ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

চাঁপাই হয়ে ঢাকায় ঢোকে ;###;মুঙ্গেরের কারিগরদের প্রশিক্ষণ দেয় আইএসআই

অস্ত্র আসে মালদহ থেকে

প্রকাশিত: ০৫:৩০, ৩০ অক্টোবর ২০১৬

অস্ত্র আসে মালদহ থেকে

শংকুর কুমার দে ॥ গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তরাঁ ও কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় জঙ্গী হামলার জন্য অস্ত্র তৈরি করা হয় পশ্চিমবঙ্গের মালদহে। ভারতের বিহারের মুঙ্গের থেকে আনা অস্ত্র কারিগররা মালদহে একটি আস্তানায় বসে এসব অস্ত্র বানায়। তাদের অস্ত্র তৈরির প্রশিক্ষণ দিয়েছে কয়েক পাকিস্তানী, যাদের পাঠিয়েছে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই। পরে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে এই অস্ত্র এসেছে ঢাকায়। ভারত হয়ে ঢাকায় আসে জঙ্গীদের জন্য অর্থ। পশ্চিমবঙ্গে গ্রেফতার ছয় জঙ্গীর মধ্য ময়মনসিংহের ত্রিশালে প্রিজনভ্যান থেকে জেএমবির তিন জঙ্গী ছিনতাইয়ের হোতা আনোয়ার হোসেন ফারুক ওরফে জামাই ফারুকই ঢাকায় অস্ত্র পাঠানোরও হোতা। পশ্চিমবঙ্গে আটক বাংলাদেশের তিন ও পশ্চিমবঙ্গের তিন জঙ্গীকে গ্রেফতারের পর রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে এসব তথ্য পেয়েছে ভারতের জাতীয় তদন্ত সংস্থা (এনআইএ)। এনআইএ এই তথ্য পাওয়ায় তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছে ঢাকার গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। হলি আর্টিজানে জঙ্গী হামলার পর সীমান্তবর্তী নদীতে নজরদারি জোরদার করতে ছয় থেকে সাতটি ভাসমান সীমান্ত চৌকি বসানোর পরিকল্পনা নিয়েছে বিএসএফ। ঢাকা ও কলকাতার গোয়েন্দা সূত্র জানায়, গত ২৪ ও ২৫ সেপ্টেম্বর জামাই ফারুকসহ ছয় জঙ্গী আটক করে কলকাতা পুলিশের স্পেশাল টাস্কফোর্স (এসটিএফ)। পশ্চিমবঙ্গ ও অসম থেকে বাংলাদেশের তিন ও ভারতের তিন জঙ্গীকে গ্রেফতার করে তারা। ভারতে আটক ছয় জঙ্গী হচ্ছে আনোয়ার হোসেন ফারুক ওরফে জামাই ফারুক, ওরফে এনাম ওরফে কালো ভাই, মাওলানা ইউসুফ ওরফে বক্কর ওরফে আবু খেতাব, জাহিদুল শেখ ওরফে জাফর ওরফে জবিরুল, রফিকুল ওরফে রুবেল ওরফে পিচ্চি, শহিদুল ইসলাম ওরফে শামীম ও আবুল কালাম ওরফে করিম। এদের মধ্যে রুবেল, জাহিদুল আর ইনাম বাংলাদেশের নাগরিক বলে জানিয়েছে এসটিএফ। ’১৪ সালের পর থেকে এসব জঙ্গী পলাতক ছিল। গ্রেফতার এসব জঙ্গীকে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করে এনআইএ। ’১৪ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ত্রিশালে প্রিজন ভ্যানে হামলা চালিয়ে তিন জেএমবিকে ছিনতাইয়ের মূল পা-া ফারুক। যাদের সে ছিনিয়ে নিয়ে গিয়েছিল, তাদের মধ্যে আছে বোমারু মিজান ওরফে কওসর ও সালাউদ্দিন সালেহি। দু’জনেই খাগড়াগড়ের অন্যতম অভিযুক্ত। এনআইএ কর্মকর্তারা বলেছেন, আটক ছয় জঙ্গীকে জিজ্ঞাসাবাদ করে গুলশান ও শোলাকিয়ায় জঙ্গী হামলার অস্ত্র ও অর্থ সংক্রান্ত যেসব তথ্য পাওয়া গেছে তা যাচাই-বাছাই করছেন তারা। জিজ্ঞাসাবাদে তারা বলেছে, বিহারের মুঙ্গের থেকে কারিগররা এসেছিল, মালদহে একটি আস্তানায় বসে তারা অস্ত্র বানায়। অস্ত্র তৈরির জন্য বিহারের কারিগরদের প্রশিক্ষণ দিয়েছিল কয়েক পাকিস্তানী, তারা সম্পূর্ণ ভিন্ন ভাষায় কথা বলছিল। মনে করা হচ্ছে, ওই প্রশিক্ষকরা পশতু ভাষায় কথা বলছিল, তারা এসেছিল পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের দারা আদম খেল থেকে। ওই পাকি প্রশিক্ষক দারা আদম খেল সম্প্রদায়ের। পেশোয়ার এবং কোহাটের মাঝে এক গ্রামে এই আদিবাসী সম্প্রদায়ের বাস। এরা দেশী-বিদেশী যে কোন ধরনের বন্দুক দেখে সে রকমই জাল বন্দুক তৈরি করতে পারে। তালেবানদেরও এরা আধুনিক অস্ত্র তৈরি করে দেয়। অস্ত্র প্রশিক্ষকের কথাবার্তার যে রকম বর্ণনা ধৃতরা দিয়েছে, তাতে গোয়েন্দাদের ধারণা, ওই প্রশিক্ষক খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশের। আর ওই প্রদেশেই দারা আদম খেল সম্প্রদায়ের বসবাস। আফগান সীমান্তবর্তী পাকিস্তানের ওই এলাকাটি সমরাস্ত্র তৈরির জন্য কুখ্যাত। ওই কারিগররা অল্প সময়েই যে কোন আগ্নেয়াস্ত্রের নকল তৈরি করতে পারেন। প্রকাশ্যেই ওই এলাকায় বাজারে অস্ত্র কেনাবেচা হয়। অন্যদিকে বিহারের মুঙ্গের ছোট ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র তৈরির জন্য পরিচিত। সেখানে পিস্তল জাতীয় অস্ত্র তৈরি হলেও একে-২২ রাইফেলের মতো অস্ত্র সাধারণত তৈরি হয় না। তবে একে-৪৭-এর মতো স্বয়ংক্রিয় রাইফেলের বদলে কেন একে-২২-এর মতো আধা স্বয়ংক্রিয় রাইফেল তৈরি করা হলো, সেই প্রশ্নই ভাবিয়ে তুলেছে এনআইএকে। ভারতে একে-২২ ততটা ব্যবহারও হয় না। ভারতের গোয়েন্দারা বলছেন, সেক্ষেত্রে পাকিস্তানীরাই একে-২২ রাইফেল তৈরির প্রশিক্ষণ দিয়েছিল। আর এতে পাকিস্তানী গোয়েন্দা সংস্থার যোগসাজশও থাকতে পারে। পশ্চিমবঙ্গে গ্রেফতার ওই জঙ্গীরা জিজ্ঞাসাবাদে বলেছে, মালদহে তৈরির পর চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্ত হয়ে অস্ত্রগুলো বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছিল। গুলশানে কমান্ডো অভিযানে জঙ্গীরা মারা যাওয়ার পর একটি ফোল্ডেড বাঁট একে-২২ রাইফেল এবং চারটি পিস্তল উদ্ধারের কথা জানানো হয়। একে-২২ রাইফেল সহজে চালানোর মতো একটি অস্ত্র। এটি প্রথমে তৈরি হয়েছিল রুমানিয়ায়। তবে অস্ত্রটি একে-৪৭ রাইফেলের মতো জনপ্রিয়তা পায়নি বলে মনে করেন গোয়েন্দারা। এসটিএফ প্রধান বিশাল গর্গ গত সেপ্টেম্বরে কলকাতার লালবাজারে এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন, ’১৪ সালে খাগড়াগড় বিস্ফোরণ ঘটনার সঙ্গে এই ৬ জঙ্গী জড়িত। ওই ঘটনার পর উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণ ভারতে পালিয়ে গিয়েছিল তারা। পশ্চিমবঙ্গ ও অসমের একাধিক জায়গা থেকে ওই ছয়জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতার ছয়জনের মধ্যে পাঁচজনের নাম খাগড়াগড় মামলার চার্জশিটে রেখেছিল এনআইএ। এনআইএ ওই ছয়জনকে ধরিয়ে দিতে পুরস্কারও ঘোষণা করেছিল। এক এনআইএ কর্মকর্তা জানান, দুই দিন আগে অসমের কাছাড় থেকে একটা জাল নোটের মামলায় কলকাতা এসটিএফ জাবিরুলকে গ্রেফতার করে। তাকে কলকাতায় নিয়ে এসে। জিজ্ঞাসাবাদে জাবিরুল জঙ্গী বলে স্বীকার করে। তার দেয়া তথ্যের সূত্র ধরে রবিবার নিউ কোচবিহার স্টেশন থেকে কালামকে গ্রেফতার করে পুলিশ। গ্রেফতার ছয় জঙ্গী সাঙ্কেতিক ভাষায় নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রাখত। সেই ভাষার অর্থ খুঁজে বের করে তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে। জঙ্গী কালাম বাংলাদেশ থেকে অসম হয়ে পশ্চিমবঙ্গে ঢোকার চেষ্টা করছিল। বাংলাদেশ থেকে তাকে কাছাড়ে সংগঠনের দায়িত্ব নেয়ার জন্য পাঠানো হয়েছিল। উত্তর ২৪ পরগনার বনগাঁ-বাগদা রোডের ওপর সীমান্তবর্তী একটি জায়গা থেকে ইনাম ও রফিককে গ্রেফতার করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে ফারুক বলেছে, ত্রিশালে প্রিজনভ্যানে হামলা করে তিন জঙ্গী ছিনিয়ে নেয়ার পরে সে পশ্চিমবঙ্গে পালিয়ে এসে সাত-আট মাস মূলত মুর্শিদাবাদে ঘাঁটি গেড়েছিল। লালগোলার মকিমনগর ও বর্ধমানের শিমুলিয়া মাদ্রাসার জিহাদী তালিমকেন্দ্রে নিয়মিত যাতায়াত করত। পশ্চিমবঙ্গে সংগঠনের প্রধান কারিগর আনোয়ার হোসেন ফারুক জেএমবির ভারতীয় শাখার অর্থকরী বিষয়ক প্রধানের দায়িত্বও পালন করে এসেছে। ’১৪ সালের ২ অক্টোবর খাগড়াগড় বিস্ফোরণের পরে সে অসমে পালিয়ে যায়। কিছুদিন কর্ণাটকেও গা-ঢাকা দিয়েছিল। গত আগস্টে ফের পশ্চিমবঙ্গে ঢোকে। সেপ্টেম্বরে লালবাজারের এসটিএফের হাতে ফারুক ছাড়া আর যারা ধরা পড়েছে তারা হলো ইউসুফ গাজি, জাহিদুল ইসলাম, রুবেল মিয়া, শহিদুল ইসলাম ও আবদুল কালাম। জাহিদুল, রুবেল বাংলাদেশের লোক। ত্রিশালে প্রিজনভ্যানে হামলা চালিয়ে তিন জেএমবি জঙ্গীকে ছিনিয়ে নেয়ার পর সীমান্ত পথে মুর্শিদাবাদে চলে যায় জামাই ফারুক। প্রায় সাত-আট মাস জঙ্গীঘাঁটি গেড়ে বসে লালগোলার মাকিমনগর ও বর্ধমানের শিমুলিয়া মাদ্রাসার জিহাদী তালিমকেন্দ্রে যাতায়াত করে খাগড়াগড়ে বিস্ফোরণের ঘটনায় যুক্ত হয়। খাগড়াগড় কা-ের পর পালিয়ে সে অসমে ও কর্ণাটকে গা-ঢাকা দেয়। গত আগস্টে কলকাতায় আসার এক মাস পর গত সেপ্টেম্বরে ছয় জঙ্গীর সঙ্গে গ্রেফতার হয় জামাই ফারুক। কলকাতা পুলিশ ছয় জঙ্গীকে গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদে জানতে পারে জামাই ফারুক খাগড়াগড়ের সঙ্গেও জড়িত। খাগড়াগড়ের কা-ের চার্জশীটভুক্ত আসামি না হলেও তাকে জঙ্গী তৎপরতায় জড়িত থাকার অভিযোগের ঘটনায় হেফাজতে নিয়ে খাগড়াগড়ের কা-ের বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে এনআইএ। ঢাকার তদন্তকারী বলেছেন, গুলশানে জঙ্গী হামলার পর জঙ্গীবিরোধী অভিযানে নব্য জেএমবির মেরুদ- ভেঙ্গে গেছে। জঙ্গীবিরোধী অভিযানের মুখে পলাতক জঙ্গীরা ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে আত্মগোপন করে থাকতে পারে। এজন্য ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে সর্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছে ঢাকার গোয়েন্দারা। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম আগেই বলেছেন, হলি আর্টিজানে জঙ্গী হামলায় ব্যবহৃত রাইফেল সীমান্ত পেরিয়েই এসেছে। সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গ ও অসমে ছয় জঙ্গীকে গ্রেফতার করা হয়। সীমান্তে ভাসমান চৌকি ॥ বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী নদীতে নজরদারি জোরদার করতে ছয় থেকে সাতটি ভাসমান সীমান্ত চৌকি বসানোর পরিকল্পনা করেছে বিএসএফ। আগামী বছর থেকে চৌকি বসানোর কাজ শুরু করবে তারা। বর্তমানে সুন্দরবনসংলগ্ন সীমান্তে এ ধরনের তিনটি চৌকি আছে। বিএসএফের সাউথ বেঙ্গল ফ্রন্টিয়ারের মহাপরিদর্শক পিএসআর অঞ্জনেয়ুলুর উদ্ধৃতি দিয়ে হিন্দুস্তান টাইমসে প্রকাশিত খবরে এ তথ্য জানানো হয়েছে। বিএসএফের এই কর্মকর্তা বলেছেন, সীমান্তে নজরদারি জোরদার করতে আমরা আমাদের নদী সীমান্তে আরও বিওপি (বর্ডার আউটপোস্ট) বসাব। বিএসএফের পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রতিটি বিওপিতে ৩৪ থেকে ৪০ সদস্য ও চার-পাঁচটি স্পীডবোট থাকবে। পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে মিলে এরা স্পীডবোটগুলো নিয়ে এলাকা টহল দেবে। বাংলাদেশ ও ভারতের দক্ষিণবঙ্গকে বিভক্ত করে রেখেছে ইছামতি নদী। সেই নদীর ৮০ কিমি.জুড়ে স্থাপিত হবে এসব আউটপোস্ট। তারা জানিয়েছে, সুন্দরবন অঞ্চলে জলসীমায় ১০২ দ্বীপ রয়েছে, যার ৫৪টিতে মানুষ বাস করে। বাকিগুলো গভীর অরন্য ও সেখানে বন্যপ্রাণীর বসতি। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের প্রায় ৮০ কিমি জুড়ে থাকা এ সীমান্তে নতুন চৌকিগুলো বসানো হবে।
×