িঘর, ব্যবসা বাণিজ্য সব লিখে দিয়েছেন। এরপর ওই স্ত্রী পাঁচ বছরের মেয়েকে রেখে অন্যত্র চলে যাওয়ার রেকর্ড আছে। শুধু পাত্রী নয়, পাত্রের ক্ষেত্রেও এমনটা ঘটে। অনেক পাত্র বা পাত্রী পরিকল্পিতভাবেই এমন প্রতারণা করে থাকে। তবে সচেতনতা বৃদ্ধি পাওয়ায় আগের তুলনায় এমন অপরাধ কমে এসেছে।
×