ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বিপজ্জনক পথে দেশান্তরী হতে গিয়ে এ বছর সাড়ে ৪ হাজার মানুষ মারা গেছেন ॥ অভিবাসী দিবসের আলোচনায় বক্তারা

এক কোটি বাংলাদেশী অভিবাসী ১৬২ দেশে কাজ করছেন

প্রকাশিত: ০৫:১৬, ১৯ ডিসেম্বর ২০১৬

এক কোটি বাংলাদেশী অভিবাসী ১৬২ দেশে কাজ করছেন

স্টাফ রিপোর্টার ॥ নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে পালিত হয়েছে আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবস। রবিবার সকাল সাড়ে আটটায় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজা থেকে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র পর্যন্ত বর্ণাঢ্য র‌্যালির মাধ্যমে দিবসের কার্যক্রম শুরু হয়। দিবসটিকে কেন্দ্র করে দিনব্যাপী আলোচনা সভা, সিআইপি সম্মাননা প্রদান ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়েছে। এবারের অভিবাসী দিবসে ‘অভিবাসী মেলার’ আয়োজন করা হয়েছিল। মেলায় ৫০ আর্থিক ও ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান, অভিবাসী বিষয়ক সরকারী, বেসরকারী ও আন্তর্জাতিক সংস্থা, রিক্রুটিং এজেন্সিসহ ৬০ প্রতিষ্ঠান অংশগ্রহণ করে। আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবস উপলক্ষে সকালে আয়োজিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী নূরুল ইসলাম বিএসসি বলেন, বর্তমান সরকার অভিবাসন প্রক্রিয়ার মানোন্নয়ন ও অভিবাসী কর্মীদের কল্যাণ নিশ্চিত করতে কাজ করে যাচ্ছে। এ জন্য এবারের আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবসের প্রতিপাদ্য ‘উন্নয়নের মহাসড়কে-অভিবাসীরা সবার আগে’। এই সেøাগান সামনে নিয়ে আমরা প্রবাসী কর্মীদের মর্যাদা ও সম্মান জানাচ্ছি। প্রবাসী কর্মীরা তাদের মেধা, শ্রম ও নিরলস প্রচেষ্টায় দেশের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন। প্রচলিত প্রশিক্ষণ কার্যক্রমকে আধুনিকায়ন ও উন্নত দেশের উপযোগী এবং স্বীকৃত মানে নিয়ে যেতে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে। এ সব বিষয়ে উন্নয়ন সহযোগীরা আমাদের প্রয়োজনীয় সহায়তা দেয়ার আশ্বাস দিয়েছে। বাংলাদেশের কারিগরি শিক্ষা উন্নত দেশগুলোসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে স্বীকৃতি পেলে আমাদের প্রশিক্ষিত কর্মীদের জন্য অধিকহারে কর্মসংস্থান হবে এবং তারা দেশের উন্নয়নে সম্পৃক্ত হতে পারবেন। আলোচনা অনুষ্ঠানে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী মালয়েশিয়ায় অবস্থানরত প্রবাসী কর্মীদের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। এ সময় মালয়েশিয়ার কর্মীদের বিভিন্ন সমস্যার কথা শোনেন। তাদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব শামছুন নাহারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর মহাপরিচালক সেলিম রেজা। বিশেষ অতিথি ছিলেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মোঃ শাহরিয়ার আলম, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন, ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের মহাপরিচালক গাজী মোহাম্মদ জুলহাস, আইওএমের মিশন প্রধান শরৎ চন্দ্র দাস প্রমুখ। অনুষ্ঠানে দুই অভিবাসী কর্মী ঢাকার সাভারের ফাতেমা বিবি ও গাজীপুরের টঙ্গীর মিলন খান বিদেশে থাকাকালীন সাফল্য ও অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন। আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবসে জনশক্তি রফতানি সঙ্গে যুক্ত দেশের ১২ ব্যবসায়িকে সিআইপি সম্মাননা দেয়া হযেছে। এর মধ্যে ১০ জনকে বৈধ চ্যানেলে বৈদেশিক মুদ্রা প্রেরণকারী হিসেবে ও ২ জনকে বিদেশে বাংলাদেশী পণ্যের আমদানিকারক হিসেবে এ সম্মাননা দেয়া হয়। সিআইপিদের মধ্যে সিলেটের মোহাম্মদ মাহতাবুর রহমান ও চট্টগ্রামের মোহাম্মদ সেলিম আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন। এ ছাড়া প্রবাসী কর্মীর সন্তানদের ৪ ক্যাটাগরিতে ৪ ছাত্রছাত্রীকে শিক্ষাবৃত্তির চেক হস্তান্তর করেন প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রী। ২০১৬ সালে মোট ৪ ক্যাটাগরিতে এক হাজার ৭৬ ছাত্র-ছাত্রীকে প্রায় দেড় কোটি টাকা শিক্ষাবৃত্তি দেয়া হযেছে। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, অভিবাসন বিষয়টি এখন আর একক কোন দেশের বিষয় নয়। বিশ্বব্যাপী অভিবাসন হচ্ছে। নানা কারণে শরণার্থী হিসেবে মানুষ এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাচ্ছেন। এ বছর বিপজ্জনক পথে এক দেশ থেকে অন্য দেশে যেতে সাড়ে ৪ হাজারের বেশি মানুষ মারা গেছেন। অভিবাসন প্রক্রিয়ার মান উন্নয়ন ও অভিবাসী কর্মীদের কল্যাণ নিশ্চিত করতে বিভিন্নমুখী কার্যকরী উদ্যোগ হাতে নেয়া হয়েছে। বিশ্ব শ্রমবাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কর্মী নিয়োগ করা হবে। আমরা বিশ্বব্যাপী সুষ্ঠু, নিরাপদ ও ন্যায় সঙ্গত অভিবাসনের জন্য বৈশ্বিক নীতিমালা চাই। যে কথা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘের ৭১তম অধিবেশনে উল্লেখ করেছেন। বাংলাদেশই প্রথম দেশ-অভিবাসন নিয়ে বৈশ্বিক নীতিমালার প্রস্তাব করেছে। যে কারণে সম্প্রতি ঢাকায় গ্লোবাল ফোরাম অন মাইগ্রেশন এন্ড ডেভেলপমেন্টের (জিএফএমডি) সম্মেলন শেষে ‘গ্লোবাল কম্প্যাক্ট’ গঠনের ঘোষণা দেয়া হয়েছে। এই কম্প্যাক্ট গঠন হলে অভিবাসন প্রক্রিয়া অনেকাংশে সহজ হবে। বাংলাদেশের কর্মীদের বিদেশে অনেক চাহিদা রয়েছে। চাহিদা মেটাতে উন্নত প্রশিক্ষণ দিয়ে কর্মীদের তৈরির কাজ সরকার করে যাচ্ছে। দক্ষ কর্মী রফতানি বাড়লে দেশের রেমিটেন্স প্রবাহ অনেক বেশি বৃদ্ধি পাবে। আলোচনা সভায় বক্তারা বলেন, আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবস বাংলাদেশের জন্য তাৎপর্যপূর্ণ। গত ৮ থেকে ১২ ডিসেম্বর ঢাকাতে প্রথমবারের মতো নবম ‘গ্লোবাল ফোরাম অন মাইগ্রেশন এন্ড ডেভেলপমেন্টের (জিএফএমডি)’ শীর্ষ সম্মেলন সফলভাবে শেষ হয়েছে। এই সম্মেলনে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ১২৫ দেশ ও ৩০ সংস্থার কয়েক শ’ প্রতিনিধি অংশ নেন। সরকারী, বেসরকারী, আন্তর্জাতিক সংস্থা ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরাও এতে অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। জিএফএমডি শীর্ষ সম্মেলন সফলভাবে অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি অনেকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। সম্মেলন শেষে অভিবাসন সম্পর্কে সর্বসম্মতিক্রমে ‘গ্লোবাল কম্প্যাক্ট’ গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে অভিবাসন সেক্টরে ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। বর্তমানে প্রায় ১ কোটি বাংলাদেশের নাগরিক অভিবাসী হিসেবে ১৬২ দেশে সুনামের সঙ্গে কাজ করছেন। এ বছর ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৭ লাখ ২২ হাজার ১শ’ কর্মীর বিদেশে কর্মসংস্থান হয়েছে। আশা করা হচ্ছে এ সংখ্যা প্রতিবছর বৃদ্ধি পাবে। মালয়েশিয়া, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের শ্রম বাজার পুনরায় চালু করার মাধ্যমে বৈদেশিক কর্মসংস্থানের সুযোগ আরও সম্প্রসারিত হবে। বাজার খোলার জন্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট দেশের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করা হচ্ছে। বিকালের আলোচনা সভায় প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে ছায়া সংসদ বিতর্ক, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের মধ্যে পুরস্কার বিতরণ করেন। ‘বাংলাদেশের অর্থনীতি শক্তিশালীকরণে অভিবাসীদের অবদান’ শীর্ষক বিতর্কে আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবসের গুরুত্ব ও তাৎপর্য তুলে ধরে অভিবাসন প্রক্রিয়াকে আরও স্বচ্ছ ও জবাবদিহি করতে এই ছায়া সংসদটির আয়োজন করে ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি। এই অনুষ্ঠানের সার্বিক তত্ত্বাবধানে ছিল প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ওভারসিজ এমপ্লয়মেন্ট এ্যান্ড সার্ভিসেস লিমিটেড (বোয়েসেল)। যুক্তি নির্ভর সমাজ বিনির্মাণের অংশ হিসাবে আয়োজিত এই মক পার্লামেন্টে সরকারী দল হিসাবে বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি অব ফ্যাশন এ্যান্ড টেকনোলজি এবং ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অংশ নেয়। এই অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাকের চেয়ারম্যান এমএ সবুর, ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির চেয়ারম্যান হাসান আহমেদ চৌধুরী, বোয়েসেলের এমডি মরণ কুমার চক্রবর্তি। অনুষ্ঠানে সভাপতি ছিলেন প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব বেগম শামছুন নাহার।
×