ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

এক বছরে দীপন হত্যাকারীদের মাত্র একজন গ্রেফতার

প্রকাশিত: ০৫:৩৮, ৩১ অক্টোবর ২০১৬

এক বছরে দীপন হত্যাকারীদের মাত্র একজন গ্রেফতার

গাফফার খান চৌধুরী ॥ প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপন হত্যার এক বছর পেরিয়ে গেলেও হত্যায় সরাসরি জড়িত পাঁচজনের চারজনই এখনও পলাতক। পুলিশের দাবি পলাতকরা শনাক্ত হয়েছে। তাদের গ্রেফতারে অভিযান চলছে। পলাতকদের সম্ভাব্য ছবিসহ বিস্তারিত তথ্য দেয়া হয়েছে বিজিবি, বিমানবন্দর, ভারতীয় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থাকে। একজন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীতে দীপন হত্যার কারণ জানিয়েছে। এরা গ্রেফতার হওয়ার পরই এ মামলায় চার্জশীট দাখিলের প্রক্রিয়া শুরু হবে। চার্জশীটে সেনাবাহিনীতে ব্যর্থ ক্যুর চেষ্টাকারী বরখাস্ত মেজর জিয়ার নাম আসছে। পাশাপাশি নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের আধ্যাত্মিক নেতা মুফতি জসীমুদ্দিন রাহমানীকেও জঙ্গীদের হত্যাকা-ের মতো অপরাধে উদ্বুদ্ধ করার দায়ে এ মামলায় অভিযুক্ত করা হতে পারে। মামলাটির তদন্ত সংস্থা ঢাকা মহানগর পুলিশ সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। আজ নানা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে দীপনকে স্মরণ করা হচ্ছে। এর মধ্যে টিএসসির মূল মিলনায়তনে দীপন স্মরণে আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে। এতে প্রধান অতিথি এমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ও বিশেষ অতিথি থাকছেন ঢাবি উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। আলোচনা করবেন বিশিষ্ট নাগরিক ও সুধীজনরা। ২০১৫ সালের ৩১ অক্টোবর দুপুর আড়াইটার দিকে আজিজ সুপার মার্কেটের তৃতীয় তলায় ১৩১ নম্বর কক্ষে জাগৃতি প্রকাশনার মালিক প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপনকে (৪০) ঘাড় ও গলা কেটে হত্যা করা হয়। দীপন ঢাবির বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ও লেখক ড. আবুল কাসেম ফজলুল হকের একমাত্র ছেলে ছিলেন। যে কারণে হত্যা ॥ চলতি বছরের ১৫ জুন প্রকাশক টুটুল হত্যাচেষ্টায় সরাসরি অংশগ্রহণকারী পুরস্কার ঘোষিত সুমন হোসেন ওরফে শাকিব ওরফে শিহাব ওরফে সাইফুলকে গ্রেফতারের পর সিফাতের নাম আসে। আদালতে ১৬৪ ধারায় শিহাবের দেয়া জবানবন্দীতেও সিফাত ও মেজর জিয়ার নাম প্রকাশ পায়। ডিবি সূত্রে জানায়, আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সামরিক শাখার প্রধান মেজর জিয়ার নির্দেশে দীপনকে হত্যা করা হয়। এ বছরের ৩ সেপ্টেম্বর ডিবি পুলিশের হাতে টঙ্গী থেকে গ্রেফতার হয় জঙ্গী সবুর ওরফে সামাদ ওরফে সুজন ওরফে রাজু ওরফে সাদ। পরবর্তীতে সাদ আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেয়। হত্যার জন্য ট্রেনিং ॥ ডিবির একটি সূত্র বলছে, অভিজিত রায়ের লেখা বই প্রকাশ করায় শুদ্ধস্বর ও জাগৃতি প্রকাশনার মালিকরা হত্যার টার্গেটে পরিণত হন। সে মোতাবেক প্রকাশনা সংস্থার টার্গেটকৃতদের সর্ম্পকে তথ্য সংগ্রহ করে এবিটির তথ্য ও প্রযুক্তি শাখা। দীর্ঘদিন ধরেই এমন প্রক্রিয়া চলছিল। দুটি প্রকাশনার মালিকদের হত্যার জন্য দুটি সিøপার সেল গঠন করা হয়। প্রতিটি সিøপার সেলে পাঁচজন করে রাখা হয়। সিøপার সেল দুটির প্রাথমিক প্রশিক্ষণ হয় চট্টগ্রামে। পরে তাদের গাজীপুরের টঙ্গীতে পাঠানো হয়। টঙ্গীর বর্ণমালা সড়কের একটি বাড়িতে সিøপার সেল দুটির প্রশিক্ষণ চলতে থাকে। এরপর সেল দুটির একটিকে পাঠানো হয় ঢাকার উত্তরা এলাকার একটি জঙ্গী আস্তানায়। এ আস্তানায় থাকা সিøপার সেলের পাঁচ সদস্য মোহাম্মদপুরের শুদ্ধস্বর প্রকাশনায় হামলা চালায়। সিøপার সেলটির সদস্যরা আগ থেকেই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ছিল। মহাখালীর আস্তানায় ট্রেনিং ॥ মহাখালীর একটি জঙ্গী আস্তানায় পাঠানো হয় অপর সেলটিকে। ওই সেলটি অতটা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ছিল না। তাদের মহাখালীর আস্তানায় সবুর প্রশিক্ষণ দেয়। সেই প্রশিক্ষণে অন্য সামরিক কমান্ডাররাও ছিল। সেখানে দীর্ঘ দিন প্রশিক্ষণ চলে। প্রশিক্ষণ শেষে একই সময়ে দুটি সেল দুটি অপারেশনে যায়। মহাখালীর আস্তানায় থাকা সেলটি জাগৃতি প্রকাশনীতে হামলা চালায়। হামলায় অংশ নেয়া পাঁচজনের কাছেই পাঁচটি চাপাতি ছিল। শুধু একজনের কাছে আগ্নেয়াস্ত্র ছিল। দীপন হত্যার অপারেশনের মূল দায়িত্ব পালন করে গ্রেফতারকৃত জঙ্গী সিফাত। দুটি অপারেশন শেষে দুটি সেলের সঙ্গে আবার মোবাইল ফোনে যোগাযোগ হয়। মোহাম্মদপুরের অপারেশন সফল না হওয়ায় সেলটিকে রীতিমতো তিরস্কৃত হতে হয়েছিল। অপারেশন শেষে জঙ্গীদের কার্যক্রম ॥ পূর্বপরিকল্পনা মোতাবেক সেলের সদস্যরা যার যার আস্তানায় চলে যায়। মহাখালীর আস্তানায় গিয়ে দীপনের হত্যাকারীরা ব্যাগ গুছিয়ে নেয়। এরপর তারা অস্ত্রশস্ত্র নিয়েই রওনা হয়। সেখান থেকে তারা আরেকটি জঙ্গী আস্তানায় যায়। সেখানে অস্ত্রশস্ত্র জমা দিয়ে যে যার মতো অন্যত্র চলে যায়। সূত্রটি বলছে, হত্যাকারীদের আরেকটি জঙ্গী আস্তানা ছিল যাত্রাবাড়ীর একটি মাদ্রাসায়। সেই আস্তানায়ও প্রশিক্ষণ দেয়া হতো। সেখানে সাগর নামে একজন প্রশিক্ষণ দিত। যাত্রাবাড়ীর আস্তানায় টার্গেটকৃত অন্য দুইজনকে হত্যার জন্য আরও কয়েক জঙ্গীকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছিল। যাত্রাবাড়ীর আস্তানায় দীপনকে সফলভাবে হত্যা করায় শুকরিয়া আদায় করে বিশেষ মোনাজাত, দোয়া, নামাজ আদায় ও মিষ্টি খাওয়া হয়। আর মোহাম্মদপুরের অপারেশন সফল না হওয়ায় রীতিমতো সমালোচনা করা হয় অংশ নেয়াদের সম্পর্কে। তদন্ত সংস্থার বক্তব্য ॥ মামলার তদন্ত সংস্থা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের দক্ষিণ বিভাগের উপকমিশনার মাশরুকুর রহমান খালেদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, দীপন হত্যায় পাঁচজন অংশ নিয়েছিল। হত্যাকারীদের ট্রেনিং দিয়েছিল পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত এবিটির মাঠ পর্যায়ের সামরিক কমান্ডার (মাসুল) শরীফ ও সাদ। হত্যাকা-ে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে শুধু সিফাত গ্রেফতার হয়েছে। সিফাতের দেয়া তথ্য মোতাবেক বাকি চারজনকে শনাক্ত করা হয়েছে। তাদের গ্রেফতার করতে পারলেই দীপন হত্যায় চার্জশীট দাখিলের প্রক্রিয়া শুরু হবে। এই কর্মকর্তা বলেছেন, দীপনসহ ব্লগার, প্রকাশক, লেখকসহ অনেক হত্যাকা-ের ঘটনায় পুরস্কার ঘোষিত মেজর জিয়ার নাম এসেছে। দীপনকে স্মরণ ॥ উগ্রপন্থার আগ্রাসনে ক্ষতবিক্ষত হয় মুক্তচিন্তা। মৌলবাদের চালিকাশক্তি জঙ্গীদের চাপাতির আঘাতে নিহত হতে হয় তরুণ প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপনকে। প্রথম শাহাদাত-বার্ষিকীতে হৃদয়ের ভালবাসায় স্মরণ করা হবে এই মেধাবী প্রকাশককে। আজ বিকেল সাড়ে তিনটায় দীপন স্মৃতি সংসদের উদ্যোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের (টিএসসি) মূল মিলনায়তনে দীপন স্মরণে আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে। এতে প্রধান অতিথি থাকবেন ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান। বিশেষ অতিথি থাকবেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। আলোচনা করবেন বিশিষ্ট নাগরিক ও সুধীজনসহ দীপনের বন্ধুরা। এ আয়োজনে প্রকাশ করা হবে দীপন স্মরণ গ্রন্থ। এছাড়াও আয়োজনে থাকবে আলোকচিত্র প্রদর্শনী, জাগৃতির বইমেলা, দীপনের ডিজাইনকৃত প্রচ্ছদ প্রদর্শনী, মঞ্চনাটক ও দীপনের ওপর নির্মিত প্রামাণ্যচিত্রের প্রদর্শনী। আলোচনা করবেন অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ড. অভিজিতের পিতা ঢাবির পদার্থ বিজ্ঞানের সাবেক অধ্যাপক অজয় রায়, অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, অধ্যাপক আহমেদ কামাল, নাট্যজন মামুনুর রশীদ, সাংস্কৃতিক সংগঠক গোলাম কুদ্দুছ ও ড. আবুল কাসেম ফজলুল হক প্রমুখ। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন দীপন স্মৃতি সংসদের সভাপতি অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবুল বারকাত।
×