ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ঘরে ফেরা

সব রাস্তায় ভয়াবহ জট, ট্রেনযাত্রায় সিডিউল বিপর্যয়

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৬

সব রাস্তায় ভয়াবহ জট, ট্রেনযাত্রায় সিডিউল বিপর্যয়

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ভোগান্তির যাত্রায় ঈদের আনন্দ রাস্তায় শেষ হয়ে যাচ্ছে। উত্তর-দক্ষিণ সব দিকের রাস্তা ভয়াবহ যানজটের কবলে ছিল সারাদিন। রবিবার সকালের ট্রেনযাত্রাও ভুগিয়েছে ঘরমুখো মানুষকে। রাজধানীর বিমানবন্দর রেলস্টেশনে সকালে একটি ট্রেন বিকল হয়ে পড়ায় সকল ট্রেনের সিডিউল এলোমেলো হয়ে গেছে। মাওয়া-কাওড়াকান্দি এবং পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ঘাটে কয়েক কিলোমিটারজুড়ে ছিল পরিবহন জট। সন্ধ্যায় যাত্রীর চাপ বেশি থাকলেও নৌযাত্রা ছিল অনেকটাই স্বাভাবিক। ঈদের আগে ও পরে তিন দিন করে মহাসড়কে ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান চলাচল বন্ধ থাকার নির্দেশ মানছে না কেউ। যথারীতি ঢাকা ছেড়ে যাওয়া কোন পরিবহনই নির্দিষ্ট সময়ে যেতে পারেনি। গড়ে নির্ধারিত সময়ের ১২ থেকে ১৬ ঘণ্টা পর বিভিন্ন কোম্পানির পরিবহন ঢাকা ছেড়েছে। নির্দিষ্ট যাত্রার আগে পরিবহনগুলো তাদের যাত্রীদের ফোনে পরিবহন না ছাড়ার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে পরিবর্তিত সময় জানিয়ে দিয়েছে। সে অনুযায়ী যাত্রীরা গেলেও রাস্তায় উঠেই ফের কচ্ছপগতির শিকার হয়েছে পরিবহনগুলো। শনিবার রাতে যেসব পরিবহন ছেড়ে যাওয়ার কথা ছিল সে পরিবহনগুলো রবিবার সকাল থেকে ছাড়তে শুরু করে। আর রবিবার সকালে যে পরিবহনগুলোর ঢাকা ছাড়ার কথা ছিল সেগুলো ছেড়েছে গত রাত থেকে। রবিবার সকাল ১০টায় ঢাকা ছেড়ে যাওয়া একজন সাংবাদিক সেরাজুল ইসলাম সন্ধ্যায় জানান, কেবলমাত্র তাদের পরিবহনটি বঙ্গবন্ধু সেতুর ওপর উঠছে। পুরো রাস্তায় যানজট ছিল। গাড়ি ১০ মিনিট চলছে তো ৩০ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকছে। যাও চলেছে তার গতি ছিল খুব কম। বঙ্গবন্ধু সেতুর ওপারেও তীব্র যানজট রয়েছে। ফলে কখন রংপুর পৌঁছাতে পারবেন তা বলা কঠিন। আমাদের জেলা প্রতিনিধিদের পাঠানো খবরে দেখা যায়, সব মহাসড়কেই ছিল তীব্র যানজট। যানজটের কারণে কোন রাস্তায়ই গাড়ি ঠিকমতো চলতে পারেনি। দীর্ঘ সময় রাস্তায় তীব্র গরমে নারী ও শিশুদের বিপাকে পড়তে হয়েছে। রবিবার সকালে সিলেটগামী একটি ট্রেন ঢাকার বিমানবন্দর স্টেশনে বিকল হয়ে পড়ায় কয়েক হাজার মানুষকে বিপাকে পড়তে হয়। সকাল পৌনে ৭টায় সিলেটের উদ্দেশে কমলাপুর স্টেশন ছেড়ে যাওয়ার ১৫ মিনিটের মাথায় পারাবত এক্সপ্রেসের দুটি কোচের ‘এয়ার প্রেসার ব্রেক আউট’ হয়ে যায়। এর কিছুক্ষণ পর খুলনাগামী সুন্দরবন এক্সপ্রেসও বিমানবন্দর স্টেশনের আগে খিলক্ষেতে একই সমস্যায় পড়ে। এতে অন্তত ১১টি ট্রেনের সূচীতে কয়েক ঘণ্টার বিলম্ব হয়। কমলাপুর স্টেশনে বিভিন্ন গন্তব্যের অপেক্ষমাণ হাজার হাজার যাত্রী পড়েন ভোগান্তিতে। পারাবতের পেছনেই আটকা পড়ে থাকে সকাল ৭টায় কমলাপুর ছেড়ে আসা সোনারবাংলা এক্সপ্রেস। তেজগাঁও স্টেশনে বসে থাকে তিস্তা এক্সপ্রেস। এছাড়া রাজশাহীর ধূমকেতু এক্সপ্রেস, চট্টগ্রামের মহানগর প্রভাতী, নেত্রকোনার মোহনগঞ্জের মহুয়া এক্সপ্রেস, চট্টগ্রামের কর্ণফুলী এক্সপ্রেস, দেওয়ানগঞ্জের ঈদ স্পেশাল, গাজীপুরের জয়দেবপুর এক্সপ্রেস, জামালপুরের তারাকান্দির অগ্নিবীণা এক্সপ্রেস, রংপুর এক্সপ্রেস ও দিনাজপুরের একতা এক্সপ্রেসকে কমলাপুর স্টেশনে বসে থাকতে হয়। প্রায় আড়াই ঘণ্টা পর সকাল সাড়ে ৯টার দিকে দুটি ট্রেনের ‘এয়ার প্রেসার ব্রেক’ ঠিক করে দেয়ার পর ফের ট্রেন ছেড়ে যেতে শুরু করে। কমলাপুর স্টেশনের ব্যবস্থাপক সিতাংশু চক্রবর্তী জানান, পারাবত ট্রেনটি বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশনে ভ্যাকুয়াম সমস্যার কারণে আটকে থাকায় ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়ার লাইন ‘ব্লক’ হয়ে যায়। তিনি বলেন, আমাদের লোকজন এগুলো মেরামত করে দিয়েছে। দুপুরের পর আস্তে আস্তে পরিস্থিতি ঠিক হয়ে যাবে। এর মধ্যে সকাল ৯টার রংপুর এক্সপ্রেস কমলাপুর ছেড়ে যায় দুপুর সোয়া ১২টায় এবং সকাল ১০টার একতা এক্সপ্রেস ছেড়ে যায় দুপুর পৌনে ১২টায়। রাজশাহীগামী ধূমকেতু এক্সপ্রেস, চট্টগ্রামের মহানগর প্রভাতী, মোহনগঞ্জগামী মহুয়া এক্সপ্রেস, চট্টগ্রামের কর্ণফুলী এক্সপ্রেস, দেওয়ানগঞ্জের ঈদ স্পেশাল, গাজীপুরের জয়দেবপুর এক্সপ্রেস এবং তারাকান্দি রুটের অগ্নিবীণা এক্সপ্রেস নিধারিত সময়ের পর ছেড়ে যায়। রবিবার সকাল থেকে সারাদিনই গাজীপুরের ভোগড়া থেকে চন্দ্রা পর্যন্ত ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে ১৩ কিলোমিটার যানজট দেখা গেছে। ভোগড়া বাইপাস থেকে বোর্ডবাজার পর্যন্ত ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে তীব্র যানজট ছিল। কালিয়াকৈর-নবীনগর সড়কের কয়েক কিলোমিটার এলাকায় যানজট দেখা যায়। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এ জট আরও তীব্র হয়। নিজস্ব সংবাদদাতা মির্জাপুর থেকে জানান, ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে অবাধে চলছে ট্রাক, কাভার্ডভ্যান ও লরি। ঈদের আগের তিন দিন ও পরের তিন দিন জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কে ট্রাক, কাভার্ডভ্যান ও লরি চলাচল বন্ধ থাকার কথা থাকলেও চালকরা তা মানছে না। ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে অবাধে চলছে এসব যানবাহন। রবিবার মহাসড়ক ঘুরে এ দৃশ্য দেখা গেছে। জানা গেছে, বুধবার সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির বৈঠকে মন্ত্রণালয় ওই তথ্য জানায়। পরে সংসদীয় কমিটির বৈঠক শেষে কমিটির সদস্য রেজওয়ান আহাম্মদ তৌফিক বিষয়টি সাংবাদিকদের জানান। তিনি জানিয়েছিলেন, ঈদে সাধারণ মানুষের যাত্রা যাতে নির্বিঘœ ও নিরাপদ হয়, সেজন্য মন্ত্রণালয় ওই ব্যবস্থা নেয়। এদিকে, মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত মোতাবেক শনিবার থেকে মহাসড়কে ওই সব যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকার কথা থাকলেও তা বন্ধ হয়নি। অবাধে মহাসড়কে ওই সব যানবাহন চলছে। রংপুরগামী কাভার্ডভ্যান চালক মোঃ রানা জানান, তিনি ওই নিষেধাজ্ঞার কথা শোনেননি। মির্জাপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মাইন উদ্দিন জানান, আমাদের দেশের চালকরা সচেতন নয়। ওই সব যানবাহন চলাচল বন্ধ রাখতে চালক ও মালিকদেরই সচেতন হতে হবে। মুন্সীগঞ্জ থেকে স্টাফ রিপোর্টার জানান, মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলার শিমুলিয়া ঘাটে সোমবারও ঈদে ঘরমুখো যাত্রীদের ঢল নামেছিল। সকাল থেকে যাত্রীদের চাপ ছিল প্রচুর। তবে ফেরিঘাটে প্রাইভেট গাড়ির অতিরিক্ত চাপে যানজটের সৃষ্টি হয়। দুপুরের পর কিছুটা হালকা হলেও যানজট নিরসন হয়নি। তাছাড়া গত তিন দিন ধরে ট্রাক পারাপার না করায় এ প্রান্তে তিন শতাধিক পণ্যবাহী ট্রাক আটকা পড়েছে। ওপারে কাওড়াকান্দি ঘাটেও ট্রাকের দীর্ঘ লাইন লেগে আছে। বিআইডব্লিউটিসির ম্যানেজার (বাণিজ্য) মোঃ গিয়াস উদ্দিন পাটোয়ারী জানান, গত তিন দিন ধরে শিমুলিয়া ঘাটে ঈদে ঘরমুখো যাত্রীদের অতিরিক্ত গাড়ির চাপে যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। বিশেষ করে ছোট ছোট প্রাইভেটকার ও যাত্রীবাহী বাসের কারণে এ যানজট। গতকাল রবিবার সকাল থেকেই ফেরিঘাটে যানবাহনের চাপ পড়ে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যানবাহনের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। তবে বিকেলের দিকে যানজট কিছুটা হালকা হয়। ঘাটে তেমন যাত্রীবাহী বাস না থাকলেও শতাধিক ছোট ছোট গাড়ি রয়েছে পারাপারের অপেক্ষায়। তাছাড়া গত তিন দিন ধরে কোন প্রকার ট্রাক পার করা হয়নি। প্রায় ১০ কি.মি দূরে শ্রীনগরের ছনবাড়ি নামক স্থানে এসব পণ্যবাহী ট্রাক আটকে দেয়া হয়েছে। তাছাড়া ঘাটেও আটকা পড়েছে বেশকিছু ট্রাক। ওপারে কাওড়াকান্দি ঘাটেও পণ্যবাহী ট্রাকের দীর্ঘ লাইন পড়েছে। এদিকে, ঢাকা থেকে অধিকাংশ যাত্রী লোকাল বাসে করে শিমুলিয়ায় এসে নামছে। এতে লঞ্চ ও সি-বোট ঘাটে যাত্রীদের উপচেপড়া ভিড় দেখা গেছে। যাত্রীরা লঞ্চ, সি-বোট ও ফেরিতে নদী পার হয়ে ওপারে গিয়ে আবার অন্য যানবাহনে করে গন্তব্যে যাচ্ছে। তবে শিমুলিয়া ঘাট থেকে ফেরির যাত্রীদের নিকট থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। ইজারাদার লিয়াকত মাতবরের লোকজন ২৫ টাকা ভাড়ার স্থলে যাত্রীদের নিকট থেকে ৩০-৩৫ টাকা আদায় করছে। এ ব্যাপারে লিয়াকত মাদবর বলেন, ভাড়া বেশি নেয়ার কথা নয়। নিয়ে থাকলে আমার জানা নেই। মানিকগঞ্জ থেকে নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, রবিবার বিকেলে পাটুরিয়া ঘাট দিয়ে পারাপারের জন্য দীর্ঘ লাইন দিয়ে অপেক্ষায় ছিল ছোট-বড় প্রায় এক হাজার যানবাহন। ঘাট থেকে যাত্রীবাহী বাসের লাইন চার কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে পড়ে। এছাড়াও ৫নং ঘাট থেকে মহাসড়ক পর্যন্ত দুটি বাইপাস সড়ক দিয়ে ছয় কিলোমিটার লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে ধীরগতিতে পার হয় প্রাইভেটকার ও মাইক্রোবাস। ঈদ-উল-আযহা উপলক্ষে ১৯টি ফেরি সচল রাখার কথা থাকলেও চলছে মাত্র ১৩-১৪টি। ফেরির সংখ্যা কমের কথা স্বীকার করছে না বিআইডাব্লিউটিসি কর্তৃপক্ষ। প্রচ- গরমে চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন হাজার হাজার মানুষ। রবিবার ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের মানিকগঞ্জ এলাকার কিছু কিছু স্থান দিয়ে যান চলাচলে কিছুটা ধীরগতি লক্ষ্য করা গেছে। দৌলতদিয়ার চারটি ঘাটের একটি বন্ধ হয়ে গেছে। অন্য তিনটি ঘাটের সবকটি পন্টুন পুরোপুরি সচল থাকছে না। ঘাট সমস্যা এবং ফেরি সঙ্কটের কারণে ফেরির ট্রিপের সংখ্যাও কমে গেছে। এ কারণে পাটুরিয়া ঘাট দিয়ে কখনও ১০ ঘণ্টা, কখনও ৬-৭ ঘণ্টা আটকে থেকে পার হচ্ছে ঘরমুখো মানুষ। লঞ্চঘাটেও উপচেপড়া ভিড়। ৩-৪ কিলোমিটার পথ হেঁটে বা রিক্সায় করে লঞ্চঘাটে পৌঁছাতে হচ্ছে যাত্রীদের। অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে চলাচল করছে লঞ্চগুলো। ঘাট এলাকার হোটেল ও রেস্টুরেন্টগুলোতে চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে নিম্নমানের খাদ্য। রিক্সাচালকরাও অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করছে বিপদগ্রস্ত যাত্রীদের কাছ থেকে। এখন পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলার কোন অবনতি ঘটেনি।
×