ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

শূন্যতাকেও আনন্দময় আর অর্থবহ করে তোলা যায়...

প্রকাশিত: ০৬:৫৬, ৩০ আগস্ট ২০১৬

শূন্যতাকেও আনন্দময় আর অর্থবহ করে তোলা যায়...

সামাজিক যোগাযোগের অন্যতম জনপ্রিয় মাধ্যম ফেসবুক। ২০১২ সালে তিনি প্রথম এবং একমাত্র নারী হিসেবে ফেসবুকের পরিচালনা পরিষদে যোগদান করেন। বন্ধুরা বুঝতে পারছেন আমি কার কথা বলছি, আমি বলছি ফেসবুকের পরিচালনা পরিষদের প্রথম নারী সদস্যের ‘শেরিল স্যান্ডবার্গ’ এর কথা যিনি প্রযুক্তি দুনিয়ার প্রভাবশালী নারীদের মধ্যে অন্যতম। ২০১২ সালে তিনি টাইমস ম্যাগাজিনের মতে বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী ১০০ জনের মধ্যে তালিকাভুক্ত হন। ফোর্বস ম্যাগাজিনের তথ্যানুসারে তার সম্পত্তির পরিমাণ ১ বিলিয়ন আমেরিকান ডলারেরও বেশি। ফেসবুক ছাড়াও তিনি দ্য ওয়াল্ট ডিজনি কোম্পানি, উইমেন ফর উইমেন ইন্টারন্যাশনাল, সেন্টার ফর গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট এবং ভি-ডে-এর পরিচালনা পরিষদের সদস্য। ১৯৬৯ সালের ২৮ আগস্ট শেরিল ক্যারা স্যান্ডবার্গ যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে এক ইহুদী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। শেরিলের বাবা জোয়েল স্যান্ডবার্গ ছিলেন একজন চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ এবং মা এ্যাডলি স্যান্ডবার্গ ছিলেন ফরাসী এবং ইংরেজী ভাষার শিক্ষিকা। শেরিলের দুই বছর বয়সের সময় তাদের পরিবার ওয়াশিংটন ডিসি থেকে ফ্লোরিডার নর্থ মায়ামি বিচে চলে আসে। তিনি বরাবরই মেধাবী ছাত্রী ছিলেন। স্কুলে সবসময় প্রথম স্থানটি ছিল শেরিলের দখলে। পড়াশোনার পাশাপাশি তিনি অন্যান্য সহশিক্ষা কার্যক্রমের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। গত ১৪ মে ২০১৬ ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, বার্কলের সমাবর্তনে বক্তব্য দিয়েছেন তিনি। তিনি তার সমাবর্তন বক্তব্যে বলেন... সমাবর্তন অনুষ্ঠানে সাধারণত তরুণ আর প্রবীণের একটা চমৎকার সমন্বয় থাকতে হয়। তারুণ্যের প্রতিনিধিত্ব করতে তোমরা তো আছই। প্রবীণের ভূমিকাটা আমার পালন করার কথা। আমি তোমাদের বলব জীবন থেকে আমি কী শিখেছি, তোমরা বাতাসে সমাবর্তনের টুপি ওড়াবে, পরিবারের সঙ্গে হাজারো ছবি তুলবে, ছবিগুলো ইনস্টাগ্রামে আপলোড করবে, হাসিমুখে বাড়ি ফিরে যাবে- তাই তো? আজকে না হয় একটু ব্যতিক্রম হোক। হ্যাঁ, টুপি ওড়ানো কিংবা ছবি তোলার ব্যাপারটা একই রকম থাকবে। কিন্তু জীবন থেকে আমি কী শিখেছি, সেটা আজ তোমাদের বলব না। বরং বলব, মৃত্যু আমাকে কী শিখিয়েছে। কখনও জনসমক্ষে এই বিষয়টা নিয়ে কথা বলিনি। ব্যাপারটা কঠিন। বলার সময় আমি সাধ্যমতো চেষ্টা করব যেন বার্কলের এই সুন্দর সমাবর্তন গাউনে আমাকে চোখ মুছতে না হয়। ঠিক ১ বছর ১৩ দিন আগে আমি আমার স্বামীকে হারিয়েছি। ডেভ। ওর মৃত্যুটা ছিল আচমকা, অপ্রত্যাশিত। আমরা মেক্সিকোতে এক বন্ধুর ৫০তম জন্মদিন উদযাপন করতে গিয়েছিলাম। ডেভ যখন জিমে ব্যায়াম করতে গেল, আমি তখন একটু চোখ বুজে বিশ্রাম নিচ্ছিলাম। এর কিছুক্ষণ পর আমাকে ডেভের নিথর দেহটা জিমের মেঝেতে আবিষ্কার করতে হলো। বাড়ি ফিরে ছেলেমেয়েদের বলতে হলো, তোমাদের বাবা আর নেই। এরপর কয়েক মাস আমি গভীর বিষাদে ডুবে ছিলাম। আরও স্পষ্ট করে বললে, একটা শূন্যতা আমাকে ঘিরে ধরেছিল। সে শূন্যতা এতই প্রকট যে আমার কোন কিছু ভাবতে, এমনকি নিশ্বাস নিতেও কষ্ট হতো। ডেভের মৃত্যু খুব স্পষ্টভাবেই আমাকে বদলে দিল। আমি দুঃখের গভীরতা আর হারানোর ব্যথা বুঝলাম। একই সঙ্গে আমি এও বুঝলাম, জীবন যখন তোমাকে নিচের দিকে টানতে থাকে, সে অবস্থায়ও সব ভেঙেচুরে উঠে আসা যায়, বুক ভরে নিশ্বাস নেয়া যায়। আমি শিখলাম, শূন্যতাকেও আনন্দময় আর অর্থবহ করে তোলা যায়। এই আশায় তোমাদের এসব কথা বলছি, যেন এই শিক্ষাটা তোমরা আজই পাও। যেটা আমি মৃত্যু থেকে পেয়েছিলাম। আমাদের ভেতর স্বপ্ন, শক্তি আর আলো নিবু নিবু করেও কখনও নিভে যায় না। ছোট ছোট না পাওয়া তোমাদের কাতর করে। তুমি হয়ত ‘এ’ আশা করেছিলে, কিন্তু ‘এ-’ পেয়েছ। তুমি ফেসবুকে ইন্টার্নশিপের জন্য আবেদন করেছ, কিন্তু পেয়েছ গুগলে। তুমি কারও প্রেমে পড়েছ, কিন্তু সে তোমাকে ছেড়ে গেছে। নিশ্চিত থাকো, এর চেয়েও দুঃখের মুহূর্ত তোমার সামনে আসবে। পছন্দসই একটা চাকরি হয়ত তুমি পাবে না। একটা দুর্ঘটনা কিংবা অসুস্থতা হয়ত মুহূর্তে তোমার জীবন বদলে দেবে। একটা ভাঙা সম্পর্ক, হয়তো আর কখনও জোড়া লাগবে না। সহজ দিনগুলো সহজেই পেরিয়ে যাবে। আমি বলছি কঠিন সময়গুলোর কথা। যে সময় তোমার দিকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেবে। কঠিন সময়ই নির্ধারণ করবে, তুমি কে? শুধু তোমার অর্জনই তোমার পরিচয় নয়। বরং তুমি কিভাবে টিকে আছ, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। আমার মনোবিদ বন্ধু এ্যাডাম গ্র্যান্ট একবার বলছিল, এর চেয়েও খারাপ কী হতে পারত, সেটা ভেবে আমার সান্ত¡না পাওয়া উচিত। আমি বলেছিলাম, ‘কী বলছ! আমার স্বামী হঠাৎ ‘কার্ডিয়াক এ্যারিথমিয়া’য় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। এর চেয়ে খারাপ আর কী হতে পারে?’ সে বলল, ‘ধরো এমনও তো হতে পারত, তোমার স্বামীর যখন কার্ডিয়াক এ্যারিথমিয়া হলো, তখন সে গাড়ি চালাচ্ছিল। আর পেছনের সিটে বসে ছিল তোমার ছেলেমেয়েরা!’ ওর কথা শোনামাত্র আমার ভেতরটা কৃতজ্ঞতায় ভরে গেল। তাই তো, জীবন অন্তত আমার কাছ থেকে আমার ছেলেমেয়েদের কেড়ে নেয়নি! কৃতজ্ঞতাবোধ হলো স্থিরতার চাবি। জীবনের আশীর্বাদগুলোর মূল্যায়ন করলেই এমন আশীর্বাদ তুমি আরও পাবে। এ বছরের শুরুতে আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, প্রতি রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে দিনের সেরা তিনটা মুহূর্ত লিখে রাখব। এই ছোট্ট একটা অভ্যাস আমার জীবন বদলে দিয়েছে। কারণ প্রতিদিন যা-ই ঘটুক না কেন, আমি আনন্দময় কিছু ভাবতে ভাবতে ঘুমাতে যাই। অন্তত চেষ্টা করি। আজ থেকেই তুমিও শুরু করতে পার।
×