ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

পদে পদে ভোগান্তি আর উৎকোচ ॥ বিশ্বব্যাংকের রিপোর্ট

৪০৪ দিন

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ২০ নভেম্বর ২০১৬

৪০৪ দিন

রশিদ মামুন ॥ উৎপাদন এবং সরবরাহ বৃদ্ধি পেলেও বিদ্যুতের সংযোগ পেতেই ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে গ্রাহককে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় পদে পদে ভোগ আর উৎকোচ ছাড়া দেশে কোন বিদ্যুত সংযোগ মেলে না। একটি বিদ্যুত সংযোগ পেতে গড়ে সময় প্রয়োজন হয় ৪০৪ দিন। বিশ^ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে ভয়ঙ্কর এ তথ্য উঠে এসেছে। আঁতকে ওঠার মতো ঘটনা হলেও এ তথ্যের সঙ্গে একমত বিদ্যুত বিভাগের কর্তারা। তারা নিজেরাই বিদ্যুত সংযোগের লম্বা প্রক্রিয়া দেখে ঘাবড়ে গেছেন। দেশে বিদ্যুতের সরবরাহ বৃদ্ধি পেলেও সংযোগেই রয়ে গেছে আমলাতান্ত্রিকতা। ঘাটে ঘাটে গ্রাহককে ঘুরতে হয়। হতে হয় হয়রানি। ঘাটে ঘাটে পয়সা খরচ করতে হয়। মজার বিষয় হচ্ছে, এ সুযোগে পল্লী বিদ্যুত সমিতিগুলোতে এলাকাভিত্তিক দালাল শ্রেণী গড়ে উঠেছে। কারও কারও পেশাই এখন বিদ্যুত সংযোগ এনে দেয়া। এদের সঙ্গে যোগাযোগ না করলে সংযোগ পাওয়া যায় না বললেই চলে। বিদ্যুত, জ্বালানি এবং খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ সম্প্রতি বলেছেন, বিদ্যুত সংযোগ পেতে এক গাদা কাগজপত্র লাগে, যা দেখে আমিই ঘাবড়ে যাচ্ছি। তিনি বলেন, এমন কোন পন্থা বের করতে হবে যাতে গ্রাহক অনলাইনে আবেদন করার সাত দিনের মধ্যে বিদ্যুত সংযোগ পেতে পারেন। উন্নত দেশে যেখানে আবেদনের একদিন পরেই বিদ্যুত সংযোগ পাওয়া যায় সেখানে আমাদের এখানে দিনের পর দিন অপেক্ষা করতে হয়। তিনি বলেন, এখনও বিদ্যুত সংযোগ পেতে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা রয়ে গেছে। বিশ্বব্যাংকের ‘ডুইং বিজনেস রিপোর্ট-২০১৭’ প্রতিবেদনে দেখা যায়, এশিয়ায় বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থা খুবই নাজুক। নতুন শিল্প-কারখানায় বিদ্যুত সংযোগ পেতে বাংলাদেশে প্রায় ৪০৪ দিন সময় প্রয়োজন হয়। অথচ প্রতিবেশী দেশ ভারতে শিল্প-কারখানায় বিদ্যুত সংযোগের আবেদনের পর মাত্র ৪৭ দিন, শ্রীলঙ্কায় ১০০ দিন, পাকিস্তানে ২১৫ দিন, নেপালে ৭০ দিন, থাইল্যান্ডে ৩৭ দিন, দক্ষিণ কোরিয়ায় মাত্র ১৮ দিনে নতুন সংযোগ পান শিল্প-কারখানার মালিকরা। এ প্রক্রিয়াকে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচনা করা হয়। সরকারের পক্ষ থেকে সবকিছু ডিজিটালাইজড করার মতো বিদ্যুত সংযোগও অনলাইনে করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু তাতে কি একটুও ভোগান্তি কমেছে? নাকি আবেদনটি ছাড়া সবকিছু আগের মতোই রয়ে গেছে? খোঁজ করে দেখা গেছে, আগে যেখানে নির্দিষ্ট ফরম পূরণ করে হাতে আবেদনটি করতে হতো এখন সেখানে শুধু অনলাইনে একটি আবেদন ফরম পূরণ করা যায়। এছাড়া সব প্রক্রিয়াই আগের মতো জটিল। সবখানে জটিলতা আর কুটিলতা। বিতরণ কোম্পানি ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানিতে বিষয়টি খুঁজতে গিয়ে দেখা যায়, অনলাইনে আবেদনের ক্ষেত্রেই অন্তত ৯টি ধাপ অতিক্রম করে একজন গ্রাহক সংযোগ পান। অবশ্য সবশেষে তাকে কোম্পানির তরফ থেকে ক্ষুদেবার্তায় ধন্যবাদ জানানো হয়। যদিও লম্বা সময় ধরে নানাভাবে হয়রানির জন্য গ্রাহকের কাছে দুঃখ প্রকাশের কোনো রীতি নেই এদের। অনলাইন আবেদনের ক্ষেত্রে গ্রাহক হতে ইচ্ছুক এমন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান আবেদন ফরম পূরণের আগেই তার লোড নিশ্চিত হওয়ার বিধান জুড়ে দেয়া হয়েছে। সাধারণ গ্রাহক নিজের লোড বের করতে পারার কথা নয়। সেখানে গ্রাহককে দৌড়াতে হবে বিদ্যুত বিতরণ কোম্পানির লোকের কাছে। ওই লোক কি পয়সা ছাড়া সেবা দেবেন? আর দেবেনই বা কেন, তিনি তো এখন তার গ্রাহকও নন। অর্থাৎ এ লোড বের করার প্রক্রিয়াটি প্রথম ঘাট, যেখানে থামতে হবে গ্রাহককে। গ্রাহকের অনলাইন আবেদন গ্রহণ করার সাত দিনের মধ্যে বিতরণ কোম্পানি তাকে নয় ধরনের কাগজ সরাসরি বা ডাকযোগে পাঠানোর অনুরোধ করে। সেখানে একজন আবেদনকারীকে প্রথমেই অনলাইন আবেদনের প্রিন্ট কপি নিজের স্বাক্ষর দিয়ে কোম্পানির কাছে পাঠাতে হয়। এতে অনলাইন আবেদনের কী সুফল পাওয়া গেল। সেই যদি প্রিন্ট করে সই করে দিতে হয় তাহলে ফরমে করতে সমস্যা কোথায়? এরপর নিজের রঙ্গিন ছবি থেকে শুরু করে জমির দলিল অথবা মিউটেশন কপি অথবা ভাড়ার ক্ষেত্রে চুক্তিনামা তাও আবার সত্যায়িত হতে হবে যথাযথ ব্যক্তির। সংযোগস্থল খুঁজে পাওয়ার সুবিধার্থে হাতে মানচিত্র এঁকে দিতে হবে। অনেকেই এ প্রক্রিয়াকে আগের দিনের রাজা-বাদশাহর দুর্গম স্থানে যুদ্ধে যাওয়ার প্রক্রিয়ার সঙ্গে তুলনা করেছেন। প্রত্যেক এলাকায় বিদ্যুতের আঞ্চলিক কার্যালয় রয়েছে। তারা অলিগলি চেনার পরও মানচিত্র চাওয়ার বিষয়টি হাস্যকর বিষয় ছাড়া আর কিছু হতে পারে না। এয়ারকুলার ব্যবহার না করার অঙ্গীকারনামা, ট্রেড লাইসেন্সের ফটোকপি, স্থাপিত যন্ত্রপাতির প্রস্তুতকারকের তৈরি করা লোড ডিস্ট্রিবিউশনের ডায়াগ্রাম, পাওয়ার ফ্যাক্টর শুদ্ধিকরণের যন্ত্রপাতি ক্রয়ের কপি- এসব কাগজপত্র জমা দেয়ার পর কার্যক্রম শুরু করবে বিতরণ কোম্পানি। সংযোগ প্রক্রিয়ার প্রথম কাজ সার্ভে বা জরিপ করা। কাগজপত্র পাওয়ার পর সংযোগের স্থান সার্ভে করার কথা জানিয়ে আবেদনকারীকে ক্ষুদেবার্তা পাঠায় কোম্পানিটি। সার্ভে করার পরে আবেদনকারী সংযোগের জন্য উপযুক্ত বিবেচিত হলে তাকে দফতরে মিটার জমা দিতে বলা হয় অথবা মিটার দেয়া হয়। সংযোগের জন্য বিবেচিত হলে আবেদনকারীকে আবেদন ফি, জামানত ব্যয় ছাড়াও অন্যান্য প্রয়োজনীয় খরচ প্রদানের জন্য অনুরোধ করা হয়। আবেদনকারী সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে অর্থ জমা দিয়ে রসিদ কর্র্তৃপক্ষের কাছে জমা দেবেন। এরপর আবেদনকারীর মিটার পরীক্ষার পর যদি মনে হয় তা উপযুক্ত তবেই সংযোগ দেয়ার কথা জানিয়ে দেয়া হয়। দেশের অন্য বিতরণ কোম্পানির ক্ষেত্রেও লাইন পেতে এমন দীর্ঘ প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয়। এর নজির প্রতিটি বিদ্যুত কেন্দ্রের ওয়েবসাইটেই রয়েছে। যদিও গ্রাহকদের দাবি, ভোগান্তির সঙ্গে উৎকোচ একটি বড় সমস্যা। টাকা ছাড়া বিদ্যুত সংযোগ পাওয়া অনেক কঠিন বিষয়। বিদ্যুত, জ্বালানি এবং খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ দায়িত্ব নেয়ার কিছুদিন পরেই নিজের এলাকা কেরানীগঞ্জের পল্লী বিদ্যুত অফিস পরিদর্শনে যান। ওই সময় স্থানীয় বাসিন্দাদের উপস্থিতিতে জানতে চান টাকা ছাড়া বিদ্যুত লাইন পাওয়া যায় কি-না। সকলে একযোগে হাত নেড়ে জানান না পাওয়া যায় না। এখনও এ অবস্থাই বিরাজ করছে। সরকার দেশের সকল মানুষকে বিদ্যুত সরবরাহ করার অঙ্গীকার করেছে। অভিযোগ রয়েছে, কোথাও উৎকোচ ছাড়া আরইবির সংযোগ পাওয়া যায় না। এ নিয়ে মাঠপর্যায়ে ব্যাপক অসন্তোষ রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে এসব অভিযোগের বিষয়ে আরইবি সোচ্চার হলেও কার্যত কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। বিদ্যুত সচিব মনোয়ার ইসলাম এ প্রসঙ্গে বলেন, বিশ্বব্যাংকের একটি জরিপে বাংলাদেশের বিদ্যুত সংযোগের ভোগান্তির চিত্র উঠে এসেছে। এ পরিস্থিতি থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। দ্রুত কিভাবে সংযোগ প্রদান করা যায় তা খুঁজে বের করতে হবে।
×