ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

নাজনীন বেগম

মেয়েরা কবে পাবে মত প্রকাশের স্বাধীনতা

প্রকাশিত: ০৬:২৫, ১৪ অক্টোবর ২০১৬

মেয়েরা কবে পাবে মত প্রকাশের স্বাধীনতা

আবারও কলেজছাত্রী এক তরুণী সহিংস হামলার শিকার হলো। সে আজ স্কয়ার হাসপাতালে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। গত ৪ অক্টোবর মঙ্গলবার সিলেট সরকারী মহিলা কলেজের স্নাতক ২য় বর্ষের ছাত্রী খাদিজা বেগম নার্গিসকে মারাত্মকভাবে জখম করে এক দুর্বৃত্ত। সে নাকি সিলেট শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগের স্নাতকোত্তরের ছাত্র। তার আবার একটি রাজনৈতিক সংগঠনের পরিচয় আছে। বিশ্ববিদ্যালয় শাখার ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক। যদিও কেন্দ্র থেকে তা অস্বীকার করা হয়েছে। আশঙ্কাজনক অবস্থায় প্রথমে তাকে সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ এবং পরবর্তীতে ঢাকা স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কর্তব্যরত চিকিৎসকরা তার শরীরে জটিল অস্ত্রোপচারের পর আশঙ্কামুক্ত হওয়ার কোন নিশ্চয়তা দিতে পারেননি। ৯৬ ঘণ্টার পর সে সামান্য পা নাড়া এবং চোখ খুলতে সক্ষম হলেও বিপদ এখনও কাটেনি বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন। সে এখনও লাইফ সাপোর্টে। সারা বাংলাদেশ স্তম্ভিত, বিক্ষুব্ধ এবং তাদের সামান্য মতটুকু জানাতে গিয়ে এভাবে নির্মমতার বলি হতে হয়। এখানেও সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়ে মনুষ্যত্বের চরম অবমাননা করে বাকস্বাধীনতাকে অসম্মান করে উন্মত্ত, বেপরোয়া বদরুল ধারালো অস্ত্র দিয়ে উপর্যুপরি আঘাত হানে খাদিজার ওপর। জানি না এমন জিঘাংসা ও রক্তাক্ত নৃশংসতার আর কত নজির তৈরি হতে থাকবে দিনের পর দিন। এখনও আগের হত্যাযজ্ঞের কোন বিচারিত সুরাহা তো হয়নিÑ তার ওপর নিত্যনতুন দুর্ঘটনা পুরো দেশকে এক বিব্রতকর অবস্থায় নিয়ে যাচ্ছে। অভিভাবকরা তাদের মেয়েদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত এবং অসহায় পরিস্থিতিতে বিপন্নপ্রায়। অপরাধীরা ধরাও পড়ছে। নিলর্জ্জের মতো তারা সমস্ত অভিযোগ স্বীকারও করছে তাদের জবানবন্দীতে। খাদিজাকে আঘাতকারী বদরুলও এখন পুলিশী হেফাজতে। সেও কিন্তু তার বিরুদ্ধে আনা সমস্ত অভিযোগ স্বীকার করেছে। এই পাশবিক নির্মমতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় সিলেট থেকে সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। অপরাধীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে প্রতিবাদ, আন্দোলন এখনও চলছে। যদি কোন মেয়ের ন্যূনতম মত প্রকাশের স্বাধীনতা না থাকে তাহলে তার মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা কোথায়? বাংলাদেশ আজ সমৃদ্ধির পথে নিরন্তর সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সমাজের অর্ধাংশ হিসেবে নারীরাও যে পিছিয়ে আছে তাও বলা যাবে না। আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, প্রশাসনিক এমনকি প্রতিরক্ষা বাহিনীতেও নারীদের সফল পদচারণা দেশটির সমৃদ্ধির অন্যতম সূচক। তবুও মধ্যযুগীয় কায়দায় প্রকাশ্যে, দিবালোকে, মানুষের উপস্থিতিতে এ ধরনের অমানবিক নৃশংসতা সভ্যতার চরম অপমান। নারীর ওপর এ ধরনের প্রাণঘাতী নির্যাতন আর কতভাবে নারী জাতিকে সমস্যাশঙ্কুল করবে জানি না। দুর্বৃত্তদের এমনই দাপট এবং উদ্ধৃত-অসংহত মনোবৃত্তি যে তারা এখন কাউকেই আর পরোয়া করে না। জনসম্মুখে চাপাতি চালাতে তাদের হাত কাঁপে না, নির্দ্বিধায়, নির্বিঘেœ তারা তাদের হিংস্র নখের আঁচড় বসিয়ে দেয় অবলীলাক্রমে। কোথায় মনুষ্যত্ব! কোথায় মানবিক মূল্যবোধ! কোন্ অশনিসঙ্কেত মানুষের সুস্থ বিবেক আর বোধকে এমন নগ্নভাবে বিপর্যস্ত করছে? কেন কিছু মানুষের মন থেকে স্পর্শকাতর সমস্ত অনুভূতি আর হৃদয়ের ছোঁয়া লোপ পাচ্ছে? কেন আমরা অন্যের মতামতকে সহ্য করতে পারছি না? আমি যা চাইব তাই পেতে হবে এমন অযৌক্তিক দাবি থেকে কেন নিজেকে সামলাতে পারছি না? মনুষ্যত্ব, মানবিকতাবোধ, সচেতন-সুস্থ বিবেকের তাড়না কবে মানুষের হিংস্র জিঘাংসাকে শান্ত করবে জানি না। মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসী খাদিজার বাবা এবং চীনে অধ্যয়নরত খাদিজার ভাই দেশে ফিরে এসে সন্তানের জীবন-মরণ বাঁচার লড়াই দেখবে না এই পাশবিক ঘটনার বিচার চাইবে সেটাও তাদের নানাভাবে অস্বস্তির মধ্যে ফেলেছে। এই মুহূর্তে তারা খাদিজার প্রাণ বেঁচে যাওয়ার দোয়াই কামনা করেছেন দেশবাসীর কাছ থেকে। ফাঁকে ফাঁকে অপরাধীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি এবং প্রধানমন্ত্রীর কাছে এই রক্তাক্ত ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তেরও আবেদন জানিয়েছেন। জানি না কোন পরিবারের এমন অসহায় অবস্থা আমাদের আর কত দেখতে হবে? সব মানুষের মধ্যে সুস্থ ও স্বাভাবিক চিন্তা জেগে উঠুক, স্নেহ-মায়া মমতা আর সূক্ষ্ম হৃদয়ের অনুভূতিতে ভেতরের বোধ সচেতন হোক, মানুষের প্রতি মানুষের সহজাত শুভ কামনা নিঃসৃত হোক এই মুহূর্তে এ ছাড়া আর কিছু বলার নেই।
×