ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০২ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১

ফারজানা সুমনা

কেমব্রিজের কথকথা

প্রকাশিত: ০৬:৫৬, ২৬ আগস্ট ২০১৬

কেমব্রিজের কথকথা

জুন মাসের প্রথম রবিবার সাপ্তাহিক ছুটির দিনে বাসায় বসে থাকতে একদম ইচ্ছে হচ্ছিল না । ক্যালেন্ডারের পাতায় ব্রিটিশ গ্রীষ্মের কথা বলা হলেও সূর্যের দেখা নেই বললেই চলে, সারাদিন মুখ গোমড়া করা আকাশ আর কিছুক্ষণের বিরতিতে ঝমঝম বৃষ্টি। কিছুতেই কেন যে মন লাগে না; তাই লন্ডন থেকে কাছে কোথাও দিনে দিনে ঘুরে আসার কথা ভাবতেই মাথায় আসল ক্যামব্রিজের নাম। আবহাওয়ার পূর্বাভাস ছিল, ক্যামব্রিজের আকাশ মেঘলা হলেও বৃষ্টির আশঙ্কা কম । যেই ভাবা সেই কাজ, এক বন্ধুকে ফোন করে পরিকল্পনার কথা জানাতে সে আরও দুজনকে মুহূর্তের মধ্যেই যোগাড় করে ফেলল। সকাল ৯টার দিকে আমরা চারজন একটা ছোট্ট নীল রঙের গাড়িতে চড়ে বৃষ্টিমুখর লন্ডন ছাড়লাম, গন্তব্য ক্যামব্রিজ। লন্ডন থেকে ড্রাইভ করে ক্যামব্রিজ পৌঁছলাম প্রায় এগারোটা নাগাদ। ক্যামব্রিজ শহরের মূল আকর্ষণ ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়। পৃথিবীর প্রাচীনতম যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখনও টিকে আছে তাদের মধ্যে ক্যামব্রিজ তৃতীয়। কথিত আছে, আইনী ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ার কারণে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির কিছু স্কলার বা পি তবর্গ মিলে ১২০৯ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠা করেন এই বিশ্ববিদ্যালয়। ক্যাম নদীর পাড় ঘেঁষে গড়ে ওঠা ক্যামব্রিজ শহরজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ ৩১টি কলেজ। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হতে হলে এই স্বনামধন্য ৩১ কলেজের যে কোন একটিতে ভর্তি নিশ্চিত করতে হয়। লুসি ক্যাভেনডিস, নিউহ্যাম আর মারে এডওয়ার্ডস নামের তিনটি কলেজে শুধু মেয়েদের পড়ানো হয়, বাকি ২৮টি কলেজে পূর্বে শুধু ছেলেদের জন্য নির্দিষ্ট হলেও এখন ছেলে মেয়ে সবাই পড়তে পারে। শিক্ষার্থীদের প্রয়োজন মেটাতে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ১০০টি লাইব্রেরি আছে যেখানে বইয়ের সংখ্যা ৮০ লাখের ওপরে! প্রতিবছর যুক্তরাজ্য এবং ইউরোপে প্রকাশিত সব বইয়ের ন্যূনতম এক কপি ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে স্থান পায়। বলার অপেক্ষা রাখে না, নিউটন, চার্লস ডারউইন থেকে শুরু করে স্টিফেন হকিংসহ পৃথিবীর বিখ্যাত ব্যক্তিদের অনেকেই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। ফিজিক্সে সর্বোচ্চ ২৯টি নোবেল প্রাইজসহ নোবেল প্রাইজের ছয়টি শাখাতেই মোট ৮৯টি পুরস্কার জিতে নিয়েছে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এজন্যই বলা হয় ক্যামব্রিজ নোবেল লরিয়েট প্রসব করে আর অক্সফোর্ড প্রধানমন্ত্রী। ক্যামব্রিজ ভ্রমণে বিশ্ববিদ্যালয় ভবন ছাড়াও আমাদের আগ্রহের বিষয় ছিল কর্পাস ক্রিস্টি ঘড়ি আর গাণিতিক সেতু। কর্পাস ক্রিস্টি কলেজের টেইলর লাইব্রেরির সামনে প্রতিষ্ঠিত বিখ্যাত কর্পাস ক্রিস্টি ঘড়িটি ২০০৮ সালে সর্ব সাধারণের জন্য উন্মোচন করেন বিখ্যাত পদার্থ বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং। ঘড়িটির বিশেষত্ব হলো সময় নির্দেশের জন্য এর কোন ঘণ্টা, মিনিট বা সেকেন্ডের কাঁটা। ঘড়ির গায়ের নির্দিষ্ট চেরা অংশে নীল লেডের আলো জ্বেলে সময় বলে দেয় এই ঘড়ি। ঘড়ির ওপরের বড়সড় একটা ফড়িংয়ের আকৃতি স্থাপিত আছে যাকে ক্রোনোফেজ বা সময়-খাদক বলে নামকরণ করা হয়েছে। এই ঘাসফড়িং এমনভাবে মুখ নাড়ায় দেখে যেন মনে হয় গত হওয়া সেকেন্ডগুলোকে সে গিলে ফেলছে। ঘড়ির সামনের রাস্তায় খোদাই করে লিখা রয়েছে বাইবেলের বাণী- ‘জগৎ-সংসার বিলুপ্ত হয়, তার সঙ্গে লোপ পায় ভোগ-বাসনা। কর্পাস ক্রিস্টি ঘড়ি দেখা শেষে করতেই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামল ক্যামব্রিজের আকাশ কালো করে। কোনমতে ছাতা মাথায় ছুটলাম পরবর্তী আকর্ষণ গাণিতিক সেতু দেখতে। ক্যাম নদীর ওপর কাঠের তৈরি গাণিতিক সেতুর মূল নাম কাঠের সেতু। এই সেতু ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের কুইন্স কলেজের দুই প্রান্তকে জুড়ে দিয়েছে। এই কাঠের সেতুটির চমকপ্রদ দিক হলো, যদিও সেতুটি দেখতে বক্রাকার বা সোজা কথায় ধনুকের মতো বাঁকা, কিন্তু এই সেতু তৈরিতে কোন বাঁকা কাঠ ব্যবহার করা হয়নি। যদিও গুজব আছে এই সেতুটি আইজ্যাক নিউটন তৈরি করেছিলেন, তবে তা নিতান্তই গুজব মাত্র। নিউটনের মৃত্যুর প্রায় ২২ বছর পর এই সেতুটি নির্মাণ করা হয় ক্যামব্রিজে। ক্যামব্রিজ লন্ডন থেকে ঘণ্টাখানেকের দূরত্বে হলেও শহুরে হাওয়া একেবারেই লাগেনি। অসংখ্য চার্চ, ঘন সবুজ পার্ক আর সাইকেল আরোহীদের পদচারণায় মুখর শান্ত এই মফস্বল শহরটি। গল্প করতে করতে পায়ে হেঁটে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি গায়ে মেখে চলে এলাম জেজাস কলেজে; ক্যামব্রিজে আমাদের শেষ গন্তব্য। কেলেজের ভেতরে ঢুকতেই পিয়ানোর শব্দ কানে আসল। কলেজের ভেতরের এক চ্যাপেলের দরজা একটুখানি ফাঁকা করে দেখলাম এক মাথা ঝাঁকড়া চুল নিয়ে মাথা নুইয়ে এক ছাত্র একাগ্র মনে পিয়ানো বাজিয়ে চলেছে। অসাধারণ মিষ্টি তার সুর। রবিবার বিকেলের প্রার্থনার তখনও ঘণ্টাখানেক বাকি। পাশে দাঁড়ানো শ্বেতাঙ্গ বন্ধুটির অবাক দৃষ্টি উপেক্ষা করে মুগ্ধ আর বিলেতি সুরে তন্দ্রাচ্ছন্ন। [email protected]
×