ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ইউনেস্কোর উদ্বেগের জবাব দিয়েছে সরকার

রামপাল বিদ্যুত কেন্দ্র সুন্দরবনের জন্য ক্ষতিকর হবে না

প্রকাশিত: ০৫:৫৭, ১১ অক্টোবর ২০১৬

রামপাল বিদ্যুত কেন্দ্র সুন্দরবনের জন্য ক্ষতিকর হবে না

রশিদ মামুন ॥ রামপাল বিদ্যুত কেন্দ্র বিশ্বের সর্বাধুনিক আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তিতে নির্মাণ করা হবে। এতে সুন্দরবনের কোন ক্ষতি হবে না। জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কোর উদ্বেগের জবাবে জোর দিয়ে সরকারের তরফ থেকে বলা হয়েছে, রামপাল প্রকল্প সুন্দরবন বিধ্বংসী হবে না। গত রবিবার রাতে ইউনেস্কোর কাছে ই-মেইলে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় বাংলাদেশের অবস্থান তুলে ধরে জবাব পাঠিয়েছে। এতে বলা হয়, সর্বাধুনিক কেন্দ্র নির্মাণে বিশ্বব্যাংক এবং বিশ্বব্যাংকের গ্রুপ প্রতিষ্ঠান আইএফসি’র গাইড লাইন শতভাগ মেনে কাজ করা হচ্ছে। পরিবেশ রক্ষায় কয়লা চালিত বিদ্যুত কেন্দ্রের মানের প্রশ্নে এখানে কোন ছাড় দেয়া হচ্ছে না। বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের পদস্থ একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, রবিবার রাতে ইউনেস্কোর কাছে বাংলাদেশের অবস্থান তুলে ধরে চিঠি দেয়া হয়েছে। তিনি জানান, ইউনেস্কো আমাদের বলেছিল, তাদের প্রতিবেদনে কোন বিষয়ে ত্রুটি বিচ্যুতি রয়েছে কি না সে বিষয়ে বাংলাদেশের বক্তব্য জানাতে। সরকার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করে। ওই কমিটি একটি প্রতিবেদন তৈরি করে। সেখানে রামপাল বিদ্যুত কেন্দ্রের পরিবেশ দূষণ কমাতে কি কি ব্যবস্থা রয়েছে তা তুলে ধরা হয়। ইউনেস্কোর কাছে পাঠানো প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সুন্দরবনের পরিবেশ এবং সুন্দরবন আশপাশের এলাকার কথা মাথায় রেখেই বিদ্যুত কেন্দ্রটি নির্মাণ করছে সরকার। বিদ্যুত কেন্দ্রটিতে বিশ্বের সর্বশেষ আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। বিদ্যুত কেন্দ্রটির জন্য সুন্দর বন এবং তার আশপাশের বন ও পানিতে প্রভাব পড়ার বিষয়টি সব থেকে বেশি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিয়েছে সরকার। বিদ্যুত কেন্দ্রটির কয়লা পরিবহন নিয়ে ইউনেস্কো যে আশঙ্কা করে বলেছিল এখানে জাহাজের গমন-নির্গমন বেড়ে যাবে। এতে সুন্দরবনের পরিবেশে মারাত্মক ক্ষতি হবে। সরকারের তরফ থেকে পাঠানো প্রতিবেদনে বলা হয়েছে এখন নৌ-রুটটি মংলা বন্দর ব্যবহার করছে। একই নৌ-রুট ব্যবহার করে রামপাল বিদ্যুত কেন্দ্রে কয়লা আনা হবে। এতে মাত্র দুই ভাগ জাহাজই বেশি আসবে এখনকার তুলনায়। পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের পাঠনো জবাবে বলা হচ্ছে, বিদ্যুত কেন্দ্রটিতে খুব উন্নতমানের পরিশোধনাগার নির্মাণ করা হবে। পানি থেকে তেল ছাড়াও সব ধরনের বর্জ্য পরিশোধন করা হবে। এখান থেকে কোন বর্জ্যই পরিশোধন না কার পরিবেশের সঙ্গে মেশানো হবে না। পরিশোধিত পানির বড় অংশই আবার কেন্দ্রে ব্যবহার করা হবে। ফলে পরিবেশ দূষণের আশঙ্কা থাকবে না। প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে সর্বাধুনিক প্রযুক্তির হওয়ায় বিদ্যুত কেন্দ্রের ৯৯ দশমিক ৯ ভাগ ছাই (কয়লা পোড়ানোর পর অব্যহৃত অংশ) ধরা হবে। যা বাতাসে ছড়াতে পারবে না। বিদ্যুত কেন্দ্রের ছাই বাতাসে ছড়িয়ে যে পরিবেশ দূষণের আশঙ্কা করা হচ্ছে তা সঠিক নয়। সরকারের পক্ষ থেকে আগেই বলা হয়েছে এই ছাই স্থানীয় সিমেন্ট কারখানা এবং সিরামিক কারখানায় কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা হবে। স্থানীয়ভাবে বাজার জরিপ করে দেখা গেছে ছাইয়ের বড় বাজারও রয়েছে। ছাই ধরার পর তা সংরক্ষণের জন্য ২৫ একর জমির উপর একটি সংরক্ষণাগার নির্মাণ করা হবে। অর্থাৎ ছাইকে বাতাস বা পানির সঙ্গে মিশতে দেয়া হবে না। যাতে তা পরিবেশের কোন ক্ষতি করতে পারে। বিদ্যুত কেন্দ্রটিতে ২৭৫ মিটার উচ্চতার চিমনি ব্যবহার করা হবে। যা ৯০ তলা ভবনের চেয়ে বেশি উচ্চতার। বাতাসের স্তর বিবেচনা করে এই চিমনি বাতাসের ওই স্তরে দশমকি ১ ভাগের কম ছাই ছাড়া হবে। বিদ্যুত কেন্দ্রটির ছাই সুন্দরনকে অতিক্রম করে সাগরে গিয়ে পড়বে। সালফার ডাই অক্সাইড এবং নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড বাতাসে ছড়ানোর বিষয়ে ইউনেস্কোর উদ্বেগের জবাবে সরকারের তরফ থেকে বলা হয়েছে, বিদ্যুত কেন্দ্রটিতে এডভান্সড লো নক্স বার্নার প্রযুক্তি যুক্ত করা হবে। এতে করে বাতাসে নক্স ছড়ানোর মাত্রা কোনক্রমেই বিশ্বব্যাংক এবং আইএফসি’এর গাইড লাইনের বেশি হবে না। একই সঙ্গে জবাবে বলা হয়েছে, কেন্দ্রটিতে ফ্লু গ্যাস ডিসালফারাইজার ইউনিট (এফজিডি) ব্যবহার করা হবে। যা অতিমাত্রায় কর্মদক্ষ হওয়ায় সক্স বাতাসে ছড়াবে না। নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের তরফ থেকে এর আগে বলা হয়, কেন্দ্রটির ৯৬ ভাগ ফ্লু গ্যাস ধরা হবে। কেন্দ্রটির পরিবেশগত সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে কেন্দ্রটি বাতাসে নক্স ছড়াবে ৫১ দশমিক ২ মাইক্রোগ্রাম/প্রতি ঘন মিটার সাধারণ বাতাসে সক্স ছড়াবে ৫৩ দশমিক ৪ মাইক্রোগ্রাম/প্রতি ঘন মিটার সাধারণ বাতাসে। (এক মাইক্রোগ্রাম অর্থ এক গ্রামের ১০ লাখ ভাগের এক ভাগ)। পরিবেশ অধিদফতরের অনুমোদিত মাত্রা হচ্ছে নক্সস এবং সক্সের ক্ষেত্রে ৮০ মাইক্রোগ্রাম/ ঘনমিটার। বাতাসে যে পরিমাণ সক্স এবং নক্স ছাড়বে তা পরিবেশ অধিদফতরের অনুমোদিত মাত্রার চেয়ে ৩০ মাইক্রোগ্রাম কম। পশুর নদী থেকে পানি ব্যবহারে ইউনেসকোর উদ্বেগের প্রেক্ষিতে বলা হয়, বিদ্যুত কেন্দ্রটি চক্রাকার পদ্ধতিতে নদীর পানি ব্যবহার করবে। বিদ্যুত কেন্দ্রটি পনি শীতলীকরণ পদ্ধতি ব্যবহার করা হবে। বিদ্যুত কেন্দ্রটি কোন গরম পানি ঠা-া না করে নদীতে ছাড়বে না। এতে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য কোন ক্রমেই ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। পরিবেশগত সমীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী পশুর নদী থেকে পানি প্রত্যাহারের হার হবে শূন্য দশমিক শূন্য পাঁচ (০.০৫%)। বিদ্যুত কেন্দ্রটিতে শীতলীকরণ পদ্ধতি রাখা হয়েছে। পানি ঠা-া করার পর তা আবার নদীতে ছাড়া হবে। এতে নদীর কোন ক্ষতি হবে না। বা প্রভাব পড়বে না। রামপালের কাছেই বঙ্গোপসাগর। এই পানি পশুর হয়ে সমুদ্রে মেশে। নদীর গভীরতাও কম নয়। ফলে বিদ্যুত কেন্দ্রটি নদীর উপর কোন প্রভাব ফেলবে না। ইউনেস্কো বলছে, বিদ্যুত কেন্দ্রের প্রবাহিত বাতাস সুন্দরবনের ক্ষতি করবে। এর প্রেক্ষিতে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, বাতাসের বার্ষিক প্রবাহ পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, বছরের বেশির ভাগ সময় বায়ু দক্ষিণ থেকে উত্তর দিকে প্রবাহিত হয়। শুধু নবেম্বর থেবে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাতাস উত্তর এবং উত্তর-পশ্চিম থেকে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্বে দিকে প্রবাহিত হয়। ফলে বায়ু প্রবাহ সুন্দরবনের কোন ক্ষতি করবে না বরং এটা বনের জন্য একটি প্রাকৃতিক রক্ষা কবচ হিসেবে কাজ করবে। ইউনেসকোকে দেয়া জবাবে ভারত-বাংলাদেশ দুই দেশের সরকার প্রধানের আন্তরিকতায় পরিবেশ উন্নয়নের কথা তুলে ধরা হয়েছে। বলা হয়েছে এই অঞ্চলের পনি বণ্টনে অনন্য নজির স্থাপন করে উভয় দেশ গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি করে। যা এই অঞ্চলের পরিবেশকে সুরক্ষিত করেছে। উভয় দেশ তাদের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে এসব কাজ অব্যাহত রেখেছে। রামপাল বিদ্যুত কেন্দ্র এবং সুন্দরবনের পরিবেশ দেখতে গত মার্চে ইউনেস্কো প্রতিনিধি দল ঢাকায় আসে। ওই সময় তারা সুন্দরবন এবং রামপাল পরিদর্শনে যায়। সম্প্রতি সুন্দরবনের পরিবেশের উপর প্রভাবের কথা উল্লেখ করে বিদ্যুত কেন্দ্রটির স্থান পরিবর্তনের আহ্বান জানায় জাতিসংঘের এই সংস্থা। এরমধ্যেই দেশের পরিবেশবাদীরাও ইউনেস্কোর সঙ্গে যোগাযোগ করে। তারা রামপাল প্রকল্পর বিরোধিতা করে ইউনেস্কোকে চিঠিও পাঠায়। ইউনেস্কোর প্রতিবেদনে দেশের পরিবেশবাদীদের রামপাল বিরোধিতার কথা তুলে ধরা হয়েছে। সম্প্রতি বিদ্যুত জ্বালানি এবং খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ এ প্রসঙ্গে বলেন, এই মুহূর্তে আমরা কোন কাজ বন্ধ করছি না। তবে ইউনেস্কোর উদ্বেগ দূর করার ব্যবস্থা নিয়েছি। তিনি বলেন, আমাদের কাছে যে সুনির্দিষ্ট গবেষণা রিপোর্ট রয়েছে তার ভিত্তিতে আমরা মনে করছি বিদ্যুত কেন্দ্রটি পরিবেশের কোন ক্ষতি করবে না। কোন ধরনের গবেষণা না করেই ইউনেস্কো একটি অপেশাদার প্রতিবেদন দিয়েছে। এটি ইউনেস্কোর মতো প্রতিষ্ঠানের কাছে আমরা আশা করিনি। তিনি বলেন, ‘ইউনেস্কোর প্রতিনিধিদল সুন্দরবনে গিয়েছিল। আমরা আশা করেছিলাম, তারা টেকনিক্যাল বিষয়গুলো নিয়ে বলবে। যেমন কয়লা পরিবহন হলে ঠিক কি পরিমাণ কয়লা নদীতে মিশতে পারে, এতে নদীর পানির ঠিক কি কি পরিবর্তন হতে পারে, কিংবা কেন্দ্রের কারণে কী পরিমাণ কার্বন নিঃসরণ হবে আর তাতে সুন্দরবনের কি কি ক্ষতি হতে পারে। ইউনেস্কোর প্রতিবেদনে এ ধরনের কোন বিষয়ে নির্দিষ্ট করে বলা হয়নি।
×