ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১

দাউদ হায়দার

শাহাবুদ্দীন ॥ শিল্পীর জন্মদিন

প্রকাশিত: ০৬:৪১, ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৬

শাহাবুদ্দীন ॥ শিল্পীর জন্মদিন

মুক্তিযোদ্ধা অনেকেই, তালিকাও কম দীর্ঘ নয়, কিন্তু কতজন মুক্তিযুদ্ধের মন্ত্রে উজ্জীবিত এখনও? কতজনই বা মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতার মূল বীজ আপাদমস্তক ধারণ করে মহীয়ান, বলীয়ান? সার্বক্ষণিক স্বাদেশিক? ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় হবে। মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, চেতনা, আদর্শ ইত্যাদি আজকাল মুখের বুলি। সুযোগ-সুবিধে মতো আউড়িয়ে দিব্যি আখের গুছিয়েছে অনেকে। তালে আছে আরও দাও মারার। বহু রাজাকার, আলবদর, শামস বাহিনীর খুনীরাও নাকি ফায়দা লুটছে মুক্তিযোদ্ধার নামে, সরকারী নথিপত্রেও নাম ঢুকিয়েছে। কার লেখায় পড়েছিলুম, মনে পড়ছে না লেখকের নাম, ব্যঙ্গ করেই লিখেছেন, হোক রাজাকার, আলবদর, ওরাও নিজেদের মুক্তির জন্য যুদ্ধ করেছেন, পাকিস্তানের হয়ে, পাক সেনার সহযোগী-যোদ্ধা হিসেবে। মনে পড়বে, স্মরণ শক্তি যদি পোক্ত থাকে, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে, অনেক রাজাকার গর্ব করে, দম্ভের সঙ্গে বলেছে, ‘আমরা রাজাকার ছিলাম। রাজাকার পরিচয়ে ধন্য, গর্বিত।’ মুনতাসীর মামুন বলেছেন, ‘রাজাকার সব সময়ই রাজাকার।’ এই উপলব্ধি নিশ্চিহ্ন করার দায় কোন সরকারই নেয়নি, বর্তমান সরকারও নয়। ‘গণতন্ত্রের দোহাই দিয়ে সিংহ, বাঘ, ভাল্লুক, গরু, মোষ, ছাগল, ভেড়া, হরিণ, হাঁস-মুরগি এক খোয়াড়ে রাখা সাংঘাতিক বিপজ্জনক, কেউটে দুধ খাবে এবং যথাসময়ে ছোবল মারবেই। এখনও সময় আছে খোয়াড়, গোয়াল ঝেড়ে মুছে সাফ করার। দয়ামায়ায় যে কী বিপদ, গত চল্লিশ বছরে দেশের রন্ধ্রে-রন্ধ্রে।’ Ñঠিক এই কথাই বলছিলেন শিল্পী শাহাবুদ্দীন (আহমেদ) প্যারিসে, ওঁর আস্তানায়। শাহাবুদ্দীনই বলতে পারেন নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকে, স্বাদেশিক প্রেম, দুঃখ কষ্ট বেদনা আনন্দ থেকে। শাহাবুদ্দীনের পরিচয় ঘাঁটাঘাঁটি বাতুলতা। দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধা, ভুবনখ্যাত চিত্রশিল্পী আমাদের জানা-অজানা, মুক্তিযুদ্ধের উৎস, বোধ, সকল সঙ্গ-অনুষঙ্গে উদ্বেলিত, জারিত। রক্ত শিরাÑ উপশিরায় ধারক। প্রতিপদে, প্রতিক্ষণে, স্বপ্নে-জাগরণেও আন্দোলিত, মহীয়ান। ‘জয় বাংলা’ তার আদর্শ, জীবন। এই জীবন থেকেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার মাটির সজল হাওয়ার বৈপ্লবিক প্রেরণা, ধারণ করেন জীবনাদর্শে। ছড়িয়ে দেন বিশ্বময় ছবির অঙ্কনে, রক্তে রেখায়। বলিষ্ঠ মানুষই ওর পাথেয়, চলার পথের নির্দেশক। মহাত্মা গান্ধী, রবীন্দ্রনাথ, মাদার তেরেসা, বঙ্গবন্ধু কেন জগৎময় নিত্যদিন, কেন পেশীবহুল সংগ্রামী মানুষ, কেন শ্রমজীবী মানুষের সমারোহ, কেন যন্ত্রণাক্লিষ্ট মুখ, হোক তা নারী-পুরুষ বা শিশুর, পরম আত্মিকতায় নিজেকে সগোত্র করেন মানবিকতায়, শৃন্বন্ত বিশ্বে প্রত্যেকে এক। ‘সব প্রাণীই গতিশীল, নিজস্ব গতিময়তা;’ বলছিলেন গত বছর এক দুপুরে, ছবি আঁকতে-আঁকতে, স্টুডিওয়, সিগ্রেট ধরিয়ে, পরনে লাল গেঞ্জি, বাটিক লুঙ্গি। ‘ধুর মিয়া তোমার কবিতায় গতি নাই ক্যান? বাংলাদেশের কবিতায় জীবন, গতি নাই, ম্যাদা মরা। সাহিত্যেও স্পিরিটি চাই, আমরা লড়াকু দেশ। বন্যায় লড়ি, মঙ্গায় লড়ি, ঝড়ঝঞ্ঝায় লড়ি, সব দুর্যোগে লড়ি। আমরা লড়াকু, আমরা জয়ী।’ -এই জয়ই শাহাবুদ্দীনের ছবিতে, ছবির বোধে, রক্ত রেখায়। দুই. আজ শাহাবুদ্দীনের জন্মদিন। সব শিল্পীর জন্মদিন হয় না। জন্ম হয় অবশ্যই, জন্মের তারিখও নির্ধারিত, কিন্তু ‘জন্মদিন’ নয়। জন্মদিন তারই, দেশকে, সমাজকে. দেশকে নানা মহিমায় উদ্বুদ্ধ, জাগরিত করেন। শাহাবুদ্দীন আমাদের সত্তায়। কেন? মুক্তিযোদ্ধার মন্ত্রদাতা সার্বক্ষণিক মুক্তিযোদ্ধা, সার্বক্ষণিক স্বাদেশিক, সার্বক্ষণিক প্রেরণাদাতা। মনপ্রাণ-মননে, বাংলার জলমাটিরসে স্বদেশী। জয় বাংলার উড্ডীন পতাকাধারী। শিল্পে ঘরোয়া আন্তর্জাতিক। তিন. স্মৃতি গোলমাল করছে, বয়স হয়েছে। হতে পারে ডিসেম্বরে প্রথম বা দ্বিতীয় সপ্তাহে। ১৯৭২ সাল। দিনক্ষণও মনে নেই। ঢাকার আর্ট কলেজে (চারুকলা কলেজ কেউ বলে না তখনও) সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। শাহাবুদ্দীন ঢুকলেন, সঙ্গে জিয়াউর রহমান। চোখে সানগ্লাস নেই। সাদাসিধে পোশাক পরনে। শাহাবুদ্দীন পরিচয় করিয়ে দিলেন, ‘জিয়াউর রহমান, জেড ফোর্সের কমান্ডার। বঙ্গবন্ধুর হয়ে, চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা হান্নানের বয়ান পড়ছিলেন স্বাধীন বাংলা বেতারে, অন বিহাফ অব আওয়ার গ্রেট লিডার শেখ মুজিবুর রহমান...।’ জিয়াউর রহমান উচ্ছ্বসিত হয়ে, সিট থেকে উঠে, উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বললেন, ‘ইয়েস, ইয়েস আই সেইড।’ আই এ্যাম প্রাউড। পাশে বসিয়ে শাহাবুুদ্দীন ইজ এ্যা গ্রেট ফ্রিডম ফাইটার। ইজ হি ইজ ইয়োর ফ্রেন্ড? ইউ মাস্ট বি প্রাউড।’ ওই অনুষ্ঠানে গিয়ে জিয়াউর রহমান কতটা ধন্য, শাহাবুদ্দীনের দায় বেড়ে যায়। নানাজনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। চার . জাহিদ হায়দারের পয়লা ছেলে বর্ষ (ডাকনাম), ভাল নাম রাহিন হায়দার, দিনদশেক শাহাবুদ্দীনের গৃহে, সস্নেহে। আবিষ্কার করে, ‘শাহাবুদ্দীন চাচার মূল শক্তি আনাআন্টি (চাচি, আনা ইসলাম)। তিনিই সবকিছুর তত্ত্বাবধায়ক। ঘর-সংসার থেকে শুরু করে ছবি বেচাকেনা, হিসাব-নিকাশ, এমনকি ট্যাক্স দেখভালে।’ শাহাবুদ্দীনের দৈনিক কার্যক্রমও হিসাব রাখে বর্ষ। ‘অবাক হয়ে দেখি, ঠিক অফিসিয়াল, সকাল ১০টায় স্টুডিওয় ঢোকেন, দেড়টায় বিরতি. আধঘণ্টা, দুটো থেকে আবার কাজ, ঠিক পাঁচটা পর্যন্ত।’ বর্ষর মন্তব্য, ‘শিল্পী কাকে বলে, কাজের প্রতি নিষ্ঠাবান, সময় বেঁধে, সময়কে শিল্পিত করে, একেবারে ঘরোয়া, আত্মিক, আমি বিস্মিত।’ শাহাবুদ্দীনের আরো দুটি জগৎ আছে। পরিবার এবং খেলা। সপ্তাহে দুদিন টেবিল টেনিস খেলা চাই-ই। ঝড় বাদল যাই হোক, বাদ নেই খেলায়। বলেন, ব্যায়াম হয়, এনার্জিও পাই যথেষ্ট। ওই এনার্জি কাজে লাগাই (ছবি আঁকায়) পুরোপুরি। সংসারের সাত-পাঁচ নিয়ে মাথা ঘামান না ঠিকই, কিন্তু ভাল খাবার চাই সব সময়। নানা পদ থাকতে হবে। নিজের ইচ্ছেমতোন রান্নাও করেন, তেলের পরিমাণ কম, ঝাল বেশি। রান্নাও করেন গুছিয়ে, সময় নিয়ে। চমৎকার রান্না। সুস্বাদু। দুই কন্যা, চিত্র ও চর্যা। বিলাভেড স্ত্রী আনাকে (আনা ইসলাম লেখিকা) ঘরোয়া আড্ডা। দেখে মনে হয় পরস্পর বন্ধু। চিত্র, চর্যার সঙ্গে কথা কাটাকাটি, মতভেদ, রঙ্গরসিকতা, নানা বিষয়ে আলোচনা। রাজনীতি থেকে ফুটবলও। আনা খুব সাজানো গোছানো। সবকিছু পরিপাটি। যেমন লেখায়, পড়ায়, বাজার সওদায়, আনাজপাতি কাটাকুটিতেও। সাজগোজ একটু কম করেন এই যা। সাজপোশাক নিয়ে শাহাবুদ্দীনের মাথাব্যথা নেই আদৌ। শার্ট প্যান্ট ইস্ত্রি করা কিনা করা, ভাঁজ না নিভাঁজ, তোয়াক্কা নেই। বলেন, ‘এসব কেউ দ্যাখে না, শরীরে জামা-কাপড় আছে কি-না, আসল কথা।’ লাল রং ভীষণই পছন্দ শাহাবুদ্দীনের। লাল প্যান্ট, লাল শার্ট, লাল গেঞ্জি, লাল টি শার্ট পরনে। অবশ্য একসঙ্গে নয়, কম্বিশনে একটু তফাত। লালের প্রতি দুর্মম মোহ, আশ্চর্য এই, ছবিতে বালাই নেই খুব। বলেন, জীবনভর শুধু রক্তই দেখি, রক্তাক্ত বিশ্ব, যুদ্ধ-হত্যা, রক্তময় সময়কাল, ছবিকে কেন রক্তারক্তি করব। প্রয়োজন মতো লালরং ব্যবহার করতে পারি হয়ত। শাহাবুদ্দীনের বোধে মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধু এবং আজকের অসহায়, উদ্বেলিত পৃথিবী, মানুষ সর্বদা সচল। এই সচলতায় তার শিল্প, শিল্পের গতি, নিরলস কর্মী। শিল্পী শাহাবুদ্দীনের জন্মদিনে শুভেচ্ছা, বিনম্র প্রণতি। ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৬ বার্লিন, জার্মানি
×