ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

চল্লিশ বছরে ঋষিজ

গণমানুষের সঙ্গীত প্রতিবাদী চেতনায় দীর্ঘ পরিভ্রমণ

প্রকাশিত: ০৫:৩৫, ২৩ নভেম্বর ২০১৬

গণমানুষের সঙ্গীত প্রতিবাদী চেতনায় দীর্ঘ পরিভ্রমণ

মোরসালিন মিজান ॥ আর কোন দল বা সংগঠন হলে বলাই যেত- গানে গানে চল্লিশ বছর। কিন্তু যখন ঋষিজ, গানে গানে নয় শুধু। প্রতিবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে পথ চলছে। অন্যায় অসাম্যের বিরুদ্ধে অসুন্দরের বিরুদ্ধে অহর্নিশ সংগ্রামী। অসুরের বিরুদ্ধে সুরের লড়াই সহজ কাজ নয়। বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। আর বর্তমানে যেখানে দাঁড়িয়ে, সেখানে হাত ধরাধরি করে আছে গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। আজ ২৩ নবেম্বর বুধবার বিস্ময়কর পরিভ্রমণের চল্লিশ বছর পূর্ণ করছে ঋষিজ। ১৯৭৬ সালের এই দিনে যাত্রা শুরু হয়েছিল। এখনও অব্যাহত। অপ্রতিদ্বন্দ্বী। গণসঙ্গীত বললে আজকের বাংলাদেশে এই একটি দলের কথাই প্রথমে মনে পড়ে। বলার অপেক্ষা রাখে না, একটি বিরুদ্ধ সময়ে গঠন করা হয় ঋষিজ। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্মম হত্যাকা-ের পর কক্ষচ্যুত বাংলাদেশ। আর্ত-সামাজিক রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব চরমে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মারাত্মক আক্রান্ত হচ্ছে। মার খাচ্ছে শেকড় সংলগ্ন চর্চা। এমন সময় মুনি ঋষিদের মতোই নিজস্ব ধ্যান এবং চিন্তাকে সঙ্গী করে পথ চলা শুরু করে ঋষিজ। দলের প্রাণভোমরা যে ফকির আলমগীর, সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রতিষ্ঠাতাদা সভাপতি তিনি। ঋষিজকে বুঝতে হলে ফকির আলমগীরকে জানা জরুরী হয়ে যায়। ষাটের দশকের উত্তাল সময়ে বাম রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। আন্দোলন সংগ্রামের কালে সঙ্গীতকে তিনি হাতিয়ার করেন তিনি। গণসঙ্গীতের বিখ্যাত দল ক্রান্তি শিল্পী গোষ্ঠী ও গণ-শিল্পীগোষ্ঠীর সদস্য হিসেবে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় শব্দ সৈনিক হিসেবে যোগ দেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে। উদ্দীপনামূলক গণসঙ্গীত পরিবেশন করেন। তরুণ ফবির আলমগীরের পপ মিউজিকের প্রতিও ছিল প্রবল আকর্ষণ। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে ব্যান্ড সঙ্গীতের যে উত্থান, সেখানে তার অবদান ছিল যথেষ্ট। এরই এক পর্যায়ে সমমনা শিল্পীরা মিলে গঠন করেন ঋষিজ। আজকের সঙ্গীতাঙ্গণে ঋষিজ মানেই ফকির আলমগীর। কিন্তু প্রতিষ্ঠালগ্নে ছিলেন আরও অনেকে। সেসব কথা জানতে মঙ্গলবার কথা হয় ফকির আলমগীরের সঙ্গে। একটি পুরনো ফটো এ্যালবাম খুল প্রতিবেদকের সামনে মেলে ধরেন তিনি। গ্রুপ ছবির কেউ দেখতে বব মার্লি! কেউবা এরিক ক্ল্যাপটনের সাজে! আসল নামÑ নাইজার, কাজল, ফাহিম হোসেন, আসাদ, সালেকিন বাবু, ইউসুফ, রতন, কঁচি, ঝুরু, শুক্কুর, দস্তগীর, আদিল, সুরুজ, নাফিস ও আনিস। এরা প্রায় সবাই ছিলেন পপ গানের প্রিয় পরিচিত মুখ। সঙ্গত কারণে ঋষিজ ব্যান্ড হিসেবে শ্রোতাদের সামনে আসে বলে জানান তিনি। প্রতিষ্ঠার পর ঋষিজ প্রথম কনসার্ট করে নোয়াখালীর মাইজদীতে। পরবর্তিতে অন্যান্য জেলাতেও গান করতে থাকে। আর নিয়মিত অনুষ্ঠান থাকত অভিসার, বলাকা ও জোনাকী সিনেমা হলে। অবশ্য পাশ্চাত্য ধারা থেকে গ্রহণ করলেও, দলটি মূলত বাংলাদেশের লোক সুর লোক-মানস ও তৃণমূলের জীবন সংস্কৃতিকেই গানে গানে তুলে ধরতে প্রয়াসী হয়। গানগুলোর কথা উল্লেখ করলে সেটি আরও পরিষ্কার হবে। এই যেমনÑ ‘মানুষও বানাইয়া খেলছ তারে লইয়া’, ‘বনমালী গো তুমি পরজনমে হইও রাধা’, ‘চিন্তারাম দারোগা বাবু’, ‘মন আমার দেহঘড়ি সন্ধান করি’, ‘সাধের লাউ’, ‘শ্যাম পিরিতি’, ‘দুই পাহাড়ের মাঝে মওলা মসজিদ বানাইছে’ ইত্যাদি। পরিবেশনায় ইস্টার্ন ওয়েস্টার্ন দুটোর মিশেল থাকায় নতুন মাত্রা যোগ হয়। গানগুলো জনপ্রিয় হতে থাকে। দলও। ঋষিজ গণসঙ্গীতের হয়ে ওঠে ফকির আলমগীরের প্রভাবেই। তিনি জানান, ১৯৮১ সালের দিকে এসে দলের সদস্যদের কেউ কেউ অনুপস্থিত। যোগ হয়েছেন কেউ কেউ। দেশমাতাও ভাল নেই। গণসঙ্গীত হয়ে ওঠে সময়ের দাবি। এ দাবি মেটাতে উদ্যোগী প্রথমবারের মতো ঋষিজ’র কমিটি গঠন করা হয়। সভাপতি হন তখনকার তারকা শিল্পী ফকির আলমগীর। সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন বহু বিখ্যাত গানের গীতিকার আলতাফ আলী হাসু। এর পর থেকে গানে গানে প্রতিবাদ। বিদ্রোহ। ফকির আলমগীরের চোখ ছল ছল করে ওঠে। বলেন, ১৯৬৯ সালে কিংবা ১৯৭১ সালে যেসব গান গেয়েছিলাম সেগুলো আবারও কণ্ঠে তুলে নেই। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ভুলুণ্ঠিত হচ্ছিল যখন, যখন ইতিহাস বিকৃত হচ্ছিল, দেশ যখন অবৈধ স্বৈরশাসকের কবলে, ঋষিজ তখন প্রতিবাদ করল। আবারও গাইলো- ভয় কী মরণে, রাখিতে সন্তানে/মাতঙ্গী মেতেছে আজ সমররঙ্গে...। শ্রমজীবী মানুষের বঞ্চনা ক্ষোভ বুকে গাইল ‘দুনিয়ার মজদুর ভাই সব’, ‘বিপ্লবের রক্ত রাঙা ঝা-া ওড়ে আকাশে’, ‘কমরেড লেনিনের আহ্বান’ ইত্যাদি গান। বর্ণবাদ সাম্যবাদের কথা আসল ঘুরে ফিরে। ফকির আলমগীর গাইলেন- কালো কালো মানুষের দেশে...। এভাবে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিকতার বোধ দ্বারা তাড়িত হয়ে পথ চলে ঋষিজ। বাঙালীর সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সঙ্কটের কালে ঋষিজ কখনও নিশ্চুপ ছিল না। ১৩৮৯ বঙ্গাব্দ থেকে ছায়ানটের পাশাপাশি পহেলা বৈশাখ উদ্যাপন শুরু করেন ফকির আলমগীররা। রমনা বটমূলের অনুষ্ঠান শেষে শিশু পার্কের সামনে প্রতিবছর আয়োজিত বর্ষবরণ উৎসবে যোগ দেয় বাঙলী। স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারসহ প্রায় সব প্রগতিশীল আন্দোলনে গণসঙ্গীত নিয়ে রাজপথে ছিল ঋষিজ। প্রাকৃতিক দুর্যোগে সব সময় এগিয়ে এসেছে। দেশের কিংবদন্তি শিল্পী সাহিত্যিক সাংবাদিক বুদ্ধিজীবী দার্শনিকদের সঙ্গে নীবিড় সম্পর্ক রেখে চলার ঘটনাটিও উল্লেখ করার মতো। ঋষিজ নানা ইস্যুতে তাদের পরামর্শ নিয়ে পথ চলেছে। ঋষিজ পুরস্কার এখন আলাদা গুরুত্বের। বহু গুণীজন এই সম্মাননা গ্রহণ করেছেন। সব মিলিয়ে আজকের অবস্থানে ঋষিজ। অনুভূতি কী? জানতে চাইলে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন ফকির আলমগীর। বলেন, গান তো কত শত সংগঠন করে। আমরা শ্রোতাদের শুধু আনন্দ দিতে গান করিনি। বরং গণমানুষের জন্য, সমাজ এবং রাষ্ট্রের জন্য কিছু করার চেষ্টা করেছি। গানকে বিপ্লবের হাতিয়ার করেছি। এ জন্য অনেক চড়াই উৎরাইয়ের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। তবু থামেনি ঋষিজ। গণসঙ্গীতের ধারাটিকে বাঁচিয়ে রাখার সংগ্রাম এবং গণমানুষের মুক্তির লড়াই ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে বলে জানান তিনি।
×