ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

এবার বৃক্ষ মানবী ১০ বছরের সাহানা

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

এবার বৃক্ষ মানবী ১০ বছরের সাহানা

জান্নাতুল মাওয়া সুইটি ॥ দশ বছর বয়সী সাহানা আর পাঁচ-দশটি শিশুর মতোই। কিন্তু হঠাৎ তার নামের আগে কেন বৃক্ষমানবী শব্দটি চলে এলো? নেত্রকোনার কলমাকান্দা উপজেলার বালুরচরে কৃষক বাবার সঙ্গে বাস তার। মা ছাড়া সংসারে বাবা শাহজাহানের শেষ ভরসা মেয়ে এবং মেয়ের ভরসা বাবা। দিনমজুরি করেও মেয়েকে লেখাপড়া শেখানোর আশায় গ্রামের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তিও করেছেন। সাহানা এখন তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্রী। বাবা-মেয়ের সংসারে সবকিছুই ঠিক ছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই বাবার একমাত্র আদরের মেয়ে সাহানা একটি বিরল রোগে আক্রান্ত হয়েছে, যে রোগটির কারণে আজ এই শিশুটি বৃক্ষমানবী হিসেবে পরিচিত হয়েছে। রবিবার ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন এ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে সাহানাকে ভর্তি করা হয়েছে। মঙ্গলবার বার্ন ইউনিটের ষষ্ঠ তলার গ্রীন ইউনিটে সরেজমিন গিয়ে দেখা গেল, একটি বেডে বসে আছে বৃক্ষমানবী এ শিশুটি। তার মুখজুড়ে গাছের শিকড়ের মতো কিছু একটা বের হয়েছে। সাহানা বলল, ‘আমি ক্লাস থ্রিতে পড়ি। বাবার সঙ্গে থাকি। আমার মা নেই। আগে মুখের এগুলো ছোট ছিল, ব্যথাও ছিল না। কিন্তু এখন বাড়ছে। মুখে হাত দিলে ব্যথা লাগে।’ কথাগুলো বলে আবারও এদিক-ওদিক কৌতূহলী মনে তাকাতে শুরু করল শিশুটি। তার চোখ-মুখে নেই কোন ক্লান্তির ছাপ। মাত্র ৬ বছর বয়সে মাহারা এ মেয়েটির পাশে আজ বাবা ছাড়া সান্ত¡না দেয়ার মতো কেউ নেই। তবে তার কথা শুনে মনে হলো সে অনেক আত্মবিশ^াসী। মেয়ের সামনে বাবা ঠায় বসে আছেন। তার চোখ-মুখে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। সাহানার বাবা শাহজাহান জনকণ্ঠকে বললেন, ‘সাহানার মা গত চার বছর আগেই মারা গেছে। আমি দিনমজুরির কাজ করে কোন রকমে সংসার চালাই। হঠাৎ আমার মেয়ের শরীরে এ কোন রোগ বাসা বাঁধল! ছোটবেলা থেকেই মুখে আঁচিলের মতো কালো কালো দাগ ছিল। ভাবতাম ঠিক হয়ে যাবে। গত তিন মাসের মধ্যে আমার মেয়ের মুখের সেই কালো দাগ বাড়তে শুরু করল। এখন তো দেখতে অনেকটা শিকড়ের মতোই দেখায়। অনেক ভয় পেয়েছিলাম। কিন্তু গ্রামের মানুষ আমাকে অনেক সাহায্য করেছে। কিছুদিন আগে সাহানার মতো একই রোগে আক্রান্ত হয়ে এক লোক এ হাসপাতালে ভর্তি ছিল। তাই এলাকার সবাই মিলে বলল এখানে এসে চিকিৎসা করাতে। ডাক্তার বলেছেন, দেড় মাসের মতো এখানে থাকতে হবে। সাহানার রোগ নাকি এখনও অল্প, সেরে যাবে।’ সাহানার শারীরিক অবস্থা প্রসঙ্গে ঢামেকের বার্ন ইউনিটের প্রকল্প পরিচালক অধ্যাপক ডাঃ আবুল কালাম জনকণ্ঠকে বলেন, ‘বৃক্ষমানবের পর এবার আমরা বৃক্ষমানবীর দেখা পেলাম। বৃক্ষমানব হিসেবে পরিচিত আবুল বাজানদারের মতো ‘ট্রিম্যান সিনড্রোম’ রোগের শিকার সাহানা। তবে বাজানদারের মতো অতটা গুরুতর অবস্থায় এখনও পৌঁছায়নি সাহানার রোগটি। সাহানাকে আগামী সপ্তাহখানেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হবে। আশা করছি, দুই-তিনটি অস্ত্রোপচারের মাধ্যমেই সাহানা সুস্থ হয়ে উঠবে। তবে রোগটি পুনরায় দেখা দেবে কি-না তা পর্যবেক্ষণের জন্য বেশ কয়েক মাস সাহানাকে হাসপাতালে থাকতে হবে। আমাদের সকলেরই হয়ত মনে আছে বৃক্ষমানব আবুল বাজানদারের কথা। ২০১৬ সালের জানুয়ারি মাসের শেষদিকে দীর্ঘ দশ বছর ‘ট্রিম্যান সিনড্রোম’ রোগে ভুগে ঢামেকে ভর্তি হন তিনি। এরপর বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে দীর্ঘ সময় ধরে তার পনেরোটি অস্ত্রোপচার হয়। অবশেষে তার হাত ও পায়ের শিকড় কয়েক দফায় কেটে ফেলার মাধ্যমে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে যায় পাইকগাছার বৃক্ষমানব আবুল বাজানদার। চিকিৎসকরা বৃক্ষমানবের চিকিৎসা শুরু করার পর এ ধরনের রোগেকে ’ট্রিম্যান সিনড্রোম’ বলে বর্ণনা করেছিলেন। বিরল এ রোগ পৃথিবীতে এর আগে মাত্র তিন-চারজনের হয়েছিল বলে বাংলাদেশের চিকিৎসকরা জানতে পেরেছেন। এবার বাংলাদেশে এ বিরল রোগের রোগী হিসেবে পাওয়া গেল সাহানাকে। শীঘ্রই সাহানা সুস্থ হয়ে আর পাঁচটি শিশুর মতোই স্বাভাবিক জীবনযাপন করবে বলে প্রত্যাশা সকলের।
×