ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ডাকাতি করে জঙ্গী অপারেশনের খরচ মেটাতে তারা এ সম্পদ যোগাড় করে

জেএমবির সাত সদস্য গ্রেফতার ॥ স্বর্ণ, টাকা, অস্ত্র উদ্ধার

প্রকাশিত: ০৫:৩০, ১৯ অক্টোবর ২০১৬

জেএমবির সাত সদস্য গ্রেফতার ॥ স্বর্ণ, টাকা, অস্ত্র উদ্ধার

স্টাফ রিপোর্টার ॥ নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন জেএমবির সাত সদস্য গ্রেফতার হয়েছে। উদ্ধার হয়েছে প্রচুর লুণ্ঠিত স্বর্ণালঙ্কার, নগদ প্রায় সাত লাখ টাকা, ডাকাতির কাজে ব্যবহৃত অস্ত্র, গোলাবারুদসহ নানা আলামত। গ্রেফতারকৃতরা দলের নেতাকর্মীদের জামিনে মুক্ত করার ব্যয় মেটাতে দীর্ঘদিন ধরেই ডাকাতি-ছিনতাই করে আসছিল। শুধু গ্রেফতারকৃতরা নয়, পুরনো জেএমবি ধর্মীয় মতপার্থক্যের পাশাপাশি দলের তহবিলে টাকা জমাতে দীর্ঘ দিন ধরেই কথিত অনেক পীর ও ফকিরদের হত্যা করে সেখান থেকে অর্থ লুটে নিচ্ছে। দীর্ঘ দিন ধরেই জেএমবির পুরনো শাখাটি এমন তৎপরতায় জড়িত। তবে গত পাঁচ বছর ধরে কয়েকটি ঘটনার প্রেক্ষিতে জেএমবির অর্থ যোগানোর এমন কৌশলের বিষয়টি সামনে চলে আসে। সোমবার সন্ধ্যায় রাজধানীর তেজগাঁও এলাকায় অভিযান চালায় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ ও পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট। অভিযানে গ্রেফতার হয় মোঃ কাশেম ওরফে কাউসার ওরফে কাশু (২০), নাজমুল হাসান নয়ন ওরফে নরেশ (২৩), মোঃ রাশেদ ওরফে কাকলির বাবা (২৭), মোঃ সেন্টু হাওলাদার ওরফে জাহিদ (২৬), মোঃ আবু বক্কর সিদ্দিক ওরফে শুভ্র ওরফে আকাশ (২০), মোঃ আবদুল বাছেদ (২২) ও মোঃ জুয়েল সরকার ওরফে সোহরাব ওরফে সরকার (৩২)। তাদের কাছ থেকে পাওয়া গেছে লুণ্ঠিত ৬৭ ভরি ওজনের স্বর্ণালঙ্কার, নগদ প্রায় ৭ লাখ টাকা, টেলিভিশন, ল্যাপটপ ও একটি মোটরসাইকেলসহ নানা মালামাল। এছাড়া ৪টি পিস্তল, ৫টি ম্যাগজিন, ১০ রাউন্ড তাজা বুলেট ও ৯টি চাপাতি, ২টি রাম দা, ১০টি মোবাইল, ২টি টিভি, ৪টি ক্যামেরা, বিভিন্ন ধরনের কেমিক্যালের বোতল ৮টি, ৩ প্যাকেট রাসায়নিক পাউডার, ৪টি স্বর্ণ মাপার যন্ত্র, ২টি ল্যাপটপ, একটি ওয়ালটন মোটরসাইকেল ও একটি স্বর্ণালঙ্কার রাখার বাক্স উদ্ধার হয়েছে। মঙ্গলবার মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার ও কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান ডিআইজি মনিরুল ইসলাম জানান, গ্রেফতারকৃতরা নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন জেএমবির সদস্য। তারা জেএমবির পুরনো শাখার সঙ্গে জড়িত। তারা জেএমবির কারাবন্দী আমির ও জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় শূরা কমিটির সাবেক সদস্য মুফতি মাওলানা সাঈদুর রহমান জাফর ও আবু তসলিমের অনুসারী। গ্রেফতারকৃতরা তাদের নেতাদের কারাগার থেকে মুক্তি করতে অর্থ সংগ্রহের জন্য ডাকাতি করত। লুণ্ঠিত টাকা দিয়ে তারা ভাল আইনজীবী নিয়োগ করে দলের নেতাকর্মীদের জামিনে মুক্ত করার পরিকল্পনা করেছিল। রাজধানী ঢাকার বনানী ও তেজগাঁওয়ে দুটি ডাকাতির ঘটনায় গ্রেফতারকৃতদের জড়িত থাকার তথ্য প্রমাণ মিলেছে। তিনি আরও বলেন, ১৯৯৮ সালে জেএমবি গঠনের পর বিভিন্ন সময়ে জেএমবি সদস্যরা ডাকাতি ও ছিনতাইয়ে জড়িত হয়েছে। তাদের নেতা কারাবন্দী মুফতি মাওলানা সাইদুর রহমান ধর্মের বিকৃত ব্যাখ্যা দিয়ে ডাকাতিকে বৈধতা দিতেন। জেএমবির কখনই বড় কোন পৃষ্ঠপোষক ছিল না। তবে পুরনো জেএমবিকে কেউ অর্থায়ন করছে কিনা সে বিষয়ে তদন্ত চলছে। মনিরুল ইসলাম জানান, পুরনো জেএমবির বর্তমান আমির সালাউদ্দিন ওরফে সালেহীন ভারতে পালিয়ে আছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। পুরনো জেএমবির একটি অংশের সঙ্গে আনসার আল ইসলামের সম্পর্ক গড়ে ওঠার ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ ও পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট সূত্রে জানা গেছে, ২০১০ সালের ২৫ মে পুলিশ রাজধানীর কদমতলীর একটি বাড়ি থেকে জেএমবির আমির মুফতি মাওলানা সাইদুর রহমান জাফরকে স্ত্রী ও তার সহযোগীসহ গ্রেফতার করে। এরপর জেএমবির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সাইদুর রহমানের ছেলে বাশার দায়িত্ব নেয়। এরপর থেকেই জেএমবির সাইদুর রহমানের অনুসারীরা দলীয় ফান্ড গঠনের জন্য ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের পথ বেছে নেয়। পাশাপাশি কথিত পীরদের হত্যা করে তাদের বাসা বাড়ি থেকে গণিমতের মাল হিমেবে টাকা পয়সা স্বর্ণালঙ্কার লুটে নেয়া শুরু করে। এমন বিশ্বাসের সূত্র ধরেই পুরনো জেএমবি একের পর এক কথিত পীর, মাজারের খাদেম হত্যা এবং ব্যাংক ডাকাতি করে ঘটনাস্থল থেকে টাকা পয়সা ও মালামাল লুটে নিয়ে তহবিলে জমা করার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। ডিবি সূত্র বলছে, জেএমবির এমনই একটি দলের হাতে ২০১৩ সালের ২১ ডিসেম্বর রাজধানীর ওয়ারী থানাধীন রামকৃষ্ণ (আর কে) মিশন রোডে কথিত ইমাম মাহদীর প্রধান সেনাপতি ও বিশ্ব ত্রাণকর্তা দাবিদার লুৎফর রহমান ফারুক (৫৫) ও তার ছেলে সানোয়ারুল ইসলাম মনির (৩০), খাদেম মঞ্জুর আলম (২৮), মুজিবুল সরকার (৩২), শাহীন (২৪) ও রাসেল (৩৭) খুন হয়। বাড়ি থেকে নগদ টাকা ও স্বর্ণালঙ্কার লুটে নেয় হত্যাকারীরা। এছাড়া ২০১৪ সালের ২৭ আগস্ট রাজধানীর তেজগাঁও থানাধীন পূর্ব রাজাবাজারের নিজ বাড়িতে বেসরকারী টেলিভিশন চ্যানেল আই-এর শান্তির পথে ও কাফেলা নামক ইসলামী অনুষ্ঠানের উপস্থাপক মাওলানা নুুরুল ইসলাম ফারুকীকে একই কায়দায় হত্যা করা হয়। সে বাসা থেকেও নানা মালামাল খোয়া যায়। এছাড়া গত বছরের ২১ এপ্রিল দুপুরে বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের সাভারের জামগড়ার কাঠগড়া বাজার শাখায় বোমা মেরে, গুলি চালিয়ে ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে ব্যাংকের ব্যবস্থাপক, নিরাপত্তারক্ষীসহ তিনজনকে হত্যা করে ক্যাশ লুট করে। ওই ঘটনায় জেএমবি সদস্যসহ সর্বমোট আট জনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। ডাকাতির ঘটনায় গত বছরের ৩০ মে গ্রেফতার হয় নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের শীর্ষ পর্যায়ের নেতা মাহফুজুল ইসলাম শামীম ওরফে সুমন। সুমন ব্যাংক ডাকাতির ‘অপারেশন কমান্ডার’ ছিল। সুমনসহ ব্যাংক ডাকাতির ঘটনায় ১১জন গ্রেফতার হয়। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে অনেকেই পুরনো জেএমবি আবার অনেকেই আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্য। সুমনের বরাত দিয়ে পুলিশ জানায়, পুরনো জেএমবি ও আনসারুল্লাহ বাংলা টিম যৌথভাবে কাজ করছে। সুমনের তথ্যমতে গাজীপুরের টঙ্গী থানাধীন আউচপাড়ার একটি বাড়ি থেকে ব্যাংক ডাকাতির আরও দুইটি নকশা উদ্ধার হয়েছে। ব্যাংক ডাকাতির ঘটনায় গ্রেফতারকৃত জেএমবি সদস্য আল আমিন আদালতে ১৬৪ ধারায় দেয়া জবানবন্দীতেও গ্রেফতারকৃত শামীমের নেতৃত্বে ব্যাংক ডাকাতির ঘটনা ঘটানো হয় বলে দাবি করে। গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, ময়মনসিংহের ত্রিশালে পুলিশ হত্যা করে তিন জঙ্গী ছিনিয়ে নেয়া তিন জেএমবি জঙ্গীর একজন পলাতক সালাহউদ্দীনের সঙ্গে বিরোধের জের ধরে শামীম কয়েকজন অনুসারীকে নিয়ে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমে যোগ দেয়। এরপর ছিনতাই ও ডাকাতির মতো বেশ কয়েকটি ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। পুরনো জেএমবির সদস্যরা গত বছরের গত ১০ মার্চ গাজীপুরের বোর্ডবাজারে একজনকে হত্যা করে বিকাশের পাঁচ লাখ টাকা ছিনিয়ে নেয়। ছিনতাই ঘটনার সঙ্গে শামীম সরাসরি জড়িত। পরবর্তীতে শামীম গ্রেফতার আদালতে ১৬৪ ধারায় দেয়া স্বীকারোক্তিমুলক জবানবন্দীতে এসব ঘটনা স্বীকার করে বলেছে, নিজের জন্য নয়, আল্লাহর নির্দেশে, আল্লাহর পথে খরচের জন্যই ব্যাংক ডাকাতি করা হয়েছিল। ডাকাতির সময় সবার কাছেই একটি করে ছুরি ও হাতবোমা ছিল। সেখানে দুটি পিস্তল ও একটি রাইফেলও ব্যবহার করা হয়েছে। পুরনো জেএমবির একটি গ্রুপ দলের ফান্ড গঠন করতে এবং মতপার্থক্যের কারণে গত বছরের ৫ অক্টোবর রাত পৌনে আটটায় রাজধানীর মধ্যবাড্ডার গুদারাঘাটের নিজ বাড়িতে পিডিবির সাবেক চেয়ারম্যান খিজির খানকে গলা কেঁটে হত্যা করে। খিজির খানকে গলা কেঁটে হত্যাকারী তরিকুল ইসলাম ওরফে তারেক ওরফে মিঠু (২৬) ও তার সহযোগী আলেক বেপারী (৪৮) পরবর্তীতে ডিবির হাতে গ্রেফতার হয়। হত্যাকারী মিঠু আদালতে দেয়া জবানবন্দীতে জানায়, বেশি সওয়াবের আশায় সে একাই খিজির খানকে জবাই করে। তারা পীর-দরবেশ, মাজারসেবক ও ফকিরদের হত্যা করা ঈমানী দায়িত্ব বলে মনে করে। তাদের হত্যা করে নিহতদের বাসা বাড়ি থেকে গনিমতের মাল হিসেবে দামী মালামাল লুট করে তা দলীয় তহবিলে জমা দেয়ার লক্ষ্যেই খিজির খানকে হত্যা করা হয়। গ্রেফতারকৃতদের কাছ থেকে খিজির খানের বাসা থেকে লুণ্ঠিত ২টি ল্যাপটপ, দুইটি ক্যামেরাসহ অন্যান্য মালামাল উদ্ধার হয়। উল্লেখ্য, বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট দেশের ৬৩ জেলায় (মুন্সীগঞ্জ বাদে) সিরিজ সিরিজ বোমা হামলা করে জেএমবি। এছাড়া ঝালকাঠি জেলার সিনিয়র সহকারী জজ সোহেল আহম্মেদ ও জগন্নাথ পাঁড়ের গাড়িতে বোমা হামলা চালিয়ে তাদের হত্যা করে জেএমবি। এ মামলায় ২০০৭ সালের ৩০ মার্চ জেএমবির শীর্ষ নেতা শায়খ আব্দুর রহমান ও ছিদ্দিকুল ইসলাম বাংলাভাইসহ শীর্ষ ছয় জঙ্গীর ফাঁসি কার্যকর হয়। এরপর টানা অভিযানে জেএমবির মেরুদ- ভেঙ্গে পড়ার দাবি করা হলেও একের পর এক ব্লগার, লেখক, প্রকাশক এবং সর্বশেষ গত ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে ২২ জনকে হত্যা এবং ৭ জুলাই কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় দেশের বৃহত্তম ঈদ জামাতে হামলার ঘটনায় জেএমবি আলোচনায় চলে আসে। সংবাদ সম্মেলনে ডিবির যুগ্ম কমিশনার আব্দুল বাতেন ও উত্তর বিভাগের উপকমিশনার শেখ নাজমুল আলম, মিডিয়া বিভাগের উপকমিশনার মাসুদুর রহমান, সিটির উপকমিশনার এ এইচ এম আবদুর রাকিবসহ উর্ধতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
×