ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

মমতার মানবিক মুখে উচ্ছ্বসিত দল

প্রকাশিত: ১৯:১৯, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

মমতার মানবিক মুখে উচ্ছ্বসিত দল

অনলাইন ডেস্ক ॥ টাউন হলের বৈঠক শেষ হয়েছে কি হয়নি! মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মোবাইলে ভেসে উঠল মুকুল রায়ের বার্তা— ‘‘দিদি তুমি আজ যা করলে, বাংলার গরিব-মধ্যবিত্ত মানুষ তোমাকে দু’হাত তুলে আশীর্বাদ করবে।’’ বেসরকারি হাসপাতালগুলির বিরুদ্ধে মানুষের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ, অসন্তোষ, অভিযোগ নিয়ে আলোচনা করতে বুধবার সংস্থাগুলির কর্ণধারদের বৈঠকে ডেকেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু বৈঠক কোথায়! দিদি-সুলভ মাস্টারস্ট্রোকে তাকে কার্যত ‘গণ শুনানিতে’ পরিণত করলেন মমতা। মানুষের দুর্ভোগ-অভিযোগকে যেন নিজের সমস্যা হিসেবে তুলে ধরলেন। আমজনতার কৌঁসুলি হয়ে রীতিমতো চোয়াল শক্ত করে অভিযোগ ধরে ধরে কৈফিয়ত চাইলেন প্রতিটি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে। আবার পরক্ষণেই বিচারকের গাউন পরে নিয়ে নিদান দিলেন। সমঝে দিলেন, ‘এনাফ ইজ এনাফ্!’ যথেষ্ট হয়েছে! চিকিৎসার নামে গরিব, মধ্যবিত্তকে ঠকানো আর বরদাস্ত করা হবে না বাংলায়! আর এই গোটা পর্ব চলল সংবাদমাধ্যমের ক্যামেরার সামনে। ‘লাইভ’ সম্প্রচারে যা চাক্ষুষ করে সাধারণ মানুষ তো বটেই এমনকী তৃণমূল-বিরোধী অনেকেই কবুল করলেন, ভীমরুলের চাকে ঢিল মেরেছেন মমতা! এটাই দরকার ছিল। এই গণ শুনানিতে চমক ছিল। কিন্তু রাজনীতি কি একেবারেই ছিল না? রাজনীতির কারবারিদের বড় অংশই বলছেন, আলবত ছিল। মুকুল রায়ের বার্তাই তার প্রমাণ। টাউন হল থেকে ক্রোশখানেক দূরে তপসিয়ার তৃণমূল ভবনের মুডও এ দিন জানান দিয়েছে, মমতার এই এক পদক্ষেপকে সামনে রেখে বাংলার গরিব-মধ্যবিত্তের মনে জায়গা আরও পোক্ত করে নেওয়ার সুযোগ দেখছেন তাঁরা। দলের এক শীর্ষ সারির নেতার কথায়, ‘‘মানুষের অভিযোগের সদুত্তর দিতে যাঁরা সামনে আসেন না, দিদিই পারেন তাঁদের জনতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে কৈফিয়ত চাইতে। আমরা তো চাইছি, আগামী সাত দিন এই এপিসোডটা রোজ টিভিতে দেখাক।’’ তবে শাসক দলের একটা অংশ আবার সংশয়ীও। তাঁদের প্রশ্ন, কিছু দিন পরে এই সক্রিয়তাই ব্যুমেরাং হয়ে ফিরে আসবে না তো! কারণ, বর্তমান জমানায় বহু ভাল পদক্ষেপ যে ধারাবাহিকতার অভাবে থমকে গিয়েছে তার হাতে-গরম নজির বিস্তর। যেমন ২০১১ সালে ক্ষমতায় এসেই সরকারি হাসপাতালগুলিতে আচমকা যেতে শুরু করেছিলেন মমতা। তার জেরে নাড়াচাড়া পড়েছিল হাসপাতালের অন্দরে। কিন্তু ক’মাস পরেই নজরদারিতে ভাটা পড়ে। হাসপাতালও অনেকটাই ফিরে যায় পুরনো রুটিনে। আবার, কাঁচা আনাজ বা নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধির ওপর নজরদারি রাখার যে মেকানিজমের ঘোষণা একদা হয়েছিল, তা এখন প্রায় অকেজো! তৃণমূল নেতাদের একাংশের মতে, পরিস্থিতি খারাপ হলে ঢাকঢোল পিটিয়ে কিছু করা, তার পর পুনর্মূষিক ভব— এহেন অভিযোগ কিন্তু বহু ক্ষেত্রে লেগে যাচ্ছে সরকারের গায়ে। মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য এ দিন ধারাবাহিকতা রাখারই ইঙ্গিত দিয়েছেন। বেসরকারি হাসপাতালগুলির রোগ সারাতে প্রেসক্রিপশনে দু’টি কড়া ওষুধের নাম লিখেছেন তিনি। এক, ক্লিনিক্যাল এস্টাব্লিশমেন্ট আইনকে সংশোধন করে বেসরকারি হাসপাতালগুলিকে কঠোর শাসনে বাঁধা। দুই, এ হেন হাসপাতালগুলির উপর নজর রাখা এবং তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের শুনানির জন্য হাইকোর্টের এক জন অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে নিয়ন্ত্রক কমিশন গঠন। সে জন্য মার্চের গোড়াতেই বিল আনা হবে বিধানসভায়। তবে ওই বিল পাশ করিয়ে রাষ্ট্রপতির সই হয়ে আসতে সময় লাগবে। তত দিন কী হবে, সেই প্রশ্ন উঠছে। তা ছাড়া আরও একটি প্রশ্ন তুলছেন পর্যবেক্ষকরা। তাঁদের বক্তব্য, কলকাতা তথা গোটা জেলায় বেসরকারি হাসপাতালগুলির উপর শাসক দলের এক শ্রেণির নেতার অত্যাচার-আবদারও কম নয়! তাঁদের সুপারিশ করার রোগীকে অযৌক্তিক ভাবে কম খরচে চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দিতে হবে, রোগী নিয়ে গেলেই বেড দিতে হবে, অন্য রোগীর চিকিৎসা বাদ দিয়ে তাদের রোগীর চিকিৎসা আগে করতে হবে, কিছু না কিছু লেগেই রয়েছে। উপরি উৎসবে-পার্বণে চাঁদার জুলুম। গণ শুনানির মধ্যে বেসরকারি হাসপাতালের কর্ণধাররা হয়তো মুখ্যমন্ত্রীর সামনে মুখ ফুটে তা বলতে পারেননি। তবে সেই রোগ সারানোর দায়ও মুখ্যমন্ত্রীকেই নিতে হবে। তবে সামগ্রিক বিচারে এটুকু যদি-কিন্তু ছাড়া মুখ্যমন্ত্রীর এ দিনের পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছেন সকলেই। এমনকী বিরোধী শিবিরের এক নেতা এ দিন বলেন, এমন নয় যে এই পরিস্থিতি আগে ছিল না। কিন্তু বাম আমলে এমন পদক্ষেপের কথা ভাবা পর্যন্ত হয়নি। তাঁর মতে, মমতা যা করলেন, তাতে বেসরকারি হাসপাতালগুলির বিরুদ্ধে রাজ্যের মানুষের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ-অভিযোগ এত দিনে অন্তত একটা জানলা পেল। কারণ, বেসরকারি হাসপাতালের বিরুদ্ধে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখানো বিলের বোঝা বা চিকিৎসায় গাফিলতির অভিযোগ বাংলার প্রায় ঘরে ঘরে। হাতেগোনা কয়েকটি ক্ষেত্রে ভাঙচুর বা বিক্ষোভ হয় ঠিকই। কিন্তু অধিকাংশ মানুষকে মুখ বুজেই এ সব মেনে নিতে হয়। সন্দেহ নেই বুধবার মাস্টারস্ট্রোক খেললেন মমতা। প্রশ্ন শুধু একটাই, ধারাবাহিকতা থাকবে তো? সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা
×