ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

এনামুল হক

বিশ্বের প্রথম আলোক-সন্ধানী ন্যানো রোবট

প্রকাশিত: ০৬:৪০, ১৮ নভেম্বর ২০১৬

বিশ্বের প্রথম আলোক-সন্ধানী ন্যানো রোবট

বহু বছর আগে কল্প বিজ্ঞানভিত্তিক একটি ছায়াছবি মুক্তি পেয়েছিল। নাম ‘ফ্যান্টাস্টিক ভয়েজ’। সেখানে একদল বিজ্ঞানী মানুষের শরীরের ভেতর একটি ন্যানো-সাবমেরিন ঢুকিয়ে তা চালিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন একজনের ক্ষতিগ্রস্ত মস্তিষ্ক মেরামতের জন্য। আরেকটি ছায়াছবি আছে ‘টার্মিনেটর-২’। সেখানে বিস্ময়করভাবে আকার পরিবর্তনে সক্ষম একটি রোবোটিক শরীর ‘টি-১০০০’ এর ভেতর কয়েক শ’ কোটি ন্যানো রোবট সংযোজন করা হয়েছিল। কিন্তু এ সবই তো কল্পবিজ্ঞানের কাহিনী। বাস্তব জীবনে উন্নততর কাজ করতে সক্ষম অত্যাধুনিক ন্যানো রোবট তৈরি করা যথেষ্ট চ্যালেঞ্জের ব্যাপার। তথাপি সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে বাস্তবে ন্যানো রোবট তৈরি করা সম্ভব হয়েছে। হংকং বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের ড. জিনিয়াও ট্যাংয়ের নেতৃত্বে একদল গবেষক বিশ্বের প্রথম আলোক-সন্ধানী সিনথেটিক ন্যানো রোবট তৈরি করেছেন। আকারে সেটি এতই ক্ষুদ্র যে একটি রক্ত কোষের সঙ্গে তুলনীয়। এসব ক্ষদ্রাতিক্ষুদ্র রোবট রোগীর শরীরের ভেতর ইনজেক্ট করে দেয়া সম্ভব। এগুলোকে কাজে লাগিয়ে সার্জনরা রোগীর শরীরের ভেতর থেকে টিউমার অপসারণ করতে পারেন। টার্গেট করে ওষুধ দেয়ার কৌশল আরও সুনির্দিষ্ট ও নিখুঁত করে তুলতে পারেন। এভাবে কল্পবিজ্ঞান আজ অতি বাস্তব সত্যে পরিণত হয়েছে। এ বছর রসায়নে নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়েছে তিনজন বিজ্ঞানীকে মলিকুলার মেশিনের ডিজাইন তৈরি ও সংশ্লেষণের জন্য। তারা মলিকুল পরিসরে একসেট যান্ত্রিক অংশ উদ্ভাবন করেছেন যা ভবিষ্যতে ডিএনএ বা প্রোটিনের মতো একক মলিকুল নিয়ন্ত্রণের জন্য অধিকতর জটিল ন্যানো মেশিনের ভেতর সংযোজন করা যেতে পারে। বায়ো মেডিক্যাল ক্ষেত্রে প্রয়োগের জন্য ন্যানো পরিসরে অতি ক্ষুদ্র মেশিন উদ্ভাবন সাম্প্রতিককালের বৈজ্ঞানিক গবেষণার একটা প্রধান ধারায় পরিণত হয়েছে। এ বিষয়ে যে কোন বড় ধরনের অগ্রগতি রোগব্যাধির চিকিৎসা ও নতুন ওষুধ তৈরির জ্ঞানার্জনের দ্বার উন্মোচনে বিশাল সম্ভাবনা সৃষ্টি করে। ন্যানো রোবট তৈরির ক্ষেত্রে একটা সমস্যা হলো এসব ন্যানো কাঠামোকে পরিবেশ অনুভব করতে ও তাতে সাড়া দিতে সক্ষম করে তোলা। যেহেতু প্রতিটি ন্যানো রোবট আকারে মাত্র কয়েক মাইকোমিটার অর্থাৎ মানুষের চুলের পরিধির চাইতেও ৫০ গুণ ছোট তাই যুক্তিসঙ্গত মূল্যে সাধারণ ইলেকট্রনিক সেন্সর ও সার্কিটগুলোকে সঙ্কুচিত করে ন্যানো রোবটের ভেতরে স্থাপন করা যথেষ্ট কঠিন। বর্তমানে দূর থেকে ন্যানো রোবট নিয়ন্ত্রণের একমাত্র পদ্ধতিটা হলো ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র চুম্বক ন্যানো রোবোটের ভেতরে স্থাপন করা এবং বাইরের ম্যাগনেটিক ফিল্ড বা চৌম্বক ক্ষেত্রের মাধ্যমে এর গতি নিয়ন্ত্রণ করা। ড. জিনিয়াও ট্যাংয়ের উদ্ভাবিত ন্যানোটিউন তার চালিকাশক্তি হিসেবে আলোকে ব্যবহার করে। বিশ্বে এই প্রথম একটি গবেষক দল আলোক-নিয়ন্ত্রিত ন্যানো রোবট উদ্ভাবন করল এবং এর সম্ভাব্যতা ও কার্যকারিতা প্রশেন করল। এক গবেষণাপত্রে ড. ট্যাংকের দল এসব ন্যানো রোবোটের নজিরবিহীন ক্ষমতার পরিচয় দিয়েছেন। তারা বলেছেন যে, আলোর নিয়ন্ত্রণে এরা নৃত্য করতে কিংবা শব্দের বানান করতে পারে। ন্যানোট্রি কাঠামোর দ্বারা ন্যানো রোবটগুলো পতঙ্গ যেমন আলোর দিকে ধাবিত হয় তেমনি তাদের উপর প্রক্ষিপ্ত আলোর উজ্জ্বলতায় সাড়া দিতে পারে। ড. ট্যাংয়ের ভাষায় ব্যাপারটা এমন যেন তারা আলো দেখতে পেয়ে সেদিকে ধাবিত হয়। ড. ট্যাংয়ের দলটি ন্যানো রোবট উদ্ভাবনের প্রেরণা লাভ করেছে প্রাকৃতিক সবুজ এ্যালজি থেকে। প্রকৃতিতে কিছু কিছু সবুজ এ্যালজির আবির্ভাব ঘটেছে যেগুলো তাদের চারপাশের আলো অনুভব করার ক্ষমতা রাখে। এককোষী হলেও এসব সবুজ এ্যালজি আলোর তীব্রতা অনুভব করে আলোক সংশ্লেষণের জন্য সেই আলোর উৎসের দিকে সাঁতরে যেতে পারে। ন্যানো রোবট সাফল্যের সঙ্গে উদ্ভাবনের পেছনে ড. ট্যাংয়ের দল তিন বছর সময় ব্যয় করেছে। অভিনব ন্যানোট্রি কাঠামোর এই রোবটগুলো দুটো অভিন্ন ও কম দামের সেমিকন্ডাক্টর উপকরণÑসিলিকন ও টাইটানিয়াম অক্সাইড দিয়ে গঠিত। সংশ্লেষণের সময় সিলিকন ও টাইটানিয়াম অক্সাইড ন্যানোওয়্যারের আকার দেয়া হয় এবং তারপর একটি ক্ষুদে ন্যানোট্রি হেটারো স্ট্রাকচারে বিন্যস্ত করা হয়। ড. ট্যাং বলেন, বর্তমান ন্যানো রোবটকে এখনও রোগ চিকিৎসার কাজে ব্যবহার করা না গেলেও তারা আগামী প্রজন্মের ন্যানো রোবট উদ্ভাবনের জন্য কাজ করে চলেছেন যেগুলো হবে আরও দক্ষ ও জৈব পরিবেশের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। তিনি বলেন যে, আলো মাইক্রোস্কোপিক জগত ও ম্যাক্রোস্পোপিক জগতের মধ্যে যোগাযোগের অধিকার কার্যকর উপায়। ধারণা করা যেতে পারে যে ন্যানো রোবটকে অধিকতর জটিল নির্দেশাবলী দেয়া সম্ভব যার মাধ্যমে দৈনন্দিন জীবনে সেগুলোকে আরও ভালভাবে প্রয়োগ করা সম্ভব হতে পারে। সূত্র : রোবোটিক্স সায়েন্স
×