ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মুনতাসির সিয়াম

ওরাইনার উপলব্ধি

প্রকাশিত: ০৬:০১, ২৮ জানুয়ারি ২০১৭

ওরাইনার উপলব্ধি

ওরাইনার বয়স তেরো বছর। বাবা মার সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ায় থাকে সে। কিন্তু খুব শীঘ্রই তারা দেশে ফিরে আসবে। ওরাইনার বাবা এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আসলে তার দাদি খুব অসুস্থ হওয়ায় মায়ের কথা ভেবে সেখানকার ব্যবসাপত্র গুটিয়ে বরাবরের মতো বাংলাদেশে ফেরার এই সিদ্ধান্ত ওরাইনার বাবার। ওরাইনার মাও ভারি খুশি। অস্ট্রেলিয়ায় তার একদমই ভাল লাগে না। আপনজনদের ছেড়ে আর কতকাল বিদেশে পড়ে থাকবেন তারা! কিন্তু ওরাইনা মোটেও খুশি নয়। তার জন্মের দু’বছর পরই তারা বাংলাদেশ থেকে চলে এসেছে। বলতে গেলে বাংলাদেশকে চোখেও দেখেনি সে। তারা একেবারে চলে আসবে শুনে স্কুলের বন্ধুরা তাকে উপহাস করে বলেছে, তুই ওখানে কি করে থাকবি? ওরাইনা এমন প্রশ্ন শুনে বেশ ঘাবড়েই গেছে। বন্ধুদের কাছে জানতে চেয়েছে, কেন ওখানে কি মানুষ থাকে না? উত্তরে বন্ধুরা বলেছে, অবশ্যই থাকে। তবে সেখানকার পরিবেশ খুব নোংরা। গাদাগাদা মানুষ আর ঘরবাড়িতে ভর্তি। রাস্তাঘাটে যানজট, ঠিকমতো বিদ্যুত থাকে না। এছাড়াও আরও নানান ঝামেলাতো আছেই। এসব শুনে ওরাইনা আরও ঘাবড়ে গেছে। সত্যিই তো এমন জায়গায় কি করে থাকবে সে! বাবা মাকে বুঝিয়ে বলার পরও তারা উল্টো তাকেই বুঝিয়েছে যে, দেখ মা বাংলাদেশ অস্ট্রেলিয়ার মতো অতটা উন্নত না, একটু সমস্যাতো হবেই। তবে নিজের দেশ সবসময় নিজেরই হয়। বাধ্য হয়েই বাবা মার সঙ্গে দেশে ফিরতে হলো ওরাইনাকে। এয়ারপোর্ট থেকে বাড়ি ফিরতেই যানজটে দিনের অর্ধেকটা পেরিয়ে গেল। রাতে তারা খেতে বসেছে এমন সময় হঠাৎই লোড শেডিং হওয়ায় ওরাইনা এবার বন্ধুদের কথা মনে করে হতাশই হলো। তার যে গরম সহ্যই হয় না। এমন সময় চাচি ঘরের জানালা খুলে দেয়ায় সঙ্গে সঙ্গে শীতকালের ফুরফুরে শীতল হাওয়া এসে ওরাইনার শরীর জুড়িয়ে দিল। তবে সময়টা শীতকাল হলেও আবহাওয়া বেশ হালকা ঠা-া। যার জন্য এবার সে বাবার দিকে তাকিয়ে উৎফুল্লভাবেই বলে উঠল, আহ, কি সুন্দর বাতাস তাইনা বাবা!- হ্যাঁ, দেখেছ মা, এ বাতাসে কোন কৃত্রিমতা নেই। রাতে দাদা দাদির সঙ্গে ঘুমোতে গেল ওরাইনা। দাদা জিজ্ঞেস করলেন, গল্প শুনবে দাদু ভাই? ওরাইনা বিস্ময় স্বরে জবাব দিল, তুমি গল্প বলতে পার? দাদু এবার মুচকি একটু হেসে দিলেন। বললেন, এদেশের সব দাদুরাই গল্প বলতে পারে। চলো আজ তোমাকে একটা বোকা জোলার গল্প শোনাব। মুগ্ধ হয়ে গল্প শুনছে ওরাইনা। আর ভাবছে এত মিষ্টি এবং চমৎকার হতে পারে কোন গল্প! অথচ সে এতদিন যে ইংরেজী গল্পগুলো পড়ে খুব মজা পেয়েছে, সেগুলো এর কাছে কিছুই নয়। গল্প শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ে ওরাইনা। পরের দিন সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর চাচা তাকে নিয়ে বাজারে গেল। আসলে চাচা বলেছেন, আজ থেকে সে যা খেতে চাইবে, তাই বাজার থেকে কিনে আনা হবে। রাস্তায় বেরিয়ে ওরাইনা লক্ষ্য করল যত লোক যাচ্ছে আসছে সবাই সবার সঙ্গে হাসি মুখে কথা বলছে। অথচ অস্ট্রেলিয়ায় খুব পরিচিত হলে হাই হ্যালো দিয়ে সবাই চলে যেত। ব্যাপারটা কত চমৎকার যে সবাই সবার খোঁজ খবর নিচ্ছে। দুদিন পর ওরাইনাকে গ্রামের বাড়ি দেখতে নিয়ে গেল বাড়ির সকলে মিলে। গ্রামে ঢুকতেই ওরাইনা অবাক! এ যেন এক অন্য বাংলাদেশ। চারদিকে সবুজ আর সবুজ গাছপালা। গ্রামের পাশ দিয়ে আকাবাঁকা নদী বয়ে যাচ্ছে। সবাই তাকে খুব আদর করছে। অথচ আজই গ্রামের সবাই তাকে প্রথম দেখছে। পরের দিন পাখির কিচির মিচির শব্দে খুব ভোরে ঘুম ভাঙল ওরাইনার। উঠে দেখে বাড়ির বারান্দায় সকলে একত্রে কি যেন খুব মজা করে খাচ্ছে! ওরাইনা জানতে চাওয়ায় বাবা উত্তর দিলেন, এটা ভাপা পিঠা, মামনি। তুমিও খাও খুব মজার পিঠা। শীতের সময় এদেশের সবাই এই পিঠা খায়। ওরাইনা খেয়ে দেখল সত্যিই ভাপা পিঠা তার প্রিয় বার্গারের থেকেও অনেক স্বাদের। এর পর চাচা তাকে টাটকা খেঁজুরের রস খেতে দিলে ওরাইনার কাছে এত ভাল লেগেছে যে, সে পরপর আরও দু’গ্লাস খেঁজুরের রস খেয়েছে। এখন বাংলাদেশ সম্পর্কে ধারণা পাল্টে গেছে ওরাইনার। মনে মনে বলছে একটু আধটু সমস্যা সব জায়গাতেই থাকে। কিন্তু এত সুন্দর আর আন্তরিক দেশের তুলনা হয় না। এ যেন সত্যিই আমার সোনার বাংলাদেশ। অলঙ্করণ : আইয়ুব আল আমিন
×