ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

পাকিস্তান সম্মেলনের প্রস্তুতি নিলেও ভারতের ওপরই নির্ভর করছে বাস্তবায়ন ;###;স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে নিসার-রাজনাথ বাগ্বিত-া তিক্ততায় পর্যবসিত

সার্ক শীর্ষ অনিশ্চিত

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ২ সেপ্টেম্বর ২০১৬

সার্ক শীর্ষ অনিশ্চিত

তৌহিদুর রহমান ॥ নয়াদিল্লী-ইসলামাবাদের টানাপোড়েনে পাকিস্তানে অনুষ্ঠিতব্য দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা-সার্ক শীর্ষ সম্মেলন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। আগামী ৯-১০ নবেম্বরে ইসলামাবাদে ১৯তম সার্ক শীর্ষ সম্মেলন হওয়ার কথা থাকলেও তা শেষ পর্যন্ত হবে কি-না অনেকটা দিল্লীর উপরে নির্ভর করছে। তবে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, দেশটির পক্ষ থেকে সার্ক শীর্ষ সম্মেলনের প্রস্তুতি চলছে। সূত্র জানায়, কাশ্মীর ও বেলুচিস্তান ইস্যু ঘিরে দিল্লী-ইসলামাবাদের সম্পর্কে চরম টানাপোড়েন চলছে। বিশেষ করে কাশ্মীর উপত্যকায় সংঘর্ষের ঘটনায় ভারতবিরোধী প্রচার চালানোর কৌশল নিয়েছে পাকিস্তান। আর পাল্টা হিসেবে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বেলুচিস্তান নিয়ে মন্তব্যের জেরে দুই দেশের মধ্যে এই টানাপোড়েন চলছে। সেই সঙ্গে যোগ হয়েছে ইসলামাবাদে সার্ক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকে ভারত-পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর তিক্ততা। এছাড়া সার্ক অর্থমন্ত্রীদের বৈঠকেও যোগ দেননি ভারতের অর্থমন্ত্রী অরুন জেটলি। সার্ক শীর্ষ সম্মেলনের আগেই কাশ্মীর ইস্যুতে উত্তপ্ত এখন উভয় দেশ। কাশ্মীর ইস্যু নিয়ে ইতোমধ্যেই ভারতের সঙ্গে আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছে পাকিস্তান। তবে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিব আইজাজ আহমেদ চৌধুরীর এই প্রস্তাবের কড়া জবাব দিয়েছেন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব ড. এস জয়শঙ্কর। তিনি বলেছেন, এটি একান্তই ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এ বিষয়ে পাকিস্তানের নাক গলানোর কোন অধিকার নেই । সার্ক শীর্ষ সম্মেলনের আগে প্রস্তুতি হিসেবে সার্ক দেশগুলোর বিভিন্ন মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। আগস্টের প্রথম সপ্তাহে সার্ক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীদের বৈঠক হয়। সেই বৈঠকে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংও যোগ দিয়েছিলেন। তবে বৈঠকে পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চৌধুরী নিসার আলী খানের সঙ্গে রাজনাথ সিংয়ের বাগ্বিত-া তিক্ততায় পর্যবসিত হয়। পাকিস্তানে আয়োজিত এই বৈঠকে ভারত সরকারের নাম না নিয়ে চৌধুরী নিসার আলী ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে আন্দোলন দমনে অত্যধিক শক্তি প্রয়োগের নিন্দা জানান। চৌধুরী নিসার বলেন, নির্দোষ শিশুদের বিরুদ্ধে নির্যাতনকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। বেসমারিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে সহিংসতাকে সন্ত্রাসবাদ হিসেবে উল্লেখ করেন তিনি। উগ্রবাদী মনোভাব ত্যাগ করে সংলাপের মাধ্যমে আঞ্চলিক সমস্যা সমাধানের কথা বলেন পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তবে তার এই বক্তব্যের পাল্টা প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং। তিনি বলেন, কেবলমাত্র সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে নয়, যেসব রাষ্ট্র সন্ত্রাসবাদে মদদ দেয় তাদের বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। রাজনাথ সিং আরও বলেন, সন্ত্রাসীদের কোন দেশ নেই। সন্ত্রাসবাদের কোন ভাল বা মন্দ নেই। সন্ত্রাসবাদ তো সন্ত্রাসবাদই। সন্ত্রাসীদের কোন মতেই শহীদ বলে গুণগান গাওয়া উচিত নয়। উল্লেখ্য, ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে দেশটির নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে নিহত হিজবুল মুজাহিদীন নেতা বুরহান ওয়ানিকে পাকিস্তানের দেয়া খেতাব প্রসঙ্গে এই মন্তব্য করেন রাজনাথ। বৈঠক শেষে পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর দেয়া মধ্যাহ্ন ভোজেও যোগ দেননি রাজনাথ সিং। ভারতের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যেই অভিযোগ করা হয়েছে, সার্ক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীদের বৈঠকে সন্ত্রাসবাদ নিয়ে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহের দেয়া বক্তব্যও প্রচার করেনি পাকিস্তানী গণমাধ্যম। সার্কের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীদের বৈঠক সম্প্রচারে একমাত্র অনুমতিপ্রাপ্ত মিডিয়া ছিল পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন পিটিভি। তবে পিটিভি রাজনাথের ওই বক্তব্য প্রচার করেনি। এছাড়া ভারতীয় গণমাধ্যম দলকে রাজনাথের ভাষণ ধারণ ও সম্প্রচার করতে পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষের বাধা দেয়ার অভিযোগও করা হয়েছে। ভারতের গণমাধ্যম এবং পাকিস্তানের বেসরকারী চ্যানেলগুলোকেও বৈঠক কক্ষে ঢুকতে দেয়া হয়নি। সার্ক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীদের বৈঠকের পর গত ২৫-২৬ আগস্ট ইসলামাবাদে সার্ক অর্থমন্ত্রীদের বৈঠক হয়। তবে সার্ক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে তিক্ততার জের ধরে অর্থমন্ত্রীদের বৈঠকে যোগ দেননি ভারতের অর্থমন্ত্রী অরুন জেটলি। তবে ভারতের অর্থমন্ত্রী ওই বৈঠকে যোগ না দিলেও দেশটির পক্ষ থেকে অর্থ সচিব শক্তিকান্ত দাশ যোগ দেন। সূত্র জানায়, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে যোগ না দেয়ার বিষয়ে ইতোমধ্যেই আভাস মিলেছে। কেননা ভারতের অর্থমন্ত্রী অরুন জেটলি ইসলামাবাদে সার্ক অর্থমন্ত্রীদের বৈঠকে যোগ দেননি। অরুন জেটলিকে ইসলামাবাদে না পাঠিয়ে ভারত ইতোমধ্যেই সে বার্তা দিয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এদিকে ব্যস্ততার কারণে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতও ইসলামাবাদে সার্ক অর্থমন্ত্রীদের বৈঠকে যোগ দেননি। তবে অর্থ প্রতিমন্ত্রী আবদুল মান্নান এই বৈঠকে যোগ দেন। সেখানে সার্ক ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক ফোরামে বাংলাদেশ তার ঐকান্তিক সহযোগিতা ও সমন্বিত প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবে বলে জানিয়েছেন অর্থ প্রতিমন্ত্রী। সার্কের কাঠামো অনুযায়ী সদস্য দেশগুলোর যে কোন একটি দেশের একজন রাষ্ট্রপ্রধান উপস্থিত না হলেই সার্ক শীর্ষ সম্মেলন বাতিল হয়ে যায়। এর আগে কার্গিল যুদ্ধ এবং পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ অরাজকতার জেরে ১৯৯৯ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত স্থগিত ছিল সার্ক শীর্ষ সম্মেলন। ২০০৪ সালের পর এই প্রথম পাকিস্তান সার্ক শীর্ষসম্মেলনের আয়োজন করছে। এদিকে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ইসলামাবাদে সার্ক শীর্ষ সম্মেলন আয়োজনের জন্য তারা প্রস্তুতি চালিয়ে যাচ্ছে। সার্ক শীর্ষ সম্মেলনের প্রস্তুতি হিসেবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা কয়েক দফা বৈঠকও করেছেন। গত মঙ্গলবার পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, সার্ক শীর্ষ সম্মেলন আয়োজনের জন্য পাকিস্তানের পক্ষ থেকে প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। দেশটি আশা প্রকাশ করছে, সার্ক শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতা আরও জোরদার হবে। ইসলামাবাদে আয়োজিত সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেয়ার বিষয়ে আগ্রহী ঢাকা। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জনকণ্ঠ’কে জানান, ১৯তম সার্ক শীর্ষ সম্মেলনের এখনও দু’মাস বাকি। এই সময়ের মধ্যে দিল্লী-ইসলামাবাদের মধ্যে টানাপোড়েনের অবসানও হতে পারে। তাই এই সম্মেলন নিয়ে অনিশ্চয়তা থাকলেও শেষ কথা এখনই বলা সম্ভব হচ্ছে না। ইসলমাবাদে আয়োজিত সার্ক শীর্ষ সম্মেলনের বিষয়ে নেপালের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী রমেশনাথ পা-ে বলেছেন, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্কে অগ্রগতি না-হওয়া পর্যন্ত আঞ্চলিক সহযোগিতা তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। এর ফলে এই অঞ্চলের ছোট দেশগুলো পড়ে পড়ে মার খাবে। নিজেদের স্বার্থেই ছোট দেশগুলোর উচিত ভারত ও পাকিস্তানকে এক জায়গায় আনার চেষ্টা করা। ২০১৪ সালের নবেম্বরে নেপালে ১৮তম সার্ক শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। চলতি বছর ১৭-১৮ মার্চ নেপালের পোখারায় অনুষ্ঠিত সার্ক দেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকে ১৯তম সার্ক শীর্ষ সম্মেলনের তারিখ চূড়ান্ত হয়। সে অনুযায়ী আগামী ৯-১০ নবেম্বর পাকিস্তানে সার্ক শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। পাকিস্তানের পরে ২০তম সার্ক শীর্ষ সম্মেলন হবে শ্রীলঙ্কায়। উল্লেখ্য, দক্ষিণ এশিয়ার সাত দেশ বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ ও পাকিস্তানের মধ্যে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সহযোগিতার ফোরাম সার্ক ১৯৮৫ সালে যাত্রা শুরু করে। পরে আফগানিস্তান এই সংস্থার সদস্যপদ পায়। দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়ন এবং অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ও সহযোগিতার লক্ষ্যে সার্ক গঠন করা হয়। তারপর থেকেই সার্ক এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক, প্রযুক্তিগত, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং উন্নয়নে কাজ করে চলেছে। বর্তমানে সার্কের আটটি সদস্য দেশ ছাড়াও নয়টি পর্যবেক্ষক দেশ রয়েছে। এসব দেশের মধ্যে জাপান, অস্ট্রেলিয়া, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইরান, মরিশাস ইত্যাদি। সার্কের পর্যবেক্ষক দেশগুলোও অব্যাহত সহযোগিতা দিয়ে আসছে।
×