ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

হলি আর্টিজান রেস্তরাঁ মালিকের কাছে হস্তান্তর

জঙ্গী মেজর জিয়া এক মাস আগেও ঢাকার আশপাশে ছিল

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ১৪ নভেম্বর ২০১৬

জঙ্গী মেজর জিয়া এক মাস আগেও ঢাকার আশপাশে ছিল

শংকর কুমার দে ॥ নিষিদ্ধি ঘোষিত জঙ্গী সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলাটিমের প্রধান সেনাবাহিনীর চাকরিচ্যুত মেজর সৈয়দ জিয়াউল হক জিয়া এক মাস আগেও ঢাকার আশপাশের এলাকায়ই আত্মগোপন করেছিল কোন জঙ্গী আস্তানায়। আনসারুল্লাহ বাংলাটিমের জঙ্গী সদস্য খায়রুল ইসলাম ওরফে রিফাত ওরফে ফাহিম ওরফে জিসান ওরফে জামিলকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করে এমন তথ্যই পেয়েছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপন ও ব্লগার নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় নিলয় হত্যার অন্যতম ঘাতক খায়রুল ইসলাম ওরফে রিফাত ওরফে ফাহিম ওরফে জিসান ওরফে জামিল। গুলশান হলি আর্টিজান বেকারি ও শোলাকিয়ায় জঙ্গী হামলার মাস্টারমাইন্ড ২০ লাখ টাকার পুরস্কার ঘোষিত শীর্ষ জঙ্গী নেতা মেজর জিয়ার অবস্থান সম্পর্কে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) পারেনি। দীর্ঘ চার মাস বারো দিন পর রবিবার মালিকের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে জঙ্গী হামলার শিকার গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারি। তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ডিবি সূত্রে এ খবর জানা গেছে। ডিবি সূত্র জানায়, খায়রুল ওরফে ফাহিমকে শনিবার পাঁচ দিনের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। তাকে জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে তার ‘বড় ভাই’ শীর্ষ জঙ্গী নেতা আনসারুল্লাহ বাংলাটিমের প্রধান ও সামরিক কমান্ডার সেনাবাহিনীর চাকরিচ্যুত মেজর সৈয়দ জিয়াউল হক জিয়াকে খুঁজছে তদন্তকারীরা। দীপন ও নীলাদ্রি হত্যাকা- ছাড়াও যেসব ব্লগার, লেখক, মুক্তমনাকে হত্যা করা হয়েছে তার তথ্যাদি সংগ্রহের দায়িত্বে থেকে হত্যাকা-ের কথা জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছে রিমান্ডে থাকা খায়রুল ইসলাম ওরফে ফাহিম। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের(ডিবি) তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ খবর জানা গেছে। ডিবি সূত্র জানান, ফাহিম জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছে, ব্লগার নীলাদ্রি চ্যাটার্জি নিলয় ও লেখক প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপনকে ‘বড় ভাইয়ের’ নির্দেশেই হত্যা করা হয়েছে। তার কথিত ‘বড় ভাই’ আনসারুল্লাহ বাংলাটিমের প্রধান চাকরিচ্যুত মেজর সৈয়দ জিয়াউল হক ওরফে মেজর জিয়া ওরফে ইসতিয়াক। খায়রুল ইসলাম ওরফে ফাহিম জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছে ব্লগার নিলয় ও প্রকাশক দীপনকে হত্যাকা-ের আগে তাদের বিষয়ে সকল প্রকার তথ্য সংগ্রহ ও তাদের মনিটরিংয়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল তাকে। সে আনসারুল্লাহ বাংলাটিমের ইন্টেলিজেন্স শাখার সদস্য। তিনি সংগঠনের পুরো আইটি শাখাটি দেখাশোনা করতেন। নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গী সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলাটিমের বিভিন্নœ হত্যাকা-ের পর সংগঠনের বরাদ দিয়ে হত্যার দায় স্বীকার সংক্রান্ত বিভিন্ন পোস্ট করত রিমান্ডে আনা এই জঙ্গী সদস্য খায়রুল ইসলাম। গত শুক্রবার রাত সাড়ে ৯টায় রাজধানীর কমলাপুর এলাকায় অভিযান চালিয়ে আনসারুল্লাহ বাংলাটিমের ইন্টেলিজেন্স শাখার সদস্য খায়রুল ওরফে ফাহিমকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (দক্ষিণ) পুলিশ। গ্রেফতারের পর ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ আদালতে পাঠিয়ে দশ দিনের রিমান্ডের আবেদন জানায়। আদালত তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে। রিমান্ডে আনার পর এখন জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে খায়রুল ওরফে ফাহিমকে। জিজ্ঞাসাবাদে সে জানায়, ব্লগার নীলয় ও প্রকাশক দীপনকে হত্যা করার প্রায় ৫ মাস আগে থেকেই তাদের বিষয়ে সকল তথ্য সংগ্রহ করে সংগঠনের কথিত ‘বড় ভাই’ মেজর জিয়াকে দেখানো হয়। এর পর থেকে তাকে দায়িত্ব দেয়া হয় ব্লগার নিলয় ও প্রকাশক দীপনকে অনুসরণ করার। তাদের প্রতিদিনের কর্মকা- ও চলাফেরা পর্যবেক্ষণ করার জন্য তার সঙ্গে যুক্ত ছিল এমন আরও ৪/৫ জন। যারা ধর্ম বিষয় বিভিন্ন উস্কানিমূলক লেখালেখি করে এবং বিভিন্ন প্রবন্ধ প্রকাশ করে মূলত তাদের তালিকা তৈরি করাই ছিল খায়রুলের কাজ। আর এসব তালিকা সে মেজর জিয়াকে দিত। নির্দেশনা পেলে তা অনুসন্ধান করত তারা। তারপর মেজর জিয়ার নির্দেশ পেলেই হত্যা করা হতো তাদের টার্গেটকে। জিজ্ঞাসাবাদে খায়রুল ওরফে ফাহিম জানায়, মিরপুরের শেওড়াপাড়ায় ৩ দিন, রাজধানীর মোহাম্মদপুর নভোদয় এলাকার একটি বাসায় ৭ দিন ও এলিফ্যান্ট রোডের একটি বাসায় ৭ দিন করে মারকাজ (ট্রেনিং) করে। ২০১৩ সালে আরেক বড় ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হয়। পড়ে সে আনসারুল্লাহ বাংলাটিমে কর্মী হিসেবে যোগদান করে। সে আইটি বিষয়ে পারদর্শী থাকায় সংগঠনের আইটি সেকশনের দায়িত্ব দেয়া হয় তাকে। কথিত বড় ভাই সংগঠনের প্রধান মেজর জিয়ার সঙ্গে তার সরাসরি যোগাযোগ ছিল বলেও জানায় খায়রুল ওরফে ফাহিম। চলতি বছরের ২৬ সেপ্টেম্বর তার সঙ্গে কথিত বড় ভাই মেজর জিয়ার সঙ্গে ঢাকার আশপাশ এলাকায় দেখা হয়েছিল বলেও গোয়েন্দা পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে জানায় খায়রুল ওরফে ফাহিম। প্রসঙ্গত, গত বছরের ৩১ অক্টোবর রাজধানীর শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটে জাগৃতি প্রকাশনীর অফিসে দীপনকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ব্লগার ও লেখক অভিজিৎ রায়ের বইয়ের প্রকাশক ছিলেন তিনি। হত্যার পর আনসারুল্লাহ বাংলাটিমের পক্ষে আনসার আল ইসলাম ওই খুনের দায় স্বীকার করে। এর আগে একই বছরের ৭ আগস্ট রাজধানীর গোড়ানে নিজ বাসায় ব্লগার নিলয়কে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। ওই দিনই এ হত্যার দায় স্বীকার করে জঙ্গী সংগঠন আল-কায়েদার ভারতীয় উপমহাদেশ (একিউআইএস) শাখার নামে বিবৃতি দেয়া হয়। এ হত্যাকা-ের পর আনসারুল্লাহ বাংলাটিমের বেশ কয়েক সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়। এক মাস আগেও ঢাকায় ছিল মেজর জিয়া ॥ ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ঢাকার গুলশান ও শোলাকিয়ায় জঙ্গী হামলার মাস্টারমাইন্ড হিসেবে চিহ্নিত ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থান চেষ্টার পরিকল্পনাকারী হিসেবে বরখাস্ত মেজর সৈয়দ মোঃ জিয়াউল হক কোথায় তা নিয়ে বিভিন্ন সময়ে নানা প্রশ্ন দেখা দেয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন সময়ে বলেছেন, মেজর জিয়া নজরদারিতে, মাস্টারমাইন্ড ও নেপথ্য মদদদাতারা চিহ্নিত। তাদের বক্তব্যে মেজর জিয়াকে আটকের ইঙ্গিত মেলে। তাকে ধরতে ২ আগস্ট পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স থেকে ২০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। এরপর থেকে মেজর জিয়ার আর কোন খোঁজখবর মিলছিল না। আনসারুল্লাহ বাংলাটিমের জঙ্গী খায়রুল ওরফে ফাহিমকে গ্রেফতারের পর রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেল, তার সঙ্গে এক মাস আগেও দেখা হয়েছে মেজর জিয়ার। জিয়া দেশেই আছেন, ঢাকার আশপাশের এলাকায়। আত্মগোপনে থেকে সক্রিয় জিয়া জঙ্গীদের প্রশিক্ষক। ঢাকার অভিজাত এলাকা বারিধারা-বসুন্ধরায় অবস্থান করছেন এমন খবর পাওয়ার ভিত্তিতে অভিযানও চালানো হয়। তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০১২ সালের ১৯ জানুয়ারি সেনাবাহিনী এক সংবাদ সম্মেলনে সরকার উৎখাতে ধর্মান্ধ কয়েক সেনা কর্মকর্তার একটি অভ্যুত্থান পরিকল্পনা নস্যাত করার খবর দেয়। তখনই প্রবাসী ব্যবসায়ী ইশরাক আহমেদ ও মেজর সৈয়দ মোহাম্মদ জিয়াউল হকের নাম আসে, যারা ওই অভ্যুত্থান চেষ্টার মূল পরিকল্পনাকারী বলে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়। গত দুই বছরে বাংলাদেশে একের পর এক ব্লগার, অনলাইন এ্যাক্টিভিস্ট, লেখক-প্রকাশক, বিদেশী নাগরিক ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু হত্যার প্রেক্ষাপটে সম্প্রতি আবারও জিয়ার নাম আলোচনায় আসে। হলি আর্টিজান হস্তান্তর ॥ রবিবার মালিকের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারি। গত ১ জুলাই জঙ্গী হামলার পর পুলিশের তত্ত্বাবধানে ছিল। এই বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) জনসংযোগ শাখার উপকমিশনার মাসুদুর রহমান। তিনি জানান, আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী আজ সোয়া চারটার দিকে আমরা রেস্টুরেন্টটি মালিককে বুঝিয়ে দিয়েছি। হলি আর্টিজানের মালিকদের একজন শাদাত মেহেদী বলেন, পুলিশ আমাদের কাছে হস্তান্তর করেছে। তবে এখন আর হলি আর্টিজান এখানে পুনরায় চালু করা হবে না। এটা এখন বাসা হিসেবে ব্যবহার করা হবে। গুলশানের অন্য জায়গায় জমি নেয়া হয়েছে। সেখানে হলি আর্টিজান নতুন করে চালু করা হবে বলে জানান তিনি। প্রসঙ্গত, এ বছরের ১ জুলাই রাতে গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলা চালিয়ে ২ পুলিশ কর্মকর্তা, ১৭ বিদেশীসহ ২২ জনকে হত্যা করে সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা। পরে সেখানে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে কমান্ডো অভিযানে পাঁচ হামলাকারীসহ ছয়জন নিহত হয়। জঙ্গী হামলার পর থেকেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কড়া পাহারায় ছিল হলি আর্টিজান। এই বেকারিতে সাধারণ মানুষের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। তদন্তের প্রয়োজনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য এবং পরিদর্শনের জন্য পুলিশের অনুমতি সাপেক্ষে বিদেশীরা সেখানে প্রবেশ করতে পারতেন। আলমত যেন নষ্ট না হয়, সেজন্য এই বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থায় আওতায় রাখা হয়েছিল এতদিন। মালিকের কাছে হস্তান্তর করার মধ্য দিয়ে গুলশান হলি আর্টিজান বেকারি দেখার সুযোগ সৃষ্টি হলো।
×