ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১

হাঙ্গরের শরীরে ক্যান্সাররোধী জিন

প্রকাশিত: ০৬:০৪, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

হাঙ্গরের শরীরে ক্যান্সাররোধী জিন

বেশ কয়েক বছর ধরেই বিজ্ঞানীদের এই তথ্যটি জানা যে হাঙ্গর ও রেই মাছেরা নিজেদের শরীরের ক্ষত সারিয়ে তোলার ব্যাপারে অতিমাত্রায় দক্ষ। তারা এটাও ধারণা করেছিলেন যে এদের ক্যান্সার প্রতিরোধের ক্ষমতাও সম্ভবত বেশি। এই বৈশিষ্ট্যগুলো সম্ভব তাদের ইমিউন সিস্টেম বা রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত- যে ব্যবস্থাটি ৪০ বছরের বিবর্তনের মধ্য দিয়ে সুবিকশিত হয়েছে। এখন হাঙ্গরের ডিএনএর নতুন জেনোমিক্স গবেষণায় হাঙ্গরের রোগ প্রতিরোধ জিনগুলোর অনন্য পরিবর্তন প্রকাশ পেয়েছে। এর মধ্যেই হয়ত সাগরের এই শিকারি প্রাণীগুলোর দ্রুত ক্ষত সারানোর এবং সম্ভবত অধিকতর ক্যান্সার প্রতিরোধী ক্ষমতাটি নিহিত আছে। মানুষের কাছে অতিমাত্রায় কাম্য এমন কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য হাঙ্গরের মধ্যে কেন দেখতে পাওয়া দায় জিনেটিক দৃষ্টিকোণ থেকে তা বোঝার ব্যাপারে এই গবেষণা আমাদের কয়েক ধাপ কাছাকাছি নিয়ে এসেছে। নতুন গবেষণাটি চালিয়েছে নোভা সাউথ ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটির সেভ আউয়ার সিজ শার্ক রিসার্চ সেন্টার ও গাই হার্তে রিসার্চ ইনস্টিটিউট এবং কর্নেল ইউনিভার্সিটি কলেজ অব ভেটেরিনারি মেডিসিন। গবেষণায় এই প্রথম প্রমাণ দেখান হয়েছে যে কিছু কিছু হাঙ্গর ও রেই মাছের রোগ প্রতিরোধক জিনগুলোর বিবর্তনমূলক পরিবর্তন ঘটে গেছে। আর সেই পরিবর্তনের সঙ্গে হয়ত রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার এসব অনন্য ক্ষমতার যোগসূত্র আছে। গবেষক দলের অন্যতম মাহমুদ শিভজি বলেন, হাঙ্গর ও রেই মাছের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা সুপরীক্ষিত। এটি কোটি কোটি বছর ধরে বিবর্তিত হয়েছে। বিষয়টিকে বোঝার জন্য জেনোমিক্সকে কাজে লাগানোর ফলে আরও এমন কিছু আবিষ্কৃত হতে পারে যা চাঞ্চল্যকর ও শিহরণমূলক। কিছু আবিষ্কার মানুষের ক্যান্সার চিকিৎসায় সুফল এনে দিতে পারে। আর সে জন্যই এই অসাধারণ এবং পরিবেশ-প্রতিবেশগতভাবে নাজুক প্রাণীগুলোকে রক্ষা করাও জরুরী হয়ে উঠেছে। গবেষজ্ঞরা লক্ষ্য করেছেন যে, হাঙ্গরের দুটি রোগ প্রতিরক্ষক জিন যথা লেগুমেইন ও ব্যাগ ১ এ ব্যাপারে বিশেষ নজর পাওয়ার যোগ্য। এ দুটো জিনের সমগোত্রীয় জিন মানবদেহেও আছে। মানবদেহে এই জিন দুটি অতি উত্তেজিত হয়ে ওঠার সঙ্গে সমস্ত ধরনের ক্যান্সারের সম্পৃক্ততা থাকার কথাটা সুবিদিত। লক্ষণীয় ব্যাপার হলো, নতুন গবেষণায় দেখা গেছে হাঙ্গরের এই জিন দুটোর গুণগত পরিবর্তন ঘটে গেছে এবং সেগুলোর বিবর্তনঘটিত প্রাকৃতিক নির্বাচন হয়েছে। শিভজি বলেন, ল্যাব গবেষণায় বেশকিছু পরীক্ষায় হাঙ্গরের শরীর থেকে আহরিত রাসায়নিক যৌগের টিউমার প্রতিরোধী বৈশিষ্ট্যের পরিচয় পাওয়া গেছে। এটা ভারি অদ্ভুত ব্যাপার যে আমরা হাঙ্গরের এই দুই নির্দিষ্ট রোগ প্রতিরোধী জিনের বিবর্তনমূলক অভিযোজনের প্রমাণ দেখতে পাচ্ছি, অথচ ঠিক এই জিনগুলোই মানবদেহে ক্যান্সারের কারণ ঘটার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। শিভজি অবশ্য জোর দিয়ে বলেছেন, এটি বুঝতে পারা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে হাঙ্গরের শরীরের পাকস্থলীর অংশ মানবদেহে ক্যান্সার সারাতে বা প্রতিরোধ করতে পারবে না। বরং হাঙ্গরের শরীরে উচ্চ মাত্রায় পারদ থাকার কারণে এতে মানবদেহের ক্ষতিই হবে। হাঙ্গরের যে জিন ক্যান্সার প্রতিরোধ করে সেই একই ধরনের জিন মানবদেহে ক্যান্সার ঘটার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এটা জানার পরও এই গবেষণা থেকে কিছু প্রলুব্ধকর সম্ভাবনা বেরিয়ে এসেছে। সেটা হচ্ছে ক্যান্সারের সঙ্গে সম্পর্কিত লেগুমেইন ও ব্যাগ ১ নামক জিন দুটোর উৎপাদিত প্রোটিন। হাঙ্গরের শরীরে ওই প্রোটিনগুলো পরিবর্তিত কাজ থাকে। সেই কাজগুলোর মধ্যে একটা সম্ভবত ক্যান্সার আক্রান্ত হওয়া থেকে এই প্রাণীগুলোকে রক্ষা করা। ব্যাগ ১ জিনটির কথাই ধরা যাক। এতে এমন এক প্রোটিনের সঙ্কেত থাকে যা মানুষের ক্ষেত্রে ‘প্রোগ্রামড্ সেল ডেথ’ নামে এক অপরিহার্য প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াকে বাধা দেয়ার কাজে যুক্ত। ব্যাপারটা গুরুত্বপূর্ণ এই কারণে যে প্রোগ্রামড্ সেল ডেথ প্রক্রিয়াটি অকেজো কোষগুলোকে নিশ্চিহ্ন করতে কাজ করে। আর ক্যান্সারের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো ক্যান্সারপুুষ্ট কোষগুলোর এই গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াটিকে ফাঁকি দিতে পারার ক্ষমতা। কাজেই ব্যাগ ১ এ হাঙ্গরের যে সুনির্দিষ্ট অভিযোজিত জিনটিকে রাখা যায় সেটি হয়ত বিকল্প কোন জিনের কিংবা এই গুরুত্বপূর্ণ নিজের সংশোধিত ভূমিকার নির্দেশনা দিতে পারে। আর সেটা এমন যা কিনা হাঙ্গরের ক্ষেত্রে প্রোগ্রামড্ সেল ডেথ বাধাগ্রস্ত করার প্রবণতা বদলে দিতে পারে। হাঙ্গরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার অভিনবত্বের শেষ এখানেই নয়। হাঙ্গরের বাস সাগরে। সাগরের জলরাশি নানা ধরনের ব্যাকটরিয়াপূর্ণ। এসব ব্যাকটেরিয়ার কারণে উন্মুক্ত ক্ষত স্থানে দ্রুত ইনফেকশন ঘটে যাও এই স্বাভাবিক। তাহলে হাঙ্গরের ক্ষতস্থানে দ্রুত ইনফেকশন না হয়ে উল্টো ক্ষতস্থানটি দ্রুত সেরে ওঠার ক্ষমতা আসে কোত্থেকে? এর ব্যাখ্যা কি? হাঙ্গরের ডিএনএ সিকোয়েন্সের মধ্যেই এর সূত্র রয়েছে। গবেষক দল লক্ষ্য করেছেন যে হাড়যুক্ত বা কাটাওয়ালা মাছের তুলনায় হাঙ্গর ও রেই মাছের পরীক্ষিত প্রজাতিগুলোর প্রতিরক্ষিকাযুক্ত রোগ প্রতিরোধে ব্যবস্থায় অধিকতর মাত্রায় জিনই যে শুধু আছে তা নয়, এদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থায় বেশ কিছু সংক্রমণরোধী জিনও আছে। আর সে জন্য হাঙ্গর ও রেই মাছের ক্ষতস্থানে সংক্রমণ তেমন একটা হয় না, বরং ক্ষতস্থান দ্রুত সেরেও উঠবে।
×