ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

দল দেখি না, দেখব না, অপরাধীদের সাজা হবেই

প্রকাশিত: ০৬:০২, ৭ অক্টোবর ২০১৬

দল দেখি না, দেখব না, অপরাধীদের সাজা হবেই

সংসদ রিপোর্টার ॥ প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা দৃঢ়কণ্ঠে বলেছেন, যারা আন্দোলনের নামে মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা করেছে, দেশের সম্পদ বিনষ্ট করেছে তাদের কেউ-ই রেহাই পাবে না। তাদের বিচার অবশ্যই হবে। আর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে। তবে যুদ্ধাপরাধীদের যারা আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছে, মন্ত্রী-এমপি বানিয়েছে তাদের কি বিচার হবে না? তাদেরও বিচার হওয়া উচিত। যুদ্ধাপরাধীদের যারা মন্ত্রী বানিয়েছে, তাদের বিচারও এই বাংলার মাটিতে অবশ্যই একদিন হবে। সিলেটে কলেজছাত্রী খাদিজা আক্তার নার্গিসকে কুপিয়ে আহত করার ঘটনা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, অপরাধীদের দল হিসেবে আমরা প্রশ্রয় দিচ্ছি না। অপরাধী অপরাধীই, সে যে দলেরই হোক। যে অপরাধী তাকে শাস্তি পেতেই হবে, রেহাই পাবে না। এ প্রসঙ্গে বিএনপির সমালোচনার জবাবে তিনি বলেন, আন্দোলনের নামে বিএনপি-জামায়াত জোট প্রকাশ্য মানুষের গায়ে পেট্রোল ঢেলে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মেরেছে। প্রকাশ্য মানুষ হত্যা, নৃশংসতা ও কুপিয়ে আহত করার পশুত্বের পথ তো বিএনপি-জামায়াত জোটই শিখিয়ে দিয়ে গেছে। তাদের দেখানো অমানবিকতার ঘটনার রেশই তো এখনও চলছে। স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে বৃহস্পতিবার ১০ম জাতীয় সংসদের দ্বাদশ অধিবেশনের সমাপনী বক্তব্যে রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। কলেজছাত্রী খাদিজার ওপর হামলার ঘটনা প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, প্রকাশ্যে একটি মেয়েকে কোপানো হচ্ছে, পাশে দাঁড়িয়ে থেকে অনেকে ভিডিও করলেও ওই মেয়েটির জীবন বাঁচাতে এগিয়ে যায়নি! পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেদের হাতের কাছে কিছুই ছিল না? কেন সবাই মিলে একজোট হয়ে মেয়েটিকে রক্ষা করতে গেল না। কেন মানবিক মূল্যবোধ এভাবে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে? এ প্রসঙ্গে কিছু গণমাধ্যম ও মানুষের ভূমিকার সমালোচনা করে শেখ হাসিনা বলেন, কিছু পত্রিকা ও মানুষ এটাকে দলীয় হিসেবে প্রচারের চেষ্টা করছে। এটা রাজনৈতিক বা দলীয় কোন্দল ছিল না। এটা কী কারণে হয়েছে তা সবাই জানে, পত্র-পত্রিকাতেও এসেছে। প্রেম প্রত্যাখিত হওয়ায় এ হামলার ঘটনা ঘটেছে। প্রত্যাখ্যান হওয়ায় এভাবে কুপিয়ে মারবে? তিনি বলেন, আমরা অপরাধীকে ধরেছি। দলীয়ভাবে প্রশ্রয় দিচ্ছি না। অপরাধীকে শাস্তি পেতেই হবে। কে কোন্ দল করে আমি সেটা দেখি না, দেখবও না। যে অপরাধী তার অবশ্যই বিচার হবে। নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের বিএনপি-জামায়াত জোটের নেতাদের অভিযোগের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ এখন সব দিক থেকে এগিয়ে যাচ্ছে। যখন দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, সব দিক থেকে দেশের উন্নয়ন হচ্ছে, তখনই কিছু না কিছু ঘটনা ঘটে, যা দুঃখজনক। এ প্রসঙ্গে বিএনপি-জামায়াত জোটের নির্বাচন বানচাল এবং অবরোধ-হরতালের নামে নির্বিচারে পুড়িয়ে মানুষ হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, খালেদা জিয়া প্রতিজ্ঞা করেছিলেন আওয়ামী লীগ সরকারের পতন না ঘটিয়ে তিনি ঘরে ফিরে যাবেন না। এজন্য তিনি প্রকাশ্য আগুন দিয়ে পুড়িয়ে শত শত মানুষকে হত্যা করলেন, দেশের কোটি কোটি টাকার সম্পদ ধ্বংস করলেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, তারা (বিএনপি-জামায়াত জোট) মামলার কথা বলেন। তারা যে নির্বিচারে মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা করলেন, জীবন্ত মানুষের গায়ে পেট্রোল ঢেলে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে হত্যা করলেন, তার কি কোন বিচার হবে না? যারা তাদের অগ্নি সন্ত্রাসের শিকার হয়ে পরিবার-পরিজন হারালেন, দগ্ধ হয়ে এখনও জীবন-মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন, তাদের কি বিচার চাওয়ার কোন অধিকার নেই? যারা মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা করেছে, নাশকতা চালিয়ে দেশের সম্পদ বিনষ্ট করেছে তাদের অবশ্যই বিচার হবে, শাস্তি তাদের পেতেই হবে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আমাদের নির্বাচনী অঙ্গীকার ছিল। আর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করেছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করে জিয়াউর রহমান যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ করে দেন। যুদ্ধাপরাধীদের ছেড়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী-মন্ত্রী-উপদেষ্টা বানিয়ে পুনর্বাসন করেন। আর তার স্ত্রী খালেদা জিয়া যেসব যুদ্ধাপরাধী সর্বোচ্চ আদালতে দ-িত হয়েছে, দ- কার্যকর হয়েছে, সেসব যুদ্ধাপরাধীকে মন্ত্রী বানিয়ে তাদের হাতে লাখো শহীদের রক্তস্নাত জাতীয় পতাকা তুলে দিয়েছিল। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, যারা যুদ্ধাপরাধীদের মন্ত্রী বানিয়েছিল তাদের কি বিচার হবে না? তাদেরও বিচার হওয়া উচিত। কেননা যে অপরাধ করে আর যে অপরাধীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় ও সমর্থন দেয় তারাও সমান অপরাধী। তাই বাংলার মাটিতে একদিন তাদেরও বিচার হবে। তার সরকারের জঙ্গী-সন্ত্রাসবিরোধী কঠোর অবস্থানের কথা তুলে ধরে সংসদ নেতা বলেন, জঙ্গী-সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আমরা কঠোর অবস্থান নিয়েছি। জড়িতদের বিরুদ্ধে অবশ্যই কঠোর হতে হবে। এ ব্যাপারে দেশবাসীকে সজাগ ও সতর্ক থাকার পাশাপাশি সকল অভিভাবক ও শিক্ষকের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, সবাই নিজের ছেলেমেয়ে ও ছাত্রছাত্রীদের দিকে খেয়াল রাখুন। কে কী করছে, কোথায় যাচ্ছে, কার সঙ্গে মিশছে তা নজরে রাখুন। এ ব্যাপারে ধর্মীয় শিক্ষকদেরও এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ইসলাম শান্তির ধর্ম, জঙ্গী-সন্ত্রাসীদের ধর্ম নয়। ইসলাম ধর্মে কোন জঙ্গী-সন্ত্রাসবাদের স্থান নেই। যারা ধর্মের নামে মানুষ হত্যা করছে, এরা প্রকৃতপক্ষে ইসলাম ধর্মেরই ক্ষতি করছে। শেষ বিচারের মালিক একমাত্র রাব্বুল আলামিন, অন্য কেউ নয়। সবাই বিপথের পথ ছেড়ে শান্তি ও মানবতার পথে ফিরে আসুক- এটাই আমি চাই। ভারত-পাকিস্তানকে উত্তেজনা প্রশমনের আহ্বান ॥ সম্প্রতি ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে সৃষ্ট উত্তেজনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তি বজায় থাকুক এটাই আমরা চাই। কোন রকম সংঘাত বা উত্তেজনা হোক এটা আমরা চাই না। যে কোন দেশই হোক, কোন দেশের মধ্যে সংঘাত হলে বাংলাদেশও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ভারত ও পাকিস্তান সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, আমি উভয় দেশকে আহ্বান জানাব তারা যেন সংযত আচরণ করে, কোন উত্তেজনা যেন সৃষ্টি না হয়। বাংলাদেশের উন্নয়ন বিশ্বের কাছে বিস্ময় ॥ সরকারের উন্নয়ন ও সফলতা তুলে ধরতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি যে আজ সব দিক থেকে শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে তা প্রমাণিত। অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থাও তা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে। সারাবিশ্বের কাছে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে বাংলাদেশ স্বীকৃতি পেয়েছে। বিশ্ববরেণ্য অনেক নেতাও বাংলাদেশের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। উন্নয়নে বিস্ময় প্রকাশ করে অনেকে কী ম্যাজিকে এটা সম্ভব হলো তাও জানতে চেয়েছেন। আমি তাদের বলেছি, কোন ম্যাজিক নয় বরং দেশের মানুষের কল্যাণ ও উন্নয়নের চিন্তা নিয়ে কাজ করেছি বলেই এটা সম্ভব হয়েছে। এবার জাতিসংঘে প্রাপ্ত দুটি পুরস্কারও দেশের জনগণের প্রতি উৎসর্গ করে বলেন, দেশের জনগণ আমাদের ভোট দিয়ে দেশ সেবার সুযোগ দিয়েছিল বলেই আমরা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারছি, দেশের জন্য সুনাম ও পুরস্কার অর্জন করতে পারছি। এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, আমাদের টার্গেটই হচ্ছে ২০২১ সালের মধ্যে দেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করা। ইতোমধ্যে আমরা নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশের স্বীকৃতি পেয়েছি। বাঙালী জাতি বিজয়ী জাতি, বীরের জাতি। দেশের মানুষের মধ্যে এই আত্মবিশ্বাস থাকতে হবে যে, আমরা বিজয়ী জাতি, আমাদের কেউ পরাজিত করতে পারবে না। প্রতিটি ক্ষেত্রেই আমরা বিজয়ী হতে চাই, মাথা উঁচু করে চলতে চাই। ছেলেমেয়েকে নিয়ে মা হিসেবে আমি গর্বিত ॥ ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্বীকৃতিস্বরূপ এবার তাঁর পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কম্পিউটার শিক্ষা এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের চিন্তা আমি জয়ের কাছ থেকেই পেয়েছি। তার মতামত, পরামর্শ ও সহযোগিতায় আজ আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে পেরেছি। এ কারণে এবার সজীব ওয়াজেদ জয়ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছে। তিনি বলেন, আর আমরা কেউ অটিজমে সচেতন ছিলাম না। আমার মেয়ে সায়মা হোসেন পুতুল এ ব্যাপারে আমাদের সচেতন করেছে। তার পরামর্শেই আমরা অটিজম ফাউন্ডেশন গঠন করেছি। সায়মা হোসেন এখন জাতিসংঘে পরামর্শক হিসেবে কাজ করছে। তার একটি প্রস্তাব জাতিসংঘের রেজুলেশনে পাস হয়েছে। আমি প্রতিটি ঈদ, পহেলা বৈশাখের শুভেচ্ছা কার্ড অটিস্টিক শিশুদের আঁকা ছবি দিয়ে তৈরি করি। যে শিশুর ছবি স্থান পায়, তাকে এক লাখ টাকা দিয়ে উৎসাহিত করি। এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, রাজনীতির কারণে ছেলেমেয়েকে তেমন সময় দিতে পারিনি। হোস্টেলে থেকে তাদের পড়াশোনা করতে হয়েছে। কষ্ট করেও তারা বিশ্বের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রী নিয়ে দেশ ও জনগণের সেবা করছে। এজন্য মা হিসেবে আমি গর্বিত। শুধু জয়-পুতুলই নয়, শেখ রেহানার তিন সন্তানও একেকটা সোনার টুকরা। প্রধানমন্ত্রী এ সময় তাদের জন্য দেশবাসীর দোয়া কামনা করে বলেন, আল্লাহর রহমত ও দেশবাসীর দোয়া ছিল বলেই সন্তানদের মানুষের মতো মানুষ করতে পেরেছি।
×