ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মুনতাসির সিয়াম

কুসুমকলি

প্রকাশিত: ০৬:৩১, ১৫ অক্টোবর ২০১৬

কুসুমকলি

এইচএসসি পরীক্ষার পর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছে পিয়াস। কলেজে যেতে হয় না বলে সারাক্ষণ বাসায় পড়ালেখা করে সে। একদিন পড়তে পড়তে হঠাৎই মাথা ঝিমঝিম করছে তার। মা বাসায় থাকলে আদা-লেবু দিয়ে চা বানিয়ে দিতেন। যখনই তার পড়ালেখা করতে করতে মাথা ঝিমঝিম করে, মা তখন খুব সুন্দর করে এক কাপ আদা-লেবুর চা বানিয়ে দেন তাকে। সঙ্গে সঙ্গে মাথাটা পরিষ্কার হয়ে যায়। কিন্তু বিকেলবেলা মা ছোট খালার বাসায় বেড়াতে গিয়েছেন। কাজেই আর কোন উপায় না থাকায় বাসা থেকে নিচে নামল সে। তারা যে বিল্ডিংটায় থাকে তার পাশেই ছোট্ট একটা চায়ের দোকান আছে। দোকানে ঢুকে সে লক্ষ্য করল দশ-এগারো বছরের একটা মেয়ে খুব মনোযোগসহকারে পড়ছে। তার হাতে একটা ক্লাস ফাইভের বাংলা বই। পিয়াস মুগ্ধ হয়ে মেয়েটার পড়া দেখল কিছুক্ষণ। মেয়েটার চোখেমুখে পড়ালেখার প্রতি বিশেষ অনুরাগ প্রকাশ পাচ্ছে। চেহারায় খুব বেশি উজ্জ্বল না। দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে দরিদ্র পরিবারের মেয়ে। হয়ত দোকানদার মামারই কোন আত্মীয় হবে। তা না হলে এমন সময় এখানে বসে পড়ত না সে। মেয়েটার মুখখানা মায়ায় ভরপুর। এক কথায় মিষ্টি একটা মেয়ে। এবার সে মেয়েটিকে বলল, দোকানদার মামা কোথায় গেছেন? -আব্বা একটু বাইরে গেছেন। আপনি কি চা খাবেন, ভাইয়া? তারমানে মেয়েটা দোকানদারের মেয়ে। ভাইয়া ডাকটা শুনেই পিয়াসের তার ছোট বোন অর্পির কথা মনে পড়ে গেল। সে এবার ক্লাস সিক্সে পড়ে। তাহলে তো এই মেয়েটা প্রায় অর্পিরই সমবয়সী। কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মমতা! প্রায় একই বয়সের দুটো মেয়ে শুধু পরিবারগত কারণে একজন সুন্দর পরিপাটি পোশাক পরে তিনতলা বাসায় বসে পড়ছে। আর একই সময়ে অন্যজন চা এর দোকানে বসে পড়ছে। তার বাবাই হয়ত তাকে এখানে বসিয়ে কোন কাজে গেছেন। এই বিষয়গুলো নিয়ে ভাবলেই পিয়াসের মনটা খারাপ হয়ে যায়। মেয়েটা আবারও জিজ্ঞাসা করল, আপনাকে কি চা বানিয়ে দেব, ভাইয়া? -না থাক, তোমাকে পড়া বাদ দিয়ে চা বানাতে হবে না। দোকানদার মামা আসলে উনিই বানিয়ে দেবেন। তোমার নাম কি? তুমি তো মনে হচ্ছে স্কুলে পড়, তাই না? -আমার নাম কলি। স্কুলে পড়তাম, কিন্তু দুই মাস যাবত স্কুলে যাই না। মাঝেমধ্যে দোকানে অনেক ভিড় হয়, আব্বা একা সামলাইতে পারেন না। যার জন্য আমারে তার সঙ্গে দোকানে কাজ করতে বলছেন। কিন্তু আমার খুব স্কুলে গিয়া পড়ালেখা করতে ইচ্ছা করে। এমন সময় দোকানদার মামা এলো। পিয়াসকে বলল, গরিবের পুলাপানের আবার এত পড়ালেখা কিসের, বাজান! -কিন্তু মামা, কলি তো খুব আগ্রহ নিয়ে পড়ছিল এতক্ষণ। ওর স্কুল বাদ দিয়ে দেয়ানোটা মোটেও ঠিক হয়নি। -কি করমু বলেন! অভাবের সংসারে খাওয়াই জোটে না ঠিকমতো, এরমধ্যে স্কুলের এত খরচ কেমনে দিমু? তবু যদি ছেলে হইতো কষ্ট কইরা না হয় পড়ালেখা শিখাইতাম। বড় হইয়া, চাকরি কইরা রোজগার কইরা আনতো। আমার অভাব দূর হইতো। কিন্তু মেয়া মানুষ যতই পয়সা নষ্ট কইরা পড়ালেখা শিখাই না কেন, বিয়ার পর পরের বাড়িতেই যাওয়া লাগবো। তাই ওরে আমারে সাহায্য করার জন্য দোকানে আনছি। -একদম ভুল কথা বললেন আপনি। ছেলেমেয়ে সকলেই সমান। এমনকি সকল শিশুর সমান অধিকার রক্ষার্থে অক্টোবরে বিশ্ব শিশু দিবসও পালন করা হয়। তাছাড়া আজকাল মেয়েরাও পড়ালেখা শিখে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হয়ে সংসারের হাল ধরছে। আপনি হয়ত জানেন না, আমাদের দেশের সরকারও মেয়েদের শিক্ষার জন্য বিশেষ সুযোগ-সুবিধা দিয়েছেন। বিনা বেতনে শিক্ষার সুযোগ, বই প্রদান, খাদ্যের বিনিময়ে শিক্ষাসহ বিভিন্ন রকমের উপবৃত্তিও প্রদান করে থাকেন। তাছাড়া কলি যদি ক্লাস ফাইভে বৃত্তি পায়, তাহলে সম্পূর্ণ সরকারী খরচে পড়ালেখা করতে পারবে। এত সুযোগ-সুবিধা থাকার পরও যদি এভাবে অবহেলা করেন, তাহলে কিভাবে দেশের উন্নতি হবে? এখন পুরুষদের মতো নারীরাও সমাজের সমান ভূমিকা রাখছে। আজকের কলির মতো ছোট্ট মেয়েরাই পড়ালেখা শিখে বড় হয়ে সমাজের উন্নতিতে ভূমিকা রাখবে। -কিন্তু বাজান, পরীক্ষায় ভাল ফলাফল করতেও পয়সা দিয়া প্রাইভেট পড়া লাগে। আমার দোকানের অবস্থা ভাল না। আমি কেমনে ওর পেছনে খরচ করমু বলেন? তার থাইকা দোকানে আমারে সাহায্য করলে কিছু বেশি রোজগার হবো, যা দিয়া একটু ভাল মত চলতে পারমু। -তা হয়ত পারবেন। কিন্তু মামা, ভেবে দেখেন তো কলি যদি পড়ালেখা শিখে ডাক্তার হয়, অনেক পয়সা রোজগার করে, তখন আপনাকে আর চা বিক্রি করতে হবে না। অনেক সুখে থাকতে পারবেন। আর আপনি রাজি থাকলে আমিও কলিকে ওর পড়ালেখায় সাহায্য করতে পারি। পয়সা লাগবে না। এমন সময় কলি বলে উঠল, আব্বা, আমি পড়ালেখা শিখতে চাই। বড় হইয়া মস্ত বড় ডাক্তার হয়ে তোমার সব কষ্ট দূর করে দিব। আমারে আবার স্কুলে যাইতে দিবা? দোকানদার মামা এবার তার ভুল বুঝতে পারলেন। মেয়ের মাথায় হাত রেখে জবাব দিলেন, আমি ভুল করছিলাম রে মা। কথা দিতেছি, তুই কাল থাইকা আবার স্কুলে যাবি। কলি বাবার কথা শুনে খুশিতে বাবাকে জড়িয়ে ধরল।
×