ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

রফতানি বাণিজ্যে স্বস্তি ফিরেছে ॥ খুশি বাণিজ্যমন্ত্রী

ট্রাম্পের টিপিপি ছাড়ার সিদ্ধান্ত আমাদের জন্য ভাল হয়েছে ॥ মুহিত

প্রকাশিত: ০৫:৩৬, ২৬ জানুয়ারি ২০১৭

ট্রাম্পের টিপিপি ছাড়ার সিদ্ধান্ত আমাদের জন্য ভাল হয়েছে ॥ মুহিত

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ আলোচিত ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারশিপ (টিপিপি) চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্র বেরিয়ে যাওয়ায় বাংলাদেশের রফতানি বাণিজ্যে স্বস্তি ফিরে এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে গার্মেন্টস পণ্য রফতানি নিয়ে শুল্কজনিত যে সঙ্কট তৈরি হচ্ছিল তা থেকে রক্ষা পেল বাংলাদেশ। চুক্তিটি অকার্যকর হয়ে যাওয়ায় প্রায় ১৭ শতাংশ বাড়তি শুল্ক আর গুনতে হবে না। এ কারণে রফতানিতে শীর্ষে থাকা পোশাক খাতে নতুন বিনিয়োগ বাড়ানোর স্বপ্ন দেখছেন উদ্যোক্তারা। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, ট্রাম্পের এ সিদ্ধান্ত আমাদের জন্য ভাল হয়েছে। আমাদের লাভই হবে। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে গার্মেন্টস পণ্য রফতানিতে অসম প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হতে হবে না। জানা গেছে, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার পরই ডোনাল্ড ট্রাম টিপিপি চুক্তি বাতিলের ঘোষণা দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি বলেছিলেন, দায়িত্ব নেয়ার প্রথম দিনে এই চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসবে যুক্তরাষ্ট্র। ট্রাম তাঁর কথা রেখেছেন, টিপিপি থেকে বেরিয়ে এসেছে যুক্তরাষ্ট্র। এই চুক্তিটির প্রস্তুতি পর্যায় থেকে অস্বস্তিতে ছিল সরকার ও উদ্যোক্তারা। তাদের আশঙ্কা ছিল, এই চুক্তি কার্যকর হলে বাংলাদেশের গার্মেন্টস পণ্য রফতানিতে বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্র বেরিয়ে যাওয়ায় আশার আলো দেখছেন গার্মেন্টস খাতের ব্যবসায়ীরা। বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ টিপিপি বাতিল হওয়ায় খুশি। তিনি জানান, এই চুক্তি থেকে ট্রাম্প সরে আসায় চাপমুক্ত হলো দেশের রফতানি বাণিজ্য। জানা গেছে, এ চুক্তিতে বাংলাদেশের বড় আশঙ্কা ছিল ভিয়েতনাম ঘিরে। চুক্তিটি কার্যকর হলে ভিয়েতনাম যুক্তরাষ্ট্রে শুল্কমুক্ত রফতানি সুবিধা পেলেও বাংলাদেশকে ১৭ শতাংশ বাড়তি শুল্ক-কর পরিশোধ করতে হতো। পোশাক রফতানিতে ভিয়েতনাম বাংলাদেশের বড় প্রতিযোগী। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোক্তারাও ভিয়েতনামে বিনিয়োগে এগিয়ে এসেছেন। এমনকি বাংলাদেশের বড় বড় কয়েকটি গার্মেন্টস গ্রুপও ভিয়েতনামে বিনিয়োগের কথা চিন্তাÑভাবনা করছিল। পোশাক খাতের ব্যবসায়ীরা জানান, টিপিপি হওয়ার পর থেকে চীনের অনেক ব্যবসায়ী ভিয়েতনামে বিনিয়োগ করতে শুরু করেন। একইভাবে যুক্তরাষ্ট্রে ব্র্যান্ড ও ক্রেতা প্রতিষ্ঠান ভিয়েতনাম থেকে পণ্য কেনা বাড়াতে থাকে। এসব উদ্যোগের কারণ ছিল টিপিপি বাস্তবায়ন শুরু হলে পণ্য আমদানি ও রফতানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা আদায় করা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, টিপিপি চুক্তি কার্যকর হলে বাংলাদেশ অসম প্রতিযোগিতার মুখে পড়ত। টিপিপিভুক্ত প্রতিযোগী দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শুল্কমুক্ত রফতানি সুবিধা পেলেও বাংলাদেশকে সেখানে উচ্চ হারে শুল্ক দিয়ে প্রবেশ করতে হতো। ফলে দেশটিতে বাংলাদেশের রফতানি বাণিজ্য মার খাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ রফতানিকারক সমিতির সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী জনকণ্ঠকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সরে যাওয়া মানে হচ্ছে টিপিপির ভবিষ্যত অনিশ্চিত হয়ে পড়া। যদি বাকি সদস্য দেশ তা আর এগিয়ে না নেয়। এটাও গুরুত্বপূর্ণ যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া এ চুক্তি অর্থহীনও। এখন যুক্তরাষ্ট্র না থাকায় টিপিপির যেসব সুবিধা পাওয়ার কথা, সেগুলো আর হচ্ছে না। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ এলডিসিভুক্ত দেশ হিসেবে অন্য এলডিসিভুক্ত প্রতিযোগীদের সঙ্গে সমান বাণিজ্য সুবিধা পাবে। ফলে প্রতিযোগী দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশকে আর অসুস্থ প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হতে হবে না। এদিকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও এ চুক্তির আওতায় ছিল জাপান, কানাডা, ব্রুনাই, চিলি, নিউজিল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া, মেক্সিকো, পেরু ও ভিয়েতনাম। চুক্তি স্বাক্ষরকারী ১২ দেশ বিশ্বের অর্থনীতির প্রায় ৪০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে। আর এসব দেশে মোট জনসংখ্যা প্রায় ৮০ কোটি। প্রসঙ্গত, গত ২৩ জানুয়ারি সোমবার প্রেসিডেন্টের নির্বাহী আদেশে টিপিপি থেকে যুক্তরাষ্ট্র বেরিয়ে আসার ঘোষণা দেয়। ফলে এই চুক্তিটির বাস্তবায়ন কার্যত অচল হয়ে গেল। চুক্তিটি স্বাক্ষরের সময়ও যুক্তরাষ্ট্রে তীব্র বিরোধিতার মুখে পড়েছিল ওবামা সরকার। যুক্তরাষ্ট্রে এই চুক্তির বিরোধীদের মূল যুক্তি ছিল, এটি মার্কিন শ্রমবাজার, এমনকি সার্বভৌমত্বের ওপরও বিরূপ প্রভাব ফেলবে। অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী এ প্রসঙ্গে জানান, টিপিপিভুক্ত দেশগুলোকে যে বাজার সুবিধা দেয়ার লক্ষ্য ছিল সেটি আর হচ্ছে না। ফলে প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের পিছিয়ে পড়ার আশঙ্কা কমেছে। এদিকে টিপিপির ফলে বাংলাদেশের রফতানি বাণিজ্য কেবল যুক্তরাষ্ট্রে নয়, টিপিপিভুক্ত আরও কয়েকটি দেশেও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল। জাপান, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার বাজারে বাংলাদেশের কঠিন প্রতিযোগিতার মুখে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত বছর যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পোশাক রফতানি হয়েছে ৫০০ কোটি ডলারের। গত ২০১৩ সালে পরিমাণ ছিল ৫২৯ কোটি ডলার। এক বছরে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পোশাক রফতানি কমেছে ৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ। একইভাবে কানাডায়ও ২০১৩ সালে রফতানি ছিল ১০০ কোটি ডলার। পরের বছর তা নেমেছে ৯৩ কোটি ডলারে। টিপিপির ওপর ভর করে যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রফতানির উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল ভিয়েতনাম। এ প্রসঙ্গে পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, টিপিপি চুক্তি বাতিল হওয়ায় পোশাক রফতানি নিয়ে যে শঙ্কা তৈরি হয়েছিল তা দূর হয়েছে। চুক্তিটি স্বাক্ষর হওয়ার পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের অনেকে ভিয়েতনামের সঙ্গে ব্যবসা বাড়িয়ে দিয়েছিল। বাংলাদেশী উদ্যোক্তারা অসম প্রতিযোগিতায় পড়েছিল। এর ফলস্বরূপ যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে গত কয়েক মাসে বাংলাদেশের রফতানি কমলেও ভিয়েতনামের বেড়েছে। আশা করা হচ্ছে, রফতানিতে এখন সমান সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত হবে।
×