ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

পিইসি ও জেএসসি পরীক্ষার ফল হস্তান্তর

জঙ্গীবাদের কুফল সম্পর্কে শিশুদের সচেতন করতে হবে ॥ প্রধানমন্ত্রী

প্রকাশিত: ০৫:৩২, ৩০ ডিসেম্বর ২০১৬

জঙ্গীবাদের কুফল সম্পর্কে শিশুদের সচেতন করতে হবে ॥ প্রধানমন্ত্রী

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, সন্ত্রাস-জঙ্গীবাদের কোন স্থান বাংলাদেশে থাকবে না। এটা সবাইকে স্মরণ রাখতে হবে। শিক্ষার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের বিশেষ করে ছোট শিশুদের জঙ্গীবাদের কুফল সম্পর্কে সচেতন করতে হবে। কোনমতেই যেন কোমলমতি শিশুদের মনে সন্ত্রাস-জঙ্গীবাদ গেঁথে না যায়, সে ব্যাপারে সবারই সজাগ থাকা প্রয়োজন। শিশুদের বোঝাতে হবে আমরা শান্তিপ্রিয় জাতি, আমরা শান্তি চাই। সন্ত্রাস এবং জঙ্গীবাদের পথ কখনও ইসলামের পথ হতে পারে না। সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী জনমত গড়ে তোলা এবং এর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানান তিনি। বৃহস্পতিবার সকালে গণভবনে চলতি বছরের প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি) এবং জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) এবং সমমানের পরীক্ষার ফল গ্রহণকালে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে তিনি আরও বলেন, আমরা শান্তি চাই, সুন্দর ও উন্নত জীবন চাই। আর এজন্য সকলের সহযোগিতা প্রয়োজন। ইসলামে যে জঙ্গীবাদ ও সন্ত্রাসবাদের কোন স্থান নেই সে বিষয়গুলো সকলকে বোঝাতে প্রধানমন্ত্রী সকল অভিভাবক, মসজিদের ইমাম, শিক্ষকসহ সকল শ্রেণী-পেশার মানুষের প্রতি অনুরোধ জানান। প্রধানমন্ত্রী বলেন, পৃথিবী এগিয়ে যাচ্ছে। সবাই এগিয়ে যাবে, কেউ পিছিয়ে থাকবে না। সেটাই তো স্বাভাবিক। আর কোন দেশে যদি সে দেশের রাজাকার, আলবদর এবং তাদের দোসররা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকে তারা তো দেশকে এগোতে দেবে না। পিছিয়েই রাখবে। সেটাই ঘটেছিল বাংলাদেশের বেলায়। তারা এ দেশটাকে একটা ব্যর্থ রাষ্ট্র করতে চেয়েছিল। তাদের সে ষড়যন্ত্র এতদিনেও কিন্তু শেষ হয়নি। পিইসি এবং জেএসসি পরীক্ষা আয়োজনের যৌক্তিকতা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ পরীক্ষা ভবিষ্যতের জন্য শিক্ষার্থীদের মাঝে আত্মবিশ্বাসের সৃষ্টি করছে। যে আত্মবিশ্বাস বোর্ডের উচ্চতর পরীক্ষাগুলোতে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের কাজে লাগবে। তিনি বলেন, ‘আমি জানি না তারা (অভিভাবকরা) পরীক্ষার ফল দেখেন কি-না। পড়ালেখার ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের আত্মবিশ্বাস বাড়ছে এবং জনগণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি হয়েছে। এটা খুব জরুরী।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা আয়োজনের পেছনে আরেকটি কারণ ছিল, তা হচ্ছে ছাত্রছাত্রী, শিক্ষার্থীদের বোর্ড পরীক্ষার ভীতি দূর করা। এ পরীক্ষা দেয়ার পর ছোট বাচ্চারা যখন একটি সার্টিফিকেট পাচ্ছে তখন তার মনে হচ্ছে কিছু তো একটা করা হলো। এ সার্টিফিকেট শিক্ষার্থীর সারাজীবনের সঞ্চয় হয়ে থাকল এবং তার ভেতর একটি আত্মবিশ্বাসের সঞ্চার করবে। এর মাধ্যমে লেখাপড়ার প্রতি শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের এক ধরনের বাড়তি সচেতনারও সৃষ্টি হয়েছে। কয়েকদিন আগেই পিইসি এবং জেডিসি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে কিনা- এ বিষয়ে দেশে বিতর্কের অবতারণা হয় উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘একটা সময়ে লোকজন এ ধরনের পরীক্ষা আয়োজনের পক্ষে ছিল না। তবে আমার মনে হয় জনগণকে এ ধরনের পরীক্ষা আয়োজনের কারণটা বোঝাতে হবে। আমি বুঝি না কেন তারা এর প্রয়োজনীয়তাটা বুঝতে পারছেন না।’ এর আগে পঞ্চম এবং অষ্টম শ্রেণীর জন্য দেশে বৃত্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হতো এবং স্বল্পসংখ্যক মেধাবী শিক্ষার্থীই এসব পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ পেত উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বর্তমান নিয়মে সব ছেলেমেয়েই পরীক্ষা দেবে। সেখান থেকে যারা মেধাবী-দরিদ্র তাদের যে নিয়মে বৃত্তি দেয়া হয় তাদের বৃত্তির জন্য বেছে নেয়া হবে। তিনি বলেন, একটা ক্লাসে যদি ৪০ জন ছাত্রছাত্রী থাকে সেখান থেকে ১০ জনকে বেছে নেয়া হয় বৃত্তির জন্য। তারা আলাদাভাবে পড়াশোনা করবে, তাতে অন্যসব ছেলেমেয়ে তো ভাল শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সেখানেও তো ভাল ছেলেমেয়ে থাকতে পারে, তারা কেন বঞ্চিত হবে? প্রধানমন্ত্রী বলেন, দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ যদি গড়তে হয় তাহলে সবচেয়ে আগে দরকার শিক্ষিত জনগোষ্ঠী। তাছাড়া আজকের বিশ্বটা প্রতিযোগিতামূলক একটি বিশ্ব। এ প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে আমাদের ছেলেমেয়েদেরও সেভাবে শিক্ষাগ্রহণ করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা আমাদের দেশকে উন্নত ও সমৃদ্ধশালী করে গড়ে তুলতে চাই। সেটা করতে গেলে আমাদের বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে। আমরা মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জন করেছি। আমরা বিজয়ী জাতি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আমরা এ স্বাধীনতা অর্জন করেছি। তাই সমগ্র বিশ্বে আমরা মর্যাদার সঙ্গে চলতে চাই। আমরা কারও কাছে নতি স্বীকার করতে চাই না। বিজয়ী জাতি হিসেবে আমাদের নিজেদেরই বিশ্বে মর্যাদার আসনে তুলে ধরতে হবে। ইতিহাস বিকৃতির ষড়যন্ত্র এবং পঁচাত্তরপরবর্তী সময়ে দেশকে স্বাধীনতার উল্টোরথে চড়িয়ে দেয়ার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, একটা দীর্ঘ সময় আমাদের জীবন থেকে হারিয়ে গেছে। পঁচাত্তরে জাতির পিতাকে যখন হত্যা করা হলো তারপর থেকে যারা ক্ষমতায় ছিল তারা কখনও এ দেশের স্বাধীনতা চায়নি। তারা যুদ্ধাপরাধী। যারা আমাদের নারী-শিশুদের মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যা করেছে, নির্যাতন করেছে, বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে শিশু হত্যা করে তারা মৃতদেহ দেয়ালে টাঙিয়ে তার মধ্যে পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা জুড়ে দিয়েছে। এভাবে অত্যাচার-নির্যাতন যারা করেছিল তাদের মন্ত্রী করা হয়েছে, সংসদ সদস্য করা হয়েছে, ভোট চুরি করে তাদের ক্ষমতায় আনা হয়েছে। এটা আমাদের জন্য অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের। ২১টি বছর আমাদের এ নরক যন্ত্রণায় ভুগতে হয়েছে। শেখ হাসিনা বলেন, ২১ বছর পর ’৯৬ সালে যখন আমরা সরকার গঠন করি তখন দেখি আমাদের সাক্ষরতার হার অত্যন্ত কম। মাত্র ৪০-৪৫ ভাগ সাক্ষরতার হার ছিল, তখনই আমরা একটা উদ্যোগ নেই প্রত্যেক জেলাকে আমাদের নিরক্ষরতামুক্ত করতে হবে। কেউ যেন আর নিরক্ষর না থাকে এ ধরনের একটা কর্মসূচী আমরা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেই এবং সাক্ষরতার হার ২০ শতাংশ বাড়িয়ে ৪৫ ভাগ থেকে ৬৫ ভাগ করি। এজন্য ইউনেস্কো সে সময় বাংলাদেশকে পুরস্কৃতও করেছিল। অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের বিষয়, ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে ৭ বছর পর আবার সরকার গঠন করে দেখি ওই সাক্ষরতার হার আবার কমে গেছে। আবার ৪৪ থেকে ৪৫ শতাংশে নেমে গেছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারে থাকলে দেশ পুরস্কার পায় আর বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় এলে দেশ তিরস্কৃত হয়। প্রধানমন্ত্রী বলেন, সংসদীয় গণতন্ত্রে সরকার পরিবর্তন একটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। কিন্তু জনগণের কল্যাণের জন্য যেসব পদক্ষেপ আমরা হাতে নিচ্ছি সেগুলোর ধারাবাহিকতা বজায় থাকবে না কেন? সেটার সুফল জনগণ পাবে না কেন? তিনি বলেন, ভাল কাজ যেগুলো জনগণের কল্যাণে আমরা করে গিয়েছিলাম দেখা গেল যে, একেক করে সেসব কর্মকা- বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। বিদ্যুত উৎপাদন আমরা বৃদ্ধি করেছিলাম, সেটাও কমালো। এমনকি খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা আমরা অর্জন করেছিলাম, সেটা কমিয়ে পুনরায় দেশে খাদ্য ঘাটতি করা হলো। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা ৪০ লাখ মেট্রিক টন খাদ্য ঘাটতি নিয়ে ১৯৯৬ সালে সরকার গঠনের পর ২০০১ সালে যখন আমরা ক্ষমতা হস্তান্তর করি তখন আমাদের খাদ্য উদ্বৃত্ত ছিল ২৬ হাজার মেট্রিক টন। আবার ২০০৯ সালে যখন সরকার গঠন করি তখন দেখি বাংলাদেশ আবার ৩০ লাখ মেট্রিক টন খাদ্য ঘাটতির দেশ। যারা সরকারে ছিল তারা সব সময় লক্ষ্য রেখেছে আমদানি করলে ভাল ব্যবসা করতে পারবে, সেদিকে। কৃষকদের খাদ্য উৎপাদনে যেসব সুযোগ-সুবিধা আমরা দিয়েছিলাম সেসব একে একে বন্ধ করে দেয়ায় দেশে আবারও খাদ্য ঘাটতি দেখা দিল। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৯৬ সালে ক্ষমতা গ্রহণের আগে দেশে বিদ্যুত ছিল ১৫শ’ মেগাওয়াট। সেখান থেকে আমরা বিদ্যুৎ উৎপাদন দ্রুত বৃদ্ধির উদ্যোগ নিয়ে বিদ্যুত উৎপানের পরিমাণ ৪ হাজার ৩শ’ মেগাওয়াট করলাম। ২০০৯ সালে ক্ষমতা গ্রহণের সময় আবার দেখলাম বিএনপি-জামায়াত সরকার ৪ হাজার ৩শ’ মেগাওয়াট থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমিয়ে আবারও ৩ হাজার ২শ’ মেগাওয়াট করে ফেলেছে। শেখ হাসিনা বলেন, তার সরকার ২০০৯ সালে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এসে সকল ক্ষেত্রে পরিকল্পনামাফিক উন্নয়নের পদক্ষেপ নেয়, যার ফলে দেশ আজ অনেকটা এগিয়েছে। সমগ্র বিশ্বে আজ বাংলাদেশ উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী তার উন্নয়নের খ-চিত্র তুলে ধরে বলেন, আমরা আমাদের জাতীয় প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ১১ ভাগে উন্নীত করতে সমর্থ হয়েছি, যা বিশ্বের অনেক দেশের কাছেই বিস্ময়। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা থেকে শুরু করে দারিদ্র্য বিমোচন, মানুষের কর্মসংস্থানে বাংলাদেশ এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছি। খাদ্যের জন্য আজ আর কারও কাছে হাত পাততে হয় না। আমরা কারও কাছে ভিক্ষা চেয়ে চলব কেন? আমরা তো স্বাধীন জাতি। প্রধানমন্ত্রী এ সময় দেশের দক্ষ জনশক্তির কথা উল্লেখ করে বলেন, তাদের ভালভাবে শিক্ষা-দীক্ষা দিয়ে যথাযথভাবে গড়ে তুলতে পারলে আমরা আর দরিদ্র থাকব না। প্রধানমন্ত্রী ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের বাংলাদেশ এবং ২০৪১ সাল নাগাদ উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করে বলেন, সন্ত্রাস-জঙ্গীবাদের স্থান কোনদিন বাংলার মাটিতে হবে না। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ জেএসসি এবং জেডিসি (জুনিয়র দাখিল সার্টিফিকেট) পরীক্ষার ফল প্রধানমন্ত্রীর হাতে তুলে দেন। অন্যদিকে প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান পিইসি এবং ইবতেদায়ী পরীক্ষার ফল প্রধানমন্ত্রীর নিকট হস্তান্তর করেন। এ সময় সকল শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান এবং শিক্ষা ও প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
×