ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০২ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১

সক্রিয় কতিপয় জ্যেষ্ঠ নেতা ও বুদ্ধিজীবী

সুবিধা আদায়ে কূটনৈতিক তৎপরতায় মনোযোগ দিচ্ছে বিএনপি

প্রকাশিত: ০৫:৫৯, ৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

সুবিধা আদায়ে কূটনৈতিক তৎপরতায় মনোযোগ দিচ্ছে বিএনপি

শরীফুল ইসলাম ॥ আন্দোলন করে বর্তমান সরকারের পতন ঘটানো যাবে না ধরে নিয়ে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রয়োজনীয় সুবিধা আদায় করতে কূটনৈতিক তৎপরতায় মনোযোগ দিচ্ছে বিএনপি। দলের মহাসচিবসহ ক’জন সিনিয়র নেতা এবং ক’জন জাতীয়তাবাদী বুদ্ধিজীবী এ তৎপরতায় সক্রিয় রয়েছেন। তারা ঢাকায় কর্মরত বিদেশী কূটনীতিকদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন। এছাড়া বিএনপি চেয়ারপার্সনের লন্ডনপ্রবাসী ছেলে ও দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানও বিভিন্ন মাধ্যমে কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করতে সচেষ্ট রয়েছেন। সূত্র মতে, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি রাজনৈতিকভাবে যে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে তা থেকে উত্তরণের পথ খুঁজছে দলীয় হাইকমান্ড। এরই অংশ হিসেবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন না করার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে তারা। এজন্যই যে নির্বাচন কমিশনের অধীনে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে সে কমিশন যাতে নিরপেক্ষ হয় সেজন্য এখন নানামুখী তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন। তাদের মতে নতুন নির্বাচন কমিশন মোটামুটি নিরপেক্ষ হলে আর কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে নির্বাচনকালীন সরকারকে যতটুকু সম্ভব চাপে রাখা গেলে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি ভাল ফল করবে। আর এ কারণেই বিএনপি এখন কূটনৈতিক তৎপরতার ওপর বেশি মনোযোগ দেয়ার কৌশল গ্রহণ করেছে। জানা যায়, সার্চ কমিটি গঠনের আগে থেকেই বিএনপি নতুন নির্বাচন কমিশন যাতে নিরপেক্ষ হয় সেজন্য কূটনৈতিক তৎপরতা চালাতে থাকে। আর এ কারণেই রাষ্ট্রপতি সার্চ কমিটি গঠনের পর বিভিন্ন দেশের কূটনৈতিকরা নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের জন্য তৎপর হয়ে ওঠে। এসব কূটনীতিক নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের বিষয়ে রাষ্ট্রপতির সঙ্গেও সাক্ষাত করতে চান। কিন্তু সরকারী দলের পক্ষ থেকে নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠনের বিষয়টি দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে মন্তব্য করা হলে কূটনীতিকরা এ বিষয়ে প্রকাশ্যে তৎপরতা না চালালেও ভেতরে ভেতরে এ নিয়ে সক্রিয় রয়েছেন বলে জানা গেছে। আর বিএনপি নেতারাও এসব কূটনীতিকের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন। উল্লেখ্য, ২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারি থেকে টানা ৯২ দিনের আন্দোলন ব্যর্থ হওয়ার পর রাজনৈতিকভাবে চরম বেকায়দায় পড়েন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। এরপর ওই বছর ১৬ সেপ্টেম্বর বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া লন্ডন সফরে যান। লন্ডনে অবস্থানকালে তার ছেলে ও দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে দলের ভবিষ্যত করণীয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। এ সময় তারা দলের জন্য সুবিধা আদায় করতে আন্দোলনের পরিবর্তে কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করার সিদ্ধান্ত নেন। এর পর থেকেই বিএনপির কিছু নেতা দেশে বিদেশে কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদারে অধিক সক্রিয় হয়ে ওঠেন। আর এ কাজে তাদের সহায়তা করেন ক’জন জাতীয়তাবাদী বুদ্ধিজীবী। কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করতে গিয়ে বিএনপি ভারতের সঙ্গেও সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করে। কিন্তু বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটে জামায়াত থাকায় ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করার ক্ষেত্রে বিএনপি সফল হয়নি। এমনকি বার বার ভারত সফরের জন্য চেষ্টা চালালেও ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাতের সিডিউল না পাওয়ায় ভারত সফরেও যাননি। তবে বিএনপি যে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের পথে বেশিদূর অগ্রসর হতে পারবে না তা ধরে নিয়েই আপাতত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের মাধ্যমে দলের জন্য সুবিধা আদায়ের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ায় বিএনপির কূটনৈতিক তৎপরতা কিছুটা হোঁচট খেলেও আবার নতুন উদ্যমে তৎপরতা জোরদার করা হচ্ছে । জানা যায়, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, লে. জেনারেল (অব) মাহবুবুর রহমান, ড. আব্দুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, ভাইস চেয়ারম্যান মোর্শেদ খান, মীর মোহাম্মদ নাসির, ড. ওসমান ফারুক, চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা রিয়াজ রহমান ও সাবিহউদ্দিন আহমেদ বিভিন্ন দেশের কূটনৈতিকদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন। এছাড়া গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক ড. ইউনূস, বেসরকারী সংস্থা গণস্বাস্থ্যের প্রতিষ্ঠাতা ডাঃ জাফরউল্লাহ চৌধুরী ও উবীনিগের ফরহাদ মাজহার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক এমাজউদ্দিন আহমদসহ দেশের কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তিও বিএনপির পক্ষে কূটনৈতিক তৎপরতা চালাচ্ছেন বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, সৌদি আরব, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বিএনপির কমিটিতে যারা আছেন তারাও প্রভাবশালী বিদেশী প্রতিনিধিদের সঙ্গে লবিং করে বিএনপির জন্য সুবিধা আদায়ের চেষ্টা চালাচ্ছেন। এ কাজে সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করছেন লন্ডনে অবস্থানরত বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান। আর বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকরা যখন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাত করতে যান তখন তিনি নিজেও তাদের কাছে দলের অবস্থান তুলে ধরার চেষ্টা করেন। বিশেষ করে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যাতে ভোটাররা নির্বিঘেœ ভোট দিতে পারে সেজন্য সবার সহযোগিতা চান। প্রসঙ্গত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বেশ আগে থেকেই বিএনপি নির্দলীয় সরকারের দাবি আদায়সহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কূটনৈতিক তৎপরতা চালাতে শুরু করে। এতে তখন কিছুটা সফলও হয় দলটি। আর এ কারণেই কিছু প্রভাবশালী দেশ বিএনপির দাবি নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের পক্ষে কথা বলে। এক পর্যায়ে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঠেকিয়ে দেবে বলে বিভিন্ন প্রভাবশালী দেশের কূটনীতিকদের আশ্বাসে নির্বাচন বর্জন করে। কিন্তু আওয়ামী লীগ নির্বাচনের পর সরকার গঠন করে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের কৌশল জোরদার করে পরিস্থিতি নিজেদের অনুকূলে রাখতে সক্ষম হয়। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জনের পর রাজনৈতিকভাবে চরম বেকায়দায় পড়ে আবারও কূটনীতিকদের সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধি করে বিএনপি কিন্তু কূটনীতিকরা বিএনপিকে আশার বাণী শোনানো ছাড়া আর কিছুই করতে পারেননি। প্রতিটি দেশের কূটনীতিকই বিএনপিকে বলছেন সরকারী দলের সঙ্গে অর্থবহ সংলাপের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করতে। কিন্তু বিএনপির পক্ষ থেকে সংলাপের চেষ্টা করা হলেও আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে ৫ বছর মেয়াদ শেষে পরবর্তী যে নির্বাচন হবে তা নিয়ে সংলাপ হতে পারে। সরকারী দলের এ অবস্থানের কারণে সার্চ কমিটি গঠনের আগে সংলাপ করতে চেয়েও পারেনি বিএনপি। তবে বিএনপি সার্চ কমিটি গঠনের আগে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপ করে নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠনে দলীয় প্রস্তাব দিয়েছে। এর আগে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলের ভরাডুবির পরও কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়ায় বিএনপি। কূটনৈতিকদের পরামর্শে তখন তৃণমূল পর্যায় থেকে দলের কমিটি পুনর্গঠনের চেষ্টা করেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। কিন্তু দল গোছাতে গিয়ে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে। সারাদেশে জেলা-উপজেলাসহ বিভিন্ন স্তরের তৃণমূল কমিটি গঠন নিয়ে নেতাকর্মীরা দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়ে পড়ে। একপর্যায়ে কেন্দ্র থেকে বিভিন্ন জেলার আহ্বায়ক কমিটি গঠন করে দেন দলের হাইকমান্ড। কিন্তু এসব কমিটিকে কেন্দ্র করে দলে মতবিরোধ বেড়ে যাওয়ায় সরকারবিরোধী আন্দোলন জোরদার করতে পারেনি দলটি। তখন কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়েও সুবিধা করতে পারেনি বিএনপি। তবে গত বছর ১৯ মার্চ জাতীয় কাউন্সিল করার পর কেন্দ্রীয়ভাবে বিএনপিকে কিছুটা চাঙ্গা করা গেলেও তৃণমূল পর্যায়ে সাংগঠনিক দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে পারেনি বিএনপি। এজন্যই এখন আর আন্দোলন সফল করা যাবে না ভেবে কূটনৈতিক তৎপরতায় মনোযোগী হওয়ার কৌশল গ্রহণ করা হয়েছে। জানা যায়, ভারতের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের সম্ভাবনা না থাকলেও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে আবারও চেষ্টা চালিয়ে দেখতে চায় বিএনপি হাইকমান্ড। এজন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপও নেয়া হবে। এর আগে ২০১২ সালে (২৮ অক্টোবর থেকে ৩ নবেম্বর) ভারত সফরে গেলে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ করার কথা বলা হয়। কিন্তু খালেদা জিয়া সে পরামর্শ গ্রহণ না করায় তার প্রতি ভারতের বিভিন্ন মহল নাখোশ হয় বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করছেন। তবে যুদ্ধাপরাধের বিচারে জামায়াতের প্রভাবশালী নেতাদের ফাঁসি হয়ে যাওয়ায় এখন জামায়াতের প্রতি ভারতের সেই কঠোর অবস্থান নাও থাকতে পারে বলে বিএনপির কোন কোন নেতা মনে করছেন। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব) মাহবুবুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, বিএনপি দেশের একটি জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল। অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে এ দল আবারও রাষ্ট্রক্ষমতায় যাবে। কিন্তু দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে সে নির্বাচনে জনগণ ভোট দিতে পারবে কি না আশঙ্কা থেকেই যায়। তাই আমরা চাই প্রথমত একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠিত হোক। তারপর নির্বাচনকালীন সরকার যাতে অবাধ ও সুষ্ঠু ভোটের পরিবেশ নিশ্চিত করে সে দিকে আমরা বেশি মনোযোগী হবো। প্রয়োজনে এ বিষয়ে বিদেশী কূটনীতিকদেরও সহযোগিতা চাওয়া যেতে পারে। দেশের গণতন্ত্রের স্বার্থে বিদেশী কূটনৈতিকরা যদি কোন পদক্ষেপ নেন তাতে কারও আপত্তি থাকার কথা নয়।
×