ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

পাঁচ চমকপ্রদ উদ্ভাবন ফিরোজ শিকদারের ॥

ঘরে মানুষ থাকলে বাল্ব জ্বলবে, বের হয়ে যাওয়া মাত্রই বন্ধ

প্রকাশিত: ০৫:৩৩, ২ ডিসেম্বর ২০১৬

ঘরে মানুষ থাকলে বাল্ব জ্বলবে, বের হয়ে যাওয়া মাত্রই বন্ধ

এমদাদুল হক তুহিন ॥ সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছেন- কোন রকম স্পর্শ ছাড়াই জ্বলে উঠবে লাইট। একইভাবে সিঁড়ি অতিক্রম শেষে তা বন্ধ হবে আপনা আপনি। ঘরে মানুষ থাকলে বাল্ব জ্বলবে, বের হয়ে যাওয়া মাত্রই তা বন্ধ হয়ে যাবে স্বয়ংক্রিয়ভাবে। বিদ্যুত সাশ্রয়ী এমন এলইডি সেন্সর লাইট উদ্ভাবন করে চমকে দিয়েছেন ইলেক্ট্রিশিয়ান ফিরোজ শিকদার। শুধু তাই নয়, দিনের আলোতে রাস্তায় জ্বলতে থাকা স্ট্রিট লাইটও তাকে ভাবিয়ে তোলে। বিদ্যুতের অপচয় রোধে তিনি উদ্ভাবন করেছেন ডিটেক্টিং এলইডি স্ট্রিট লাইট, যা সূর্যের আলো ডিটেক্ট করে কেবল জ্বলবে রাতের অন্ধকারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাশ্রয়ী এই বাল্বের ব্যবহার বিদ্যুত খাতে আনতে পারে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। একইভাবে তার উদ্ভাবিত সেন্সর সিস্টেম আপনাআপনি বন্ধ করবে বিদ্যুত ও গ্যাসের সংযোগ, যা ব্যবহার করলে বাসাবাড়িতে ঘটে যাওয়া আকস্মিক অগ্নিকা-ের সঙ্গে সঙ্গেই বন্ধ হয়ে যাবে বিদ্যুত ও গ্যাস। এতে বড় ধরনের মারাত্মক দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে যাবে ওই বাড়িতে অবস্থানকারীরা। ফরিদপুরে জন্ম নেয়া ইলেক্ট্রিশিয়ান ফিরোজ শিকদার ব্যতিক্রমী এই তিন উদ্ভাবনেই থেমে থাকেননি। বিদ্যুতের অপচয় যেমন তাকে ভাবিয়েছে তেমনি উৎপাদন বৃদ্ধিতেও তিনি তার মেধাকে কাজে লাগাতে চেয়েছেন। সেই ভাবনায়ই তাকে পথ দেখিয়েছে ড্রেনের বহমান স্রোত। পানির স্রোত থেকে বিদ্যুত উৎপাদন হয়ে আসছে বহু বছর। তবে ড্রেনে বহমান পানির স্রোত থেকে বিদ্যুত উৎপাদনের ধারণা একেবারেই নতুন। বিদ্যুত উৎপাদনের ভিন্ন রকমের এই ধারণা সবাইকে চমকে দিয়েছে। ফিরোজের মতে, এই উদ্ভাবনটি প্রয়োগ করা সম্ভব হলে কেবল ঢাকার ড্রেনের বহমান স্রোত ব্যবহার করে ১০০ থেকে ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন করা সম্ভব। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ইলেকট্রিক্যাল এ্যান্ড ইলেক্ট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সাবেক ডিন প্রফেসর আমিনুল হকের মতে, ফিরোজের উদ্ভাবনকৃত এসব লাইটের ব্যবহার সর্বত্র করা সম্ভব হলে বিদ্যুত খাতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসতে পারে। এক প্রশ্নের জবাবে আমিনুল হক জনকণ্ঠকে বলেন, এ ধরনের বাল্বের ব্যবহার পরিবেশের কোন ক্ষতি করবে না। বরং এটি ব্যবহার করলে দেশের উন্নতি হবে। বিদ্যুত সাশ্রয়ী এই বাল্বের ব্যবহার কমিয়ে আনবে বিদ্যুত ঘাটতিও। তিনি বলেন, তবে এ ধরনের লাইট যে একেবারেই নতুন তা বলা যাবে না। বহির্বিশ্বে বহু আগে থেকেই সিকিউরিটি ল্যাম্প আছে। ড্রেনে বহমান পানি থেকে বিদ্যুত উৎপাদন ॥ ড্রেনে বহমান পানির স্রোত থেকে বিদ্যুত উৎপাদনের এক অন্য রকম উদ্ভাবনের কথা জানিয়েছেন ফিরোজ শিকদার। এই উদ্ভাবনটি প্রয়োগ সম্ভব হলে ঢাকার ড্রেনে বহমান পানির স্রোত কাজে লাগিয়ে ১০০ থেকে ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব বলে তার মত। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, পুরো ঢাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে শত শত ড্রেন। এর কোন কোনটিতে প্রচ- বেগে বইছে স্রোত। আবার কোনটিতে জমে আছে ময়লা। এই পদ্ধতি প্রয়োগ করা সম্ভব হলে শুধু বিদ্যুতই উৎপাদিত হবে তা নয়, ঢাকা হয়ে উঠতে পারে ময়লা ও মশা-মাছিমুক্ত। জনকণ্ঠকে তিনি জানান, মিরপুর-১ নম্বরের একটি ড্রেনে বসানো পুরো বিদ্যুত প্লান্টটি চালু করতে তার প্রয়োজন প্রায় ২ লাখ টাকা। বর্তমানে তার হাতে সে টাকা নেই। এজন্য তিনি সরকার বা কোন বিনোয়োগকারীর সহায়তা চান। পরীক্ষামূলকভাবে ২ লাখ টাকা ব্যয় করলে ওই টাকা উঠে আসবে কিনা এমন প্রশ্নে ফিরোজ শিকদার বলেন, ড্রেনে চালু করা আমার প্রকল্পটি থেকে যে বিদ্যুত উৎপাদিত হবে তাতে এক বছরেই বিনিয়োগের ওই টাকা উঠে আসা সম্ভব। তিনি জানান হাতে নেয়া এই পরিকল্পনার মাধ্যমে প্রতিদিন কমপক্ষে ৬০০ টাকার বিদ্যুত উৎপাদন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এক বছরে যে বিদ্যুত উৎপাদিত হবে তার বর্তমান বাজার মূল্য ২ লাখ টাকারও অধিক। বিনোয়োগ করা হলে উৎপাদিত বিদ্যুত কোথায় যাবে এমন প্রশ্নে এই উদ্ভাবনীর জনক ফিরোজ বলেন, সরকার বর্তমানে বিদ্যুত ক্রয় করছে। এর মাধ্যমে উৎপাদিত বিদ্যুতও জাতীয় গ্রিডেই যাবে। প্রকল্প সফল করতে সরকার ও বিদ্যুত বিভাগের সহায়তার প্রয়োজন রয়েছে। নতুবা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হবে দেশের তরুণ প্রজন্মের উদ্ভাবিত এমন নানা উদ্যোগ। মিরপুরে গিয়ে দেখা যায়, চিড়িয়াখানার পার্শ্ববর্তী রাইনখোলা বাজারের অল্প দূরের প্রশস্ত ড্রেনকে বেছে নিয়েছেন তিনি। এখানে ৪ ফিট বাই ৮ ফুট ড্রেনে তিনি বসিয়েছেন চাকতি। যা ঘুরছে অনেকটা হুইলের মতো। ফিরোজের পক্ষে বিদ্যুত উৎপাদনের পুরো কাজ এখনও শেষ করা সম্ভব হয়নি। আর পরীক্ষামূলকভাবে এ ড্রেন বেছে নিতেও তাকে কোন বেগ পোহাতে হয়নি। এ ক্ষেত্রে স্থানীয়রাও তাকে সহায়তার করছেন। ড্রেনে বহমান পানি থেকে বিদ্যুত উৎপাদনের ধারণা প্রসঙ্গে বুয়েটের সাবেক শিক্ষক প্রফেসর আমিনুল হক বলেন, স্রোত থেকে বিদ্যুত উৎপাদিত হয়। এক্ষেত্রে ময়লা কোথায় যাবে, কিভাবে যাবেÑ তা প্রশ্ন সাপেক্ষ। বিদ্যুত সাশ্রয়ী এলইডি সেন্সর লাইট ॥ ফরিদপুরে জন্ম নেয়া ফিরোজ পূর্ববর্তী সময়ে বিদ্যুত অপচয় রোধে সেন্সর উদ্ভাবন করলেও এবার তিনি উদ্ভাবন করেছেন বিদ্যুত সাশ্রয়ী এলইডি সেন্সর লাইট। এটি উদ্ভাবনের কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, দেশে প্রায় ১০ লাখ ৫ তলা বিল্ডিং রয়েছে। প্রতিটি বিল্ডিংয়ের সিঁড়িতে গড়ে ৫টি লাইট সারা রাত ধরে জলতে থাকে। এতে প্রায় ৫০ লাখ লাইট সারা রাত বিদ্যুতের অপচয় ঘটাচ্ছে। হিসেব বলছে, এতে সারাদেশে ৫ থেকে ৬ কোটি টাকার বিদ্যুত অপচয় হচ্ছে। তিনি বলেন, লাইট অফ মোডে থাকবে। যখন লাইটের আশপাশে কোন মানুষ আসবে তখনি লাইট জ¦লে উঠবে। মানুষ চলে যাওয়া মাত্রই লাইট অফ হয়ে যাবে। ফলে বিদ্যুতের অপচয় একেবারেই বন্ধ হয়ে যাবে। সেইসঙ্গে কমবে বাড়তি বিলের ঝামেলা। এতে বেঁচে যাওয়া বিদ্যুত চলে যাবে কোন এক অন্ধকারের গ্রামেও। ডিটেক্টিং এলইডি স্ট্রিট লাইট ॥ তার আরেকটি উদ্ভাবনও বিদ্যুতের অপচয় নিয়েই। সারা দেশের রাস্তায় সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভার স্ট্রিট লাইটগুলো দিনের বেলায়ও কোন না কোন কারণে জ্বলে থাকে। আবার অনেক ক্ষেত্রে জ্বলে ওঠে সন্ধ্যার আগেই। তার উদ্ভাবিত লাইটে রয়েছে এলইডি স্ট্রিট ডিটেকটিং সেন্সর, যা শুধুমাত্র নির্দিষ্ট পরিমাণ আলো অন্ধকার ডিটেক্ট করে লাইট জ্বালিয়ে দেবে ও সময় মতো লাইট অফ করে দেবে। ফলে অকারণে লাইট জ্বালিয়ে রাখার কোন সম্ভাবনা নেই। এই উদ্ভাবনটি কাজে লাগানো গেলে দেশের কয়েক কোটি টাকার বিদ্যুত সাশ্রয় হবে বলে। ফিরোজ শিকদার জনকণ্ঠকে বলেন, বিশ্বের অন্যান্য দেশে সূর্য ডিটেক্টিং সিস্টেম আছে। এই যে বিদ্যুতের অপচয়, বছরের পর বছর ধরে বিদ্যুতের অপচয় চলছে। গণমাধ্যমে একটি প্রতিবেদন দেখে আমি ডিটেক্টিং এলইডি স্ট্রিট লাইট উদ্ভাবনের চেষ্টা করি। কাজ করতে গিয়ে অল্প দিনেই সফলতা পাই। আমি চাই আমার কাজটা দেশের উপকারে আসুক। উদ্ভাবিত সেন্সর সিস্টেম বন্ধ করবে বিদ্যুত ও গ্যাসের সংযোগ ॥ ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশ। ঢাকাসহ সারা দেশে যদি কোনক্রমে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হয় তা হবে ভয়াবহ এক বিপর্যয়ের কারণ। ঢাকার বড় বড় ভবনের একটি থেকে আরেকটির দূরত্বÑ কোন কোন ক্ষেত্রে নেই বললেই চলে। এক্ষেত্রে বাড়ি ভেঙে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে বড় ধরনের আঘাত আসবে ওই ভাঙ্গা বাড়ি থেকেও। এরমধ্যে ইলেক্ট্রিক শর্ট সাকিট থেকে আগুন ও গ্যাস লাইন ফেটে আগুন লাগার শঙ্কার কথা বলে আসছেন বিশেষজ্ঞরা। আর ফিরোজ এমন শঙ্কা থেকে নিরাপদ রাখতে উদ্ভাবন করেছেন এক ধরনের সেন্সর। সিস্টেমটি বাড়িতে থাকা ইলেকট্রিক সংযোগ ও গ্যাস লাইন বন্ধ বা অফ করে দেবে। এতে করে ভেঙে পড়া বাড়িতে যারা থাকবে তারা অন্তত আগুনের হাত থেকে বেঁচে যাবে। কৃষক তার জমিতে পানি পাবে একদম ফ্রি ॥ ফিরোজ শিকদার এমন এক উদ্ভাবনের কথা জানিয়েছেন যাতে কৃষক তার জমিতে সেচের জন্য পানি পাবে একদম ফ্রি। হোক তা গভীর নলকূপ বা নদীর পানি। পানি বাবদ কৃষককে কোনো প্রকার টাকা খরচ করতে হবে না। তবে সঙ্গত কারণে এই উদ্ভাবনের বিস্তারিত তিনি গণমাধ্যমকে জানাতে নারাজ। কেবল উপযুক্ত বিনিয়োগের নিশ্চয়তা পাওয়া গেলে তিনি তার এই উদ্ভাবনটি দেশের কাজে লাগাতে চান। ফিরোজ শিকদার পেশায় একজন ইলেক্ট্রিশিয়ান। ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গা উপজেলার নলিয়া গ্রামে তার জন্ম। লেখপড়ার গন্ডি এসএসসি পর্যন্ত। ২০০০ সাল থেকে তিনি গার্মেন্টসে মেকানিক হিসেবে কাজ করে আসছেন। আয় রোজগার বেশ ভাল। ব্যাংক এ্যাকাউন্টে সঞ্চয়ের অঙ্ক ১৫ লাখ ছাড়িয়ে। কেবল সেন্সর উদ্ভাবন করতে গিয়ে সঞ্চয়কৃত পুরো টাকাই ব্যয় করেছেন তিনি। শুধু তাই নয়, উদ্ভাবনী কাজ চালিয়ে যেতে একটি এনজিও সংস্থা থেকেও ঋণ নিয়েছেন ৩ লাখ টাকা। ২০১৪ সালে তার উদ্ভাবনকৃত সেন্সর নিয়ে গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হলেও এই প্রকল্পে বিনিয়োগকারীরা তেমনভাবে সাড়া দেননি। আশার আলো দেখাতে পারেনি বিদ্যুত বিভাগও। ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের কর্মকর্তারাও উদ্ভাবনী শক্তিকে এগিয়ে নিতে ফিরোজের হাতে রাখেননি হাত। বরং এক ইঞ্জিনিয়ারের ব্যবহারে ফিরোজ হয়েছিলেন আশাহত। তবে থেমে থাকেননি। ২০১৪ সালে কেবল সেন্সর উদ্ভাবন করলেও এবার তিনি এলইডি লাইট, ডিটেক্টিং এলইডি স্ট্রিট লাইট ছাড়াও উদ্ভাবন করেছেন এমন এক সেন্সর সিস্টেম, যা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ করবে বিদ্যুত ও গ্যাসের সংযোগও। ফিরোজ চান, কোন বিনিয়োগকারীর হাতে হাত রেখে তার উদ্ভাবনগুলো দেশের উন্নয়নে অবদান রাখুক।
×