ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

দিনেশ মাহাতো

হারিয়ে যাচ্ছে আলকাপ গান

প্রকাশিত: ০৫:২৬, ২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

 হারিয়ে যাচ্ছে আলকাপ গান

আলকাপ গান বাংলাদেশের সংস্কৃতির একটি ঐতিহ্য। বহু আগে থেকে গ্রামীণ বাংলায় এই গান মানুষকে বিনোদন দিয়ে আসছে তবে বর্তমানে এ গান গ্রাম বাংলাতেও তেমন একটা দেখা যায় না। আলকাপ মূলত সঙ্গীতধর্মী নাট্যনুষ্ঠান এবং তা রাজশাহী অঞ্চলের গান। রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁর কিছু এলাকা, পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ, বীরভূম ও মালদহ অঞ্চলে এই গানের প্রচলন আছে। এ গান পালাগানের একটি শাখা। এই গানের উদ্ভব কোথায়, কীভাবে হয়েছিল তা সঠিক করে বলা এক দুরূহ ব্যাপার। অনেকে গম্ভীরাকে আদি আলকাপ গানের একটা শাখা হিসেবে মনে করে থাকে। তবে আলকাপ গান নিয়ে প্রখ্যাত লেখক ও প্রাবন্ধিক সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ একটি সুন্দর প্রবন্ধ লিখেন ১৯৮২ সালে দেশ পত্রিকায়। তাঁর প্রবন্ধের নাম ছিল ‘আলকাপ, নাট্যরীতি এবং আর্ট থিয়েটার’। তারপর থেকেই আলকাপ গানের পরিচিতি বেড়ে যায় এবং অনেক মানুষের মনে এ গান নিয়ে আগ্রহ তৈরি হয়। সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের মতে, আলকাপ নামের উৎপত্তি বা জন্ম সম্ভবত উত্তরবঙ্গেই। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘চৈতালিক’ নামের যে উপন্যাস তা আলকাপকে নিয়েই। কারও মতে সংস্কৃতি ‘কাপট্য’ থেকে কাপ এসেছে। গ্রাম সমাজে কাপ কথাটা অতি পরিচিত। কেউ ন্যাকামি করলে অথবা রঙ্গরস প্রদর্শন করলে এখনো বলা হয়, ‘থাম আর কাপ করিসনে’। আলকাপ গান নিয়ে এখন পর্যন্ত কোন গবেষণা হয়নি, তাই এর উৎস সম্পর্কে বিভিন্ন ধারণা ও মত রয়ে গেছে। আলকাপ গানের দলের প্রধানকে সরকার বলা হয়। তার সঙ্গে থাকে একজন ভাঁড়। আলকাপের ভাষায় যাকে বলা হয় ‘ক্যাপ্যাল’। ক্যাপ্যালের চরিত্র সব সময় দুই ভাই হিসেবে অভিনয় করে থাকে। দলে থাকে দু’জন পুরুষ যারা নর্তকি (ছোকরা নামে পরিচিত) সেজে নাচ গান আর অভিনয় করে থাকে। এ এই ছোকরা বাছাই করা তত সহজ নয়। কেননা এদের মুখশ্রী থাকতে হবে, গানের গলা থাকতে হবে। এ দুটো প্রাথমিক শর্ত। তাছাড়া তাকে নাচও শিখতে হবে। মেয়েদের মতো চলতে বলতে হবে। এককথায় এ চরিত্রটি কঠিনই বলা চলে। গানের দলে থাকে কয়েকজন যন্ত্রবাদক। যন্ত্রীরা বসে বসে ডুগি-তবলা, জুড়ি, হারমোনিয়াম ও বাঁশিসহ নানা যন্ত্র বাজান। আর সরকার, ছোকরা ক্যাপ্যাল অভিনয় করেন আসরের মাঝখানে। আলকাপ গান শুরু হয় মূলত গভীর রাতে চলে সকাল পর্যন্ত, কখনও কখনও দুপুর পর্যন্ত চলে এ গান। গানের আসরের চারদিকে দর্শক বসে থাকে তারাও দুই দলের কোন এক দলের সমর্থক। যাত্রার গানের আসরের মতো কোন প্রবেশ পথ থাকে না। সচরাচর দুটি দলের মধ্যে পাল্লা দিয়ে গান হয়ে থাকে। এক দলের অনুষ্ঠান শুরু করে। এভাবে পালাক্রমে অনুষ্ঠান চলতে থাকে। তবে একেকটি আসর দুই থেকে দিন ঘণ্টা দীর্ঘায়িত হয়ে থাকে। তবে দুটি দলের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলে বিভিন্নভাবে যেমন দুই দলের প্রধান বা সরকারের মধ্যে ও দুই দলের ছোকরা অথবা নর্তকিদের মাঝে। এক পক্ষ অন্য পক্ষকে গানের মধ্য দিয়ে ঘায়েল করে থাকে। এ গানের এক দলের সরকার অন্য দলের সরকারের উদ্দেশে বন্দনার মাধ্যমে কিছু প্রশ্ন ছুড়ে দেয়। সাধারণত দলের ওস্তাদ বা সরকারই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বন্দনা গেয়ে থাকেন। বেশিরভাগ আলকাপ গানে দেখা যায় যে শিবের বন্দনা গাওয়া অনেকটা বাধ্যতামূলক। সরকার যখন বন্দনা গায় তখন অন্যপক্ষের বা দলের সদস্যরাও তা মনোযোগ দিয়ে শুনে থাকে। কেননা বন্দনার মাঝেই প্রতিপক্ষ দলকে বা সরকারকে প্রশ্ন করে থাকেন চলমান পালার সরকার। পরের আসরে যখন তাদের পালা আরম্ভ হবে তখন আবার বন্দনার মাধ্যমেই তার যৌক্তিক উত্তর দিতে হবে। এভাবেই একের পর এক পালা চলতে থাকে। তবে একসময়ের জনপ্রিয় আলকাপ গান এখন অনেকটা হারাতে বসেছে। এ গানের অনেক শিল্পী প্রয়াত। ও এ গানের আয়োজন এখন তেমন একটা দেখা যায় না এর ফলে শিল্পীরাও আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও রাজশাহী এলাকায় হাতে গোনা কয়েকটি দল কোন মতে এখনও টিকে আছে। স্বাধীনতার আগে চাঁপাইনবাগঞ্জ অঞ্চলে এক হাজার থেকে এক হাজার ২০০টি আলকাপ গানের দল ছিল। এখন মাত্র ২০ থেকে ২৫ টি দল রয়েছে। এই গানের শিল্পী-সাধকরা মেহনতি মানুষ। কেবল নিজের আনন্দে এই গানকে টিকিয়ে রেখেছে তাঁরা। মূলত পৃষ্ঠপোষকতা নেই বলে সংস্কৃতির এই সম্পদ হারাতে বসেছে আজ। চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও রাজশাহী এলাকায় আলকাপ গানের কয়েকটি স্বনামধন্য দলের মধ্যে তানোরের শ্রীকান্ত সরকার, হেমু সরকার, আব্দুস সালাম কেরামত সরকার, মহারাজপুরের এসলাম সরকার, নাচোলের চেরু সরকারের দলগুলো অন্যতম। শ্রীকান্ত সরকারের জানান, এ গানের প্রতি আগ্রহ এখনও মানুষের আছে। তাছাড়া এ গানের মধ্য দিয়ে সমাজের অনেক অসংলগ্ন দিক ফুটে ওঠার পাশাপাশি মানুষকে সচেতন করে তোলে এই গানে। তিনি আরও বলেন, সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এই গানকে আরও জনপ্রিয় করে তোলা সম্ভব।’ আলকাপ গানকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য সরকারের পৃষ্ঠপোষকতার দাবি জানান তিনি। তাছাড়া শুধু আলকাপ গান নয় আরও বিভিন্ন ধরনের আঞ্চলিক গান রয়েছে যেগুলো আজ হারাতে বসেছে। এগুলো আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি। এসব সংস্কৃতিই একটি জাতির পরিচয় বহন করে থাকে। তাই জাতীয় স্বার্থেই আমাদের সংস্কৃতিগুলো টিকিয়ে রাখা উচিত।
×