ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১

উপেক্ষিত মেডিক্যাল ট্যুরিজম

ওষুধ রফতানিকারক দেশের মানুষ বিদেশে ছোটে চিকিৎসার জন্য

প্রকাশিত: ০৬:২৫, ৬ ডিসেম্বর ২০১৬

ওষুধ রফতানিকারক দেশের মানুষ বিদেশে ছোটে চিকিৎসার জন্য

হাসান নাসির ॥ ভ্রমণ এবং চিকিৎসা দুটোই একসঙ্গে। এরই নাম ‘মেডিক্যাল ট্যুরিজম’। মেডিক্যাল ট্যুরিজমÑ এই ধারণাটাই এখনও গুরুত্ব পায়নি বাংলাদেশে। বিশ্বের ১৩৩টি দেশে ওষুধ রফতানি করে বাংলাদেশ। কিন্তু এদেশের লাখ লাখ মানুষ বিদেশে যায় উন্নত চিকিৎসার জন্য। অথচ সরকারী-বেসরকারী পর্যায়ে গুরুত্ব সহকারে উদ্যোগ নিলে বাংলাদেশও হতে পারে মেডিক্যাল ট্যুরিজমের অন্যতম গন্তব্যে। কেননা এদেশে রয়েছে সমুদ্র সৈকত, সবুজের সমারোহ এবং নানা বৈচিত্র্য। ২০২১ সালের মধ্যে যে দেশ মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হবার স্বপ্ন দেখছে সে দেশের বিদেশনির্ভরতা কমে আসা উচিত বলে মনে করেন নাগরিক সমাজ। এর জন্য শুধু প্রয়োজন পরিকল্পনা এবং বাস্তবে রূপদানে পারঙ্গমতা। পর্যটন ধীরে ধীরে বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে বড় শিল্পে রূপ নিচ্ছে। বাংলাদেশে এখনও শিল্পরূপ না পেলেও রয়েছে পর্যটনে অপার সম্ভাবনার হাতছানি। তবে একেবারেই উপেক্ষিত এবং পরিকল্পনার বাইরে রয়ে গেছে মেডিক্যাল ট্যুরিজম। প্রতিবেশী ভারত, আমাদের কাছের দেশ মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ও সিঙ্গাপুরে যাওয়া পর্যটকদের একটি বিরাট অংশই মেডিক্যাল ট্যুরিজমের আওতাভুক্ত। বেড়ানোর পাশাপাশি চিকিৎসা ও মেডিক্যাল চেকআপটা সেরে আসা, এটিই থাকে অনেক পর্যটকের লক্ষ্য। বিভিন্ন পরিসংখ্যান এবং অনুসন্ধান বলছে, বাংলাদেশ থেকে বছরে যে বিপুল পরিমাণ নাগরিক ভারতে যান তাদের অধিকাংশেরই মূল উদ্দেশ্য চেকআপ এবং চিকিৎসা। বিশেষ করে কলকাতা এবং দক্ষিণ ভারতের চেন্নাই, ভেলোর ও বেঙ্গালোরে যারা যাচ্ছেন তাদের প্রায় শতভাগ ভ্রমণই চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট। দক্ষিণ ভারতের তিনটি শহরে অবস্থিত এ্যাপোলো হসপিটাল, সিএমসি হসপিটাল, নারায়ণী হসপিটাল এবং নারায়ণ হৃদয়ালয়ের রোগীদের একটি বিরাট অংশ বাংলাদেশের নাগরিক। সেখানে এদেশের রোগীর ভিড় একটাই যে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশীদের জন্য আলাদা কাউন্টার ও পৃথক ব্যবস্থা রেখেছে। মালয়েশিয়া ক্রমেই মেডিক্যাল ট্যুরিজমের অনেক বড় একটি গন্তব্যে পরিণত হয়েছে। অপেক্ষাকৃত কম ব্যয়ে চিকিৎসা সেবা ও চেকআপের ব্যবস্থা থাকায় সুদূর ইউরোপ এবং মধ্যপ্রাচ্য থেকে হাজার হাজার পর্যটক ছুটে আসছেন। থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককও চিকিৎসাপ্রত্যাশীদের অন্যতম প্রধান গন্তব্য। বামুনগ্রাদ, ব্যাংকক হসপিটাল ও ভেসথানি হসপিটালসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে নিয়মিত সেমিনার-সিম্পোজিয়াম করে চলেছে। ক্যাম্পেইনের উদ্দেশ্য রোগীদের আকৃষ্ট করা। রোগীদের সাড়াও পাচ্ছে দেশগুলো। কারণ একটাইÑচিকিৎসার পাশাপাশি ভ্রমণের আনন্দ। বাংলাদেশ খুব উন্নত দেশ না হলেও একেবারে দরিদ্রও নয়। তা না হলে এত লোক বিদেশে যাই কীভাবে? ওষুধ শিল্পের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এদেশের চিকিৎসা সেবা সেভাবে এগোয়নি। পরিকল্পিতভাবে কোন শহরকে চিকিৎসা সেবার জন্য বিশেষায়িত করা হয়নি। বিদেশগামীদের একটি অংশ আভিজাত্যের কারণেই বাইরে চিকিৎসা নিয়ে থাকেন, এটি সত্য। তবে বেশিরভাগই দেশে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকায় সীমান্ত পাড়ি দিতে বাধ্য হন। বিশেষ করে বাংলাদেশে চেকআপের ওপর আস্থা রাখতে না পেরে একেবারে দূরদেশ না হলেও নিদেনপক্ষে ভারত গমনের সিদ্ধান্ত নেন। যে দেশে মানসম্পন্ন ওষুধ তৈরি হয় সে দেশে আন্তর্জাতিকমানের চিকিৎসা অবকাঠামো গড়া কঠিন নয় বলেই মনে করেন বোদ্ধা মহল। ভারতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শহর হিসেবে বিবেচনা করা হয় দিল্লী, মুম্বাই ও কলকাতাকে। কিন্তু লক্ষণীয় যে, বড় বড় হাসপাতাল ও চিকিৎসা কেন্দ্রগুলোর অধিকাংশই গড়ে উঠেছে দক্ষিণ ভারতের সাগর তীরবর্তী প্রদেশগুলোতে। অর্থাৎ ঐতিহাসিক স্থাপনা দেখতে দিল্লী, আগ্রা, মুম্বাই, কলকাতা ও জয়পুর। আর চিকিৎসা সেবার জন্য তামিলনাড়ু, বেঙ্গালোর এবং অন্ধ্র প্রদেশের হায়দ্রাবাদ। কিন্তু বাংলাদেশের সবই কেন্দ্রীভূত রাজধানী ঢাকায়। উন্নত চিকিৎসা সেবার বিকেন্দ্রীকরণ হয়নি স্বাধীনতার ৪৫ বছরেও। সারাদেশের সকল জেলা থেকে ছুটতে হয় ঢাকা অভিমুখে। রাজধানীতে চিকিৎসা সেবার উন্নত ব্যবস্থা থাকা অবশ্যই আবশ্যক। কিন্তু তা দিয়ে তো মেডিক্যাল ট্যুরিজম হয় না। ঘিঞ্জি পরিবেশ পর্যটনের জন্য আদর্শ নয়। পর্যটনের জন্য চাই খোলা হাওয়া ও খোলামেলা পরিবেশ। মেডিক্যাল ট্যুরিজম ধারণাকে বাস্তবে রূপ দিতে প্রয়োজন কক্সবাজারের মতো এলাকা নির্বাচন করা। অথচ সেখানে উন্নতমানের কোন হসপিটালই নেই। চিকিৎসা ও ভ্রমণের জন্য সকল দিক থেকেই আদর্শ স্থান হতে পারে এই সৈকত নগরী। কেননা বিদেশীদের প্রতি কক্সবাজারের আবেদন স্বাভাবিকভাবে বেশি হওয়ার কথা। কারণ পৃথিবীর দীর্ঘতম স্যান্ডিবিচ এখানেই। সরকার বিলম্বে হলেও কক্সবাজারের একটি আন্তর্জাতিক স্টেডিয়াম করেছে, যেখান থেকে লাইভ টেলিকাস্টে সাগরের উত্তাল ঢেউ তুলে ধরা সম্ভব। কক্সবাজারে আন্তর্জাতিকমানের হসপিটাল ছাড়া বলতে গেলে আর সবই আছে। এটি হোটেলের নগরীও বটে। ছোট বড় অসংখ্য হোটেল রয়েছে কক্সবাজারে। একেবারে স্বল্প ভাড়ার বোর্ডিং থেকে শুরু করে তারকামানের হোটেলও রয়েছে। দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসার জন্য রোগী ও স্বজনদের অবস্থান করতে হয়। পর্যাপ্ত হোটেল থাকায় সে সমস্যা নেই বলা চলে। কক্সবাজার ছাড়াও আরও স্থান বেছে নেয়া যেতে পারে চিকিৎসা সেবার জন্য। তবে এই শহরটি অনেকটাই প্রস্তুত সেবাপ্রত্যাশীদের ধারণ করতে।
×