ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০২ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১

ধর্মঘটীদের বেপরোয়া তাণ্ডব, পুলিশ ক্যাম্পে আগুন

প্রকাশিত: ০৫:৩৪, ২ মার্চ ২০১৭

ধর্মঘটীদের বেপরোয়া তাণ্ডব, পুলিশ ক্যাম্পে আগুন

স্টাফ রিপোর্টার ॥ সারাদেশে পরিবহন ধর্মঘটের সময় বেপরোয়া তাণ্ডবের ঘটনা ঘটেছে। এবারের তাণ্ডব অতীতের যেকোন সময়ের রেকর্ডকে হার মানিয়েছে। তা-বের সময় আহত বাসচালক শাহ আলম চিকিৎসাধীন অবস্থায় সন্ধ্যা সাতটার দিকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মারা গেছেন। সংঘর্ষে পুলিশ, সাংবাদিক, পথচারীসহ নানা শ্রেণী- পেশার অনেকেই আহত হয়েছেন। এবার প্রথমবারের মতো বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা এ্যাম্বুলেন্সের চালককে মারধর, মাইক্রোবাস ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ, জননিরাপত্তায় নিয়োজিত পুলিশের ক্যাম্পে অগ্নিসংযোগ ও ভাংচুরের ঘটনা ঘটিয়েছে। তা-বের হাত থেকে রক্ষা পায়নি রিক্সা ও সিএনজির মতো যানবাহনও। এমনকি ঢাকার ভেতরে চলাচলকারী গণপরিবহনের চালক ও শ্রমিকদের পরিবহন না চালাতে বাধ্য করেছে শ্রমিক সংগঠনগুলো। বাস টার্মিনালের আশপাশে বিভিন্ন দোকানপাট বন্ধ করে দিয়েছে। এমনকি খাবার হোটেল পর্যন্ত বন্ধ রাখতে বাধ্য করেছে। শ্রমিক ধর্মঘটসহ নানা ইস্যুতে অতীতে কোন দিনই এমন ঘটনা ঘটেনি। গোয়েন্দা সংস্থাগুলো বলছে, অতীতে শ্রমিক অসন্তোষের ঘটনায় এমন তা-বের ঘটনা ঘটেনি। এবার কোন গোষ্ঠী পরিকল্পিতভাবে শ্রমিক সাজিয়ে পেশাদার অপরাধীদের দিয়ে ধর্মঘটের আড়ালে এমন তা-ব চালিয়েছে কিনা সে বিষয়টি অনুসন্ধান করা হচ্ছে। এক চালককে যাবজ্জীবন ও একজনকে ফাঁসির দ-াদেশ দেয়ার প্রতিবাদে মঙ্গলবার থেকে সারাদেশে পরিবহন শ্রমিকরা ধর্মঘট পালন করছিল। বুধবার বেলা চারটার দিকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যায়। ধর্মঘট তুলে নেয়ার আহ্বান জানান নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান। এরপর সারাদেশেই পরিবহন চলাচল শুরু হয়। কিন্তু পরিবহন ধর্মঘট শুরুর পর থেকেই এবার শ্রমিকরা ছিল হিংসাত্মক মারমুখী। মঙ্গলবার সারাদিনই ঢাকাসহ সারাদেশেই পরিবহন শ্রমিকরা নানাভাবে বিক্ষোভ করে। কিন্তু রাত আটটার দিকে ঢাকার গাবতলীতে আচমকা বেপরোয়া হয়ে ওঠে শ্রমিকরা। শত শত শ্রমিক আস্তে আস্তে গাবতলীর শ্রমিক অফিসে হাজির হয়। সেখান থেকে মিছিল নিয়ে বের হয়। এ সময় তারা গাবতলী-সাভার রাস্তা অবরোধ করে। ব্যক্তিগত গাড়ি যাতায়াতে বাধা দেয়। প্রথমে তারা একটি এ্যাম্বুলেন্সের চালককে মারধর করে। যদিও এ্যাম্বুলেন্সে কোন রোগী ছিল না। এ্যাম্বুলেন্সে মারধর করার সময় পাশে কয়েক পুলিশ দায়িত্ব পালন করছিল। তারা এগিয়ে গিয়ে বিষয়টি মীমাংসার চেষ্টা করে। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে শ্রমিকরা পুলিশদের ধাওয়া করে। পুলিশ দ্রুত একটি বাড়িতে আশ্রয় নেয়। এরপর ওই বাড়ির চারদিকে অবস্থান নেয় শ্রমিকরা। এ সময় পুলিশ সাধারণ পোশাক পরে ঘটনাস্থল ত্যাগ করে। খরব পেয়ে সেখানে অতিরিক্ত পুলিশসহ উর্ধতন পুলিশ কর্মকর্তারা হাজির হন। পুলিশ দেখেই ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে শ্রমিকরা। তারা আবার পুলিশকে ধাওয়া করে। শুরু হয় পুলিশের সঙ্গে শ্রমিকদের ধাওয়া পাল্টাধাওয়া। এমন পরিস্থিতির মধ্যেই রাত নয়টার দিকে গাবতলী বাস টার্মিনালের সামনে পুলিশের একটি রেকার বিকল হয়ে পড়ে। সেটি মেরামত করার কাজ চলছিল। বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা রেকারটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। রেকারের আগুন নেভানোর জন্য ফায়ার সার্ভিসের সদর দফতরে ফোন করে পুলিশ। ফায়ার সার্ভিসের দুটি ইউনিট ঘটনাস্থলের দিকে রওনা হয়। কিন্তু গাড়ি দুটি শ্যামলী যাওয়ার পরেই আর এগোতে পারেনি। কারণ শত শত শ্রমিক তখন রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ করছিল। বিক্ষোভকারীরা ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতেও আগুন দিতে উদ্যত হয়। এ সময় চালকরা গাড়ি দুটি নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নেন। একই সময়ে বিক্ষোভকারীরা গাবতলী এলাকার হানিফ পরিবহনের বালুর মাঠ সংলগ্ন কাউন্টারের সামনে থাকা পুলিশের একটি অস্থায়ী পুলিশ বক্স ভাংচুর করে। এরপর তাতে আগুন ধরিয়ে দেয়। পরে পুরো পুলিশ বক্সটি তুলে নিয়ে গাবতলী বাস টার্মিনালের সামনে রাস্তার উপর ফেলে দেয়। এ সময় পুরো এলাকায় টান টান উত্তেজনা বিরাজ করছিল। অতিরিক্ত পুলিশ গাবতলী রাস্তার দিকে অবস্থান নেয়। আর শত শত শ্রমিক গাবতলী বাস টার্মিনালের পাশে অবস্থান নেয়। পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকে শ্রমিকরা। ইটের আঘাতে রাতেই অন্তত ৭ পুলিশ আহত হন। বিক্ষোভকারীরা রাস্তায় টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করতে থাকে। এ সময় আতঙ্কে আশপাশের এলাকার সব দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়। মানুষজন ভয়ে নিরাপদ জায়গায় চলে যান। পুলিশ পরিস্থিতি সামাল দিতে প্রথমে টিয়ারশেল নিক্ষেপ করতে থাকে। তাতেও কাজ না হলে এক পর্যায়ে পুলিশ রবার বুলেট নিক্ষেপ করে। পুলিশের টিয়ারশেলের মুখে বিক্ষোভকারী গাবতলীর বিভিন্ন বাসের আড়ালে অবস্থান নেয়। সেখান থেকেই ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকে। এমন পরিস্থিতির মধ্যে রাত সাড়ে নয়টার দিকে বিক্ষোভকারীরা গাবতলী বাস টার্মিনালের সামনে দিয়ে যাওয়া একটি মাইক্রোবাস আটকে দেয়। গাড়ি থেকে সবাইকে নামিয়ে দেয়। এ সময় গাড়িটির চালক ও যাত্রীরা শ্রমিকদের অনুরোধ করতে থাকেন। কে শোনে কার কথা। যাত্রীদের নামিয়ে দিয়ে মাইক্রোবাসের প্রতিটি দরজা জানালা ভেঙ্গে ফেলে। এরপর তাতে আগুন ধরিয়ে দেয়। এ সময় আবার পুলিশের সঙ্গে শ্রমিকদের সংঘর্ষ হয়। রাত একটা পর্যন্ত থেমে থেমে সংঘর্ষ চলে। ঘটনার রাতে গাবতলী বাস টার্মিনালে অবস্থান করা একাধিক চালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, পুলিশের সঙ্গে গোলাগুলি হয়েছে। গোলাগুলিতে পরিবহন মালিক ও শ্রমিক সংগঠনগুলোর লোকজন ছাড়াও বহিরাগতরা অংশ নিয়েছিল। তারা পুলিশকে লক্ষ্য করে ফাঁকা গুলি চালিয়েছে। পুলিশও পাল্টা গুলি চালিয়েছে। রাত একটার পরেও থেমে থেমে গুলি চালিয়েছে গাবতলী এলাকা থেকে। গুলিবর্ষণকারীরা পরিবহন ধর্মঘটের পক্ষের লোক বলে ধারণা করা হচ্ছে। এদিকে বুধবার সকাল সাতটার দিকে শত শত শ্রমিক আবার রাস্তায় বের হয়। তারা সড়ক অবরোধ করে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেয়। বুধবার এমনিতেই গণপরিবহন চলাচল বন্ধ ছিল। শুধুমাত্র রিক্সা, মোটরসাইকেল, যতসামান্য কিছু প্রাইভেটকার চলতে দেখা গেছে। এছাড়া হিউম্যান হলার পর্যন্ত বন্ধ ছিল। সকালেই রাস্তা অবরোধ করে ব্যক্তিগত যানবাহন চলাচলও বন্ধ করে দেয় শ্রমিকরা। এতে বাধা দিলে পুলিশের সঙ্গে শ্রমিকদের ধাওয়া পাল্টাধাওয়া, ইটপাটকেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। পুলিশ পরিস্থিতি সামাল দিতে কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে। সকাল সাড়ে দশটার দিকে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে শাহ আলম নামে এক বাসচালক আহত হন। তিনি যাত্রীবাহী বৈশাখী পরিবহনের চালক ছিলেন বলে প্রাথমিকভাবে জানা যায়। সন্ধ্যা সাতটার দিকে তার মৃত্যু হয় বলে মেডিক্যাল সূত্রে জানা গেছে। থেমে থেমে বেলা এগারোটা নাগাদ সংঘর্ষ চলে। এরপর পরিস্থিতি আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হয়ে যায়। এমন পরিস্থিতির কারণে গাবতলী, আমিনবাজার, শাহআলী মাজার রোড, কল্যাণপুরসহ আশপাশের এলাকায় সব ধরনের দোকানপাট ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের প্রায় সবই বন্ধ ছিল। গাবতলী বাস টার্মিনাল ও আশপাশের এলাকায় বেশ কিছু খাবারের দোকান খোলা ছিল। এক পর্যায়ে তাও বন্ধ হয়ে যায়। খাবারের দোকানিরা জানান, পরিবহন মালিক সমিতির লোকজন ও শ্রমিক নেতারা দোকানপাট বন্ধ করে দিয়েছে। অনেকে দোকান বন্ধ করতে রাজি না হলে তাদের মারধরও করেছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, অনেক দোকানপাটে লুটপাটও হয়েছে। কোন কোন দোকানপাট ইচ্ছাকৃতভাবে ভাংচুর করা হয়েছে। শ্রমিক ধর্মঘটের আড়ালে অনেকেই ব্যক্তিগত আক্রোশ থেকে অনেক দোকানপাটে ভাংচুর চালিয়েছে। রাতভর গাবতলী এলাকায় আতঙ্ক বিরাজ করছিল। মানুষজন নিরাপদে ঘুমাতে পর্যন্ত পারেনি। রাতভর পুলিশের সঙ্গে শ্রমিকদের থেমে থেমে ধাওয়া পাল্টাধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। পুলিশ আশপাশের বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালিয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, বিভিন্ন রাজনৈতিক হরতালে এমনটা দেখা গেলেও, পরিবহন শ্রমিকদের ধর্মঘটে এ ধরনের ঘটনা ইতোপূর্বে কখনো দেখা যায়নি। এমনকি এমন ঘটনা ঘটেনি। দোকানিরা বলছেন, এবার শ্রমিকরা অন্য যেকোন সময়ের চেয়ে বেশি মারমুখী ছিল। ইতোপূর্বে বিভিন্ন দোকানপাটে শ্রমিকদের উপর শ্রমিকদের চড়াও হওয়ার নজির নেই। কিন্তু এবার তাও হয়েছে। বিক্ষোভকারীরা দোকানপাট অনেকটা বাধ্য করেই বন্ধ করে দিয়েছে। যারা দোকানপাট বন্ধ করেনি তাদের গালমন্দ ও চড়থাপ্পড়ও দিয়েছে। যা একেবারেই অনাকাক্সিক্ষত। পুলিশের মিরপুর জোনের উপকমিশনার মাসুদুর রহমান জানান, সংঘর্ষের সময় বেশ কয়েকজনকে আটক করা হয়েছে। গাবতলী বাস টার্মিনালের বেশ কয়েকজন চালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, সুযোগ পেলেই পুলিশ টার্মিনালে অভিযান চালিয়েছে। পুলিশের উপর হামলাকারী অনেককেই ধরে নিয়ে গেছে পুলিশ। আটককৃতদের মধ্যে বেশ কয়েকজন চালক রয়েছে। গাবতলী ছাড়াও দেশের বিভিন্ন জায়গায় তা-ব চালিয়েছে শ্রমিকরা। তবে সবচেয়ে বেশি তা-ব চালিয়েছে ঢাকায়। যাত্রাবাড়ী, কাঁচপুর, চিটাগাং রোড, সাইনবোর্ড, মাতুয়াইল, রায়েরবাগ, সায়েদাবাদ ব্রিজ, গোলাপবাগ মোড়, মোহাম্মদপুর টাউন হল, পল্লবী, মিরপুর স্টেডিয়ামসহ বিভিন্ন এলাকায় রাস্তা অবরোধ করে তা-ব চালিয়েছে শ্রমিকরা। তারা এসব এলাকা দিয়ে যাতায়াতকারী যানবাহন চলাচলে বাধা দিয়েছে। এমনকি বাধার হাত থেকে রক্ষা পায়নি রিক্সা ও সিএনজির মতো যানবাহনও। ঢাকার ভেতরে চলাচলকারী বাসগুলোকে বিভিন্ন রাস্তার পাশে পার্কিং করা অবস্থায় দেখা গেছে। কেউ কেউ ধর্মঘট অম্যান্য করে যানবাহন নিয়ে রাস্তায় বের হলে তাদের জোর করে গাড়ি না চালাতে বাধ্য করা হয়েছে। এ নিয়ে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ছোটখাটো হাতাহাতির ঘটনাও ঘটেছে।
×