ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

জোড়া সেঞ্চুরিতে দাপটে শুরু ভারতের

প্রকাশিত: ০৫:৫৮, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

জোড়া সেঞ্চুরিতে দাপটে শুরু ভারতের

মিথুন আশরাফ, হায়দরাবাদ থেকে ॥ বাংলাদেশ অধিনায়ক মুশফিকুর রহীম ও ভারত অধিনায়ক বিরাট কোহলি টস করার জন্য এগিয়ে আসলেন। ড্রেসিংরুম থেকে এসে দুইজনই উইকেটে দাঁড়ালেন। ‘ঐতিহাসিক’ টেস্টে টস করার আগে দুই অধিনায়ক হাত মেলালেন। তখন তাদের মনে একটিই ভাবনা কাজ করেছে নিশ্চয়ই। হায়দরাবাদ টেস্টে টসটা যেন জেতা যায়। তাহলেই ম্যাচের ‘বাটন’ নিজেদের হাতে রাখা যাবে। টস জেতার ভাগ্য কোহলির কপালেই ধরা দিল। তাতে শেষ পর্যন্ত ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ প্রথমদিনেই নিজেদের হাতে নিয়েও নিল ভারত। মুরালি বিজয় ও চেতশ্বর পুজারার ১৭৮ রানের জুটির পর বিজয়ের ১০৮ ও বিরাট কোহলির অপরাজিত ১১১ রানে প্রথমদিনেই রানের পাহাড় গড়েছে ভারত। এরমধ্যেই ৩ উইকেট হারিয়ে ৩৫৬ রান করে ফেলেছে। মুশফিক আগেরদিনই বলেছিলেন, ‘ভারতের শুধু বিরাট কোহলি কিংবা রবিচন্দ্রন অশ্বিন নয়, পুরো দলই থ্রেট (হুমকি)।’ তাই ধরা দিল এবং কোহলিও বুঝিয়ে দিলেন তিনিই সেরা। এ মুহূর্তে বিশ্বের সেরা ব্যাটসম্যান বিরাট কোহলিকে ব্যাটিংয়ে নামতে হলো অনেক পরে। তার আগেই বিজয় ও পুজারা যা করার করে দিলেন। দিনের শুরুতে অবশ্য ভারতকে একটু চাপে ফেলা গেছে। প্রথম ওভারের চতুর্থ বলেই তাসকিন আহমেদের বলে আউট হয়ে যান লোকেশ রাহুল। তাসকিনের করা অফস্ট্যাম্পের বাইরের বল কাভার ড্রাইভ করতে গিয়ে বল ও ব্যাটের সংযোগ ঘটাতে পারেননি। ব্যাটের কানা ছুঁয়ে পায়ে লেগে বল স্ট্যাম্পে আঘাত হানে। তাতে ২ রানেই ভারতের এক উইকেটের পতন ঘটে। সকালে উইকেটে ঘাস ছিল। প্রথম দুইঘণ্টা পুরোদমে পেসাররা সুবিধা করে নিতে পারবে। সেই সুবিধা নিয়ে রাহুলকে আউট করেই তাসকিন এমনভাবে দুই হাত ছুড়ে দৌড় দিতে লাগলেন, তখন মনে হয়েছে কিছু একটা হতে চলেছে। মনে হয়েছে মুশফিক যে বলেছিলেন, ‘এমন খেলতে চাই, যেন বারবার ভারত আমাদের আমন্ত্রণ জানায়।’ তার কোন প্রভাবও হয়ত মিলতে যাচ্ছে। কিন্তু সব নিমিষেই মিলিয়ে গেল। মাঝপথে ১৮০ রানে পুজারাকে (৮৩) আউট করে দেন স্পিনার মেহেদী হাসান মিরাজ। বড় জুটি ভাঙ্গার আনন্দ হয় বাঁধভাঙ্গা। দুইবার আকাশে উড়াল দিতে চাইলেন। কিন্তু এরপর আর বাংলাদেশের জন্য সুসংবাদ ধরা দিল না। শুরুতে বিজয় ও পুজারা, এরপর বিজয় ও কোহলি, শেষে কোহলি ও আজিঙ্কেয়া রাহানে (৪৫) মিলে বাংলাদেশ ক্রিকেটারদের গায়ে যেন পেরেগ মেরেই যেতে থাকলেন। টস হারাটাই যেন কাল হয়ে দাঁড়াল। ২০০০ সালে নিজেদের ইতিহাসের প্রথম টেস্ট খেলে বাংলাদেশ। প্রতিপক্ষ ছিল ভারত। সেই ভারত কিনা ১৬ বছর পর বাংলাদেশকে টেস্ট খেলতে আমন্ত্রণ জানায়। ভারতের মাটিতে প্রথমবারের মতো টেস্টও খেলা শুরু করে দিয়েছে বাংলাদেশ। বেহাল দশায় থেকে প্রথমদিন শেষও করেছে। নিজেদের ইতিহাসের প্রথম টেস্টটিও ভারতের বিপক্ষে এক ম্যাচের টেস্ট সিরিজ দিয়ে খেলে বাংলাদেশ। যখন ভারতের মাটিতে প্রথমবারের মত টেস্ট খেলছে, সেটিও এক ম্যাচের টেস্ট সিরিজেই সমাপ্তি থাকছে। তবু ভারতের মাটিতে শেষ পর্যন্ত খেলাতো গেল। টেস্ট খেলুড়ে সবদেশেই খেলে ফেলেছিল বাংলাদেশ। শুধু ভারতের মাটিতে খেলাই বাকি ছিল। হায়দরাবাদ টেস্ট দিয়ে সব টেস্ট খেলুড়ে দেশের মাটিতে টেস্ট খেলার ‘চক্র’ও পূরণ হয়ে গেল বাংলাদেশের। বাংলাদেশের বিপক্ষে ২০০০ সালে টেস্ট দিয়েই টেস্টের নেতৃত্বের শুরু করেছিলেন কলকাতার মহারাজ, ভারতের সাবেক অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলী। তিনি ভারতের গণমাধ্যমে বলেছেন, ‘ভারতের মাটিতে প্রথমবারের মতো টেস্ট খেলছে বাংলাদেশ, হোক সেটি একমাত্র টেস্ট; এটি স্মরণীয় মুহূর্তই। বাংলাদেশের সামনেও এটা বিরাট সুযোগ ভারতে বড় ছাপ ফেলার। বাংলাদেশের একটা এ্যাডভান্টেজও আছে। সেটা হলো, পিচে বল ঘুরলে সেটার সুবিধা নেয়ার মতো বোলার ওদের আছে। যেটা ইংল্যান্ড বা অস্ট্রেলিয়ার মতো দলের সে রকম নেই।’ কিন্তু স্পিনটাতো উইকেটে ধরবে পরে। আগে তো ফিল্ডিং পাওয়ায় পেসটা দিয়েই আঘাত হানতে হবে। তাতেই দুর্বলতা ধরা পড়ে গেল বাংলাদেশের। দুই পেসার নিয়ে নেমেছে বাংলাদেশ। ঘাসের উইকেটে দরকার একজন সুইং করানোর মতো পেসার। রিভার্স সুইংও হতে পারত ভারতকে আতঙ্ক ধরিয়ে দেয়ার মোক্ষম অস্ত্র। কিন্তু সেটিই যে নেই। আবার পেসাররা টানা বল করে ক্লান্তও হয়ে পড়ে। তাই বাধ্য হয়েই যেন স্পিন বোলারদের দ্রুত নিয়ে আসতে হয়। আর তাইতো বিপদেও পড়তে হয়। গাঙ্গুলী যে বলেছেন, ‘আমার মনে হয় না ভারতকে এত সহজে বাংলাদেশ চ্যালেঞ্জ করতে পারবে।’ প্রথমদিনে চ্যালেঞ্জটা বাংলাদেশ করতেও পারেনি। যখন ভারতের সাবেক ক্রিকেটার, কোচ ও ধারাভাষ্যকার রবি শাস্ত্রীর মুখ দিয়ে বের হয়েছিল, ‘বাংলাদেশ পাত্তাই পাবে না, বাংলাদেশ এখনও টেস্ট খেলা শিখেনি’ ঘরানার কথা; তখন মনে হয়েছিল, তা কি আর হবে। ভারতের মাটিতে খেলা। উপমহাদেশের মতোই উইকেট। ব্যাটিং ও স্পিন যদি হয় ম্যাচে নিয়ামক, তাহলে দুই বিভাগে বাংলাদেশও তো ভাল। কিন্তু উইকেটে ঘাস থাকায় অন্তত প্রথম দিনটি সিমারদের দখলের আভাসই মিলল। টসের সময়ই উইকেট দেখে ভারতের কিংবদন্তি ব্যাটসম্যান সুনীল গাভাস্কার বলে দেন, ‘উইকেটে অনেক ঘাস। প্রথম দুইঘণ্টায় পুরোদমে পেসারদের দখলে থাকবে।’ তাসকিন সেই দাপট খানিক দেখিয়েছেনও। কিন্তু এরপর আর তা থাকেনি। পুরো দিনটিই ভারত ব্যাটসম্যানদের দখলে চলে যায়। হায়দরাবাদের উইকেট এমনই। প্রথম দুইদিন পুরোদমে ব্যাটিং করা যায়। ব্যাটসম্যান ভুল না করলে আউট করা কঠিন। তৃতীয়দিন থেকে স্পিনটা ধরে। তখন থেকেই স্পিনাররাই হয়ে ওঠেন ম্যাচের নিয়ন্ত্রক। ভারত টস জেতায় ব্যাটিং নিয়েছে তাই। সেই সুযোগটিও ভালভাবেই কাজে লাগাচ্ছে। উইকেটে ঘাস থাকায় সিমারদের সুবিধা হওয়ার কথা। কিন্তু বাংলাদেশ পেসাররা সেই সুবিধা নিতে পারেননি। তার মানে, ভারত তাদের পরিকল্পনায় পুরোটাই সফল হলো। আগে ব্যাটিং নিল। প্রথমদিনে কোহলির ১৪১ বলে ১২ চারে করা অপরাজিত ১১১, বিজয়ের ১৬০ বলে ১২ চার ও ১ ছক্কায় করা ১০৮, চেতশ্বর পুজারার ১৭৭ বলে ৯ চারে করা ৮৩ ও শেষে রাহানের করা ৬০ বলে ৭ চারে অপরাজিত ৪৫ রান বাংলাদেশকে ডুবিয়েই দিল বোধহয়। শেষে কোহলি ও রাহানে মিলেই চতুর্থ উইকেটে ১২২ রানের অবিচ্ছিন্ন জুটি গড়েন। আজ ম্যাচের দ্বিতীয়দিনে এ দুইজনই আবার ব্যাট হাতে নামবেন। আজ স্কোরবোর্ড যত মজবুত করা যায়, সেই ভাবনাই করছে ভারত। দুইদিন পুরো খেলে ৬০০ বা তার বেশি রান করার ভাবনা। কিংবা আজ দ্বিতীয়দিনে তৃতীয় সেশনের আগ পর্যন্ত খেলে ইনিংস ঘোষণাও করে দিতে পারে ভারত। তাতে যদি শেষ বেলায় বাংলাদেশের কয়েকটি উইকেট ফেলা যায়। তা নাহলেও তৃতীয়দিন থেকেই তো উইকেটে স্পিন ধরতে শুরু করবে। তাতে অশ্বিনের স্পিন অস্ত্র তো আছেই। সঙ্গে রবীন্দ্র জাদেজার স্পিন বিষও তো শক্তি। বাংলাদেশকে দ্রুত অলআউট করে দিতে পারার দিকেই নজর দেবে ভারত। যদি বাংলাদেশ ব্যাটসম্যানরা ব্যাট হাতে নিজেদের মেলে ধরতে না পারেন আর ভারত দ্রুত অলআউট করে দিতে পারে, তাহলে বাংলাদেশ তো বিপদেই পড়ে যাবে। যে বিপদের দেখা প্রথমদিনেই মিলছে। দুটি শতক ও দুটি বড় জুটিতে প্রথমদিনেই কাত হয়ে গেল বাংলাদেশ। কোহলিদের হাতে ম্যাচের ‘বাটন’ও চলে গেল।
×