ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আনোয়ারায় গড়ে উঠবে মিনি চায়না

প্রকাশিত: ০৫:২৪, ১৬ অক্টোবর ২০১৬

আনোয়ারায় গড়ে উঠবে মিনি চায়না

এম শাহজাহান ॥ চট্টগ্রামের আনোয়ারায় চীনা অর্থনৈতিক অঞ্চলে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ আসছে। এই অঞ্চল ঘিরে চীন সরকার ও দেশটির উদ্যোক্তারা মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করতে যাচ্ছেন। বাংলাদেশে বিনিয়োগের নতুন স্বপ্ন বুনতে শুরু করেছেন তাঁরা। আশা করা হচ্ছে, সব ধরনের অবকাঠামো সম্পন্ন হওয়ার পর এই অর্থনৈতিক অঞ্চলকে ঘিরে বাংলাদেশে গড়ে উঠবে ‘মিনি চায়না’। এখানে গড়ে তোলা হবে-জাহাজ নির্মাণ শিল্পকারখানা, কেমিক্যাল, ফার্মাসিউটিক্যাল, গার্মেন্টস, টেলিযোগাযোগ, মোবাইল ফোন, কৃষিনির্ভর শিল্প-কারখানা, রাসায়নিক দ্রব্য, ডিজিটাল যন্ত্রপাতি, ইলেক্ট্রনিক্স, অটোমোবাইলস, চিকিৎসা-অপারেশনের যন্ত্রপাতি, প্লাস্টিক ও আইটিসহ বিভিন্ন শিল্পকারখানা। সম্পূর্ণ চায়না বিনিয়োগে এই অর্থনৈতিক গড়ে তোলা হলেও এখানে সরকারের ৩০ শতাংশ আর চীনা বিনিয়োগকারীদের ৭০ শতাংশ অংশীদারিত্ব থাকবে। এই প্রকল্পটি বাস্তবায়নের মধ্যদিয়ে প্রায় এক লাখ বাংলাদেশীর নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। জানা গেছে, শতভাগ চীনা বিনিয়োগের এই অঞ্চলটি হবে দেশের প্রথম জিটুজি (বাংলাদেশ ও চীন সরকার) অর্থনৈতিক অঞ্চল। আনোয়ারা উপজেলায় ৭৭৪ একর জমিতে এই অর্থনৈতিক অঞ্চলটি গড়ে তুলতে চীনকে প্রায় ১৬-২০ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করতে হবে। চায়না হারবার ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি এই মেগা প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে। এই অঞ্চলকে ঘিরে বন্দরনগরী চট্টগ্রামে সাড়ে তিন কিলোমিটার দীর্ঘ সুড়ঙ্গ নির্মাণ করে কর্ণফুলী নদীর দুই তীরকে যুক্ত করতে চীনের সঙ্গে চুক্তি করে সরকার। চীনের সাংহাই শহরের আদলে ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ হিসেবে চট্টগ্রামকে গড়ে তোলার চিন্তা থেকেই কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বহু প্রতীক্ষিত টানেল নির্মাণের পরিকল্পনাও নেয় বর্তমান সরকার। জানা গেছে, এই প্রকল্পে ২৯১ একর খাসজমি ইতোমধ্যে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষকে (বেজা) হস্তান্তর করেছে জেলা প্রশাসন। আরও ৪৮৪ একর জমি অধিগ্রহণের কাজও প্রায় শেষ। অধিগ্রহণের জন্য ৪২০ কোটি ৩৭ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। আনোয়ারায় চীনা অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠায় বেলচূড়া, হাজীগাঁও, বটতলী ও বৈরাগ মৌজায় ২৯০ দশমিক ৮৭৫ একর সরকারী খাসজমি বেজার অনুকূলে বন্দোবস্ত দেয়া হয়। এছাড়া গহিরায়ও অর্থনৈতিক অঞ্চল সম্প্রসারণের পরিকল্পনা রয়েছে। বেজা সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে ৩৯ কিলোমিটার, শহর থেকে ২৮ কিলোমিটার এবং শাহ আমানত বিমানবন্দর থেকে ৪৬ কিলোমিটার দূরত্বে এই অর্থনৈতিক অঞ্চল। জাহাজ নির্মাণ শিল্প, ইলেকট্রিক, ফার্নেস ও সিমেন্ট শিল্পকে প্রাধান্য দিয়ে এ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলটি গড়ে তোলা হবে। এই অর্থনৈতিক জোনের কাজ আগামী বছর অর্থাৎ ২০১৭ থেকে শুরু হয়ে শেষ হবে ২০২০ সালের মধ্যে। বিশেষ এই অর্থনৈতিক অঞ্চলে ৩৭১টি শিল্প-কারখানা গড়ে তোলা হবে। বেজা সূত্র জানায়, চীনের জন্য আনোয়ারায় অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলতে ২০১৪ সালের জুনের দ্বিতীয় সপ্তাহে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওই সময় চীন সফরে ছিলেন। এই সমঝোতা স্মারকের আলোকেই আনোয়ারায় চীনের জন্য অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা হচ্ছে। চার বছরের মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন এবং শিল্পকারখানাগুলো উৎপাদনে যাওয়ার কথা রয়েছে। বেজার সচিব মোহাম্মদ আইয়ুব এ প্রসঙ্গে জানিয়েছেন, আনোয়ারায় ৭৭৪ একর জমিতে চীনের জন্য অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও চীনের প্রেসিডেন্ট ইতোমধ্যে এ সংক্রান্ত চুক্তি সই করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব সুরাইয়া বেগম জানান, এ অর্থনৈতিক অঞ্চলের মাধ্যমে চীনের সঙ্গে বন্ধুত্বের নতুন মাত্রা যোগ হলো। এর ফলে চীনের বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাবে। বেজা সূত্র জানিয়েছে, আনোয়ারায় চীনা অর্থনৈতিক অঞ্চলের কাজ পুরোপুরি বাস্তবায়িত হলে চট্টগ্রাম হবে দেশের অন্যতম অর্থনৈতিক প্রাণকেন্দ্র। কর্ণফুলীর তলদেশে টানেল নির্মাণ ঘিরে আনোয়ারায় এই অর্থনৈতিক অঞ্চল হচ্ছে। এ ছাড়া টানেলের সঙ্গে মিরসরাই থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত মেরিন ড্রাইভ এবং আনোয়ারা থেকে কক্সবাজার চার লেন সড়কের প্রকল্প বাস্তবায়নের পরিকল্পনা রয়েছে। তাই চীনের পাওয়ার চায়না নামের আরেকটি প্রতিষ্ঠান মিরসরাইয়ে ৫০০ একর জমিতে শিল্পকারখানা স্থাপন করতে আগ্রহী। এ ছাড়া কক্সবাজারের মহেশখালীতে জমি চাচ্ছে চীনের দুটি প্রতিষ্ঠান। এ প্রসঙ্গে বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান পবন চৌধুরী সম্প্রতি জনকণ্ঠকে বলেন, চট্টগ্রামের আনোয়ারায় চায়না বিনিয়োগের জন্য এই অর্থনৈতিক অঞ্চলটি গড়ে তোলা হবে। সেখানে সরকারের ৩০ শতাংশ আর চীনা বিনিয়োগকারীদের ৭০ শতাংশ অংশীদারিত্ব থাকবে। চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না হারবার ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানিকে (সিএইচইসি) ভূমি উন্নয়ন ও অবকাঠামো নির্মাণের কাজ দেয়ার জন্য চূড়ান্ত করেছে বেজা। অর্থনৈতিক অঞ্চলটির জন্য কেবলমাত্র ৫০ বছরের চুক্তিতে ূমি ও প্রয়োজনীয় বিদ্যুত-জ্বালানির নিশ্চয়তাই বেজার বিনিয়োগ। এছাড়া প্রকল্পের প্রয়োজনীয় অর্থ চীনা বিনিয়োগকারীরাই বহন করবেন। এ অর্থনৈতিক অঞ্চলে ১০০ কোটি ডলার বিদেশী বিনিয়োগ আসবে। এটি বাস্তবায়ন হলে প্রায় এক লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হবে। চীনা বিনিয়োগ প্রসঙ্গে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমাদ জনকণ্ঠকে বলেন, চীন বাংলাদেশকে সবচেয়ে বিনিয়োগযোগ্য দেশ হিসেবে মনে করছে। চীনা প্রেসিডেন্টের সফরসঙ্গী হিসেবে চীনা বিনিয়োগকারীদের ঢল নেমেছে। এতে অন্যান্য দেশের বিনিয়োগকারীরাও বাংলাদেশে আসবেন। এটা বাংলাদেশের জন্য এক বিরাট সাফল্য। তিনি বলেন, চীনের উদ্যোক্তাদের জন্য চট্টগ্রামের আনোয়ারায় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল হচ্ছে। এর ফলে দেশে চীনের বিনিয়োগ বৃদ্ধির নতুন সুযোগ তৈরি হবে। চীনের সঙ্গে বর্তমান যে বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে তা পণ্য রফতানি বৃদ্ধির মাধ্যমে কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। এজন্য চীনের বিনিয়োগ দেশে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। জানা গেছে, বাংলাদেশে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখতে জিন পিংয়ের সফরসঙ্গী হিসেবে বাংলাদেশ ঘুরে গেছেন চীনের শীর্ষ ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা। বাংলাদেশ-চীন বিজনেস ফোরামের বৈঠকে এদেশে তাদের বিনিয়োগ বাড়ানোর আহ্বান জানানো হয়েছে।
×