ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

দু’একদিনের মধ্যেই টাঙ্গানো হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর ছবি

অবশেষে বুয়েটে জাতির জনককে অবজ্ঞার দিন শেষ

প্রকাশিত: ০৫:৫৩, ২৬ আগস্ট ২০১৬

অবশেষে বুয়েটে জাতির জনককে অবজ্ঞার দিন শেষ

বিভাষ বাড়ৈ ॥ প্রতিক্রিয়াশীল শিক্ষকদের বাধা কাটিয়ে অবশেষে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মর্যাদা প্রদানের উদ্যোগ নিচ্ছে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)। বঙ্গবন্ধু পরিষদের নেতৃবৃন্দসহ প্রগতিশীল শক্তির দাবি মেনে নতুন উপাচার্যের উদ্যোগে প্রথমবারের মতো ভিসি অফিস ছাড়াও ডিন, বিভাগীয় প্রধান, হল প্রভোস্টদের অফিসে জাতির পিতার ছবি টাঙানো হচ্ছে। তবে বহুদিনের দাবি এমনকি সরকারের আদেশ থাকার পরও এখনই নির্মাণ হচ্ছে না মুক্তিযুদ্ধের কোন ভাস্কর্য। প্রগতিশীল শিক্ষক, কর্মকর্তা ও শিক্ষার্থীরা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলছেন, বছরের পর পর কর্তৃপক্ষের জামায়াত-শিবির তোষণের ফলেই বুয়েটে মহান মুক্তিযুদ্ধ ও জাতির জনক আজও উপেক্ষিত। জানা গেছে, বাংলাদেশের সংবিধানের ৪(ক) ধারা অনুযায়ী সকল স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের প্রধান ও শাখা কার্যালয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি প্রদর্শনের কথা বলা থাকলেও বুয়েটে সংবিধানের এ ধারা সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষিত। একে ধৃষ্টতা বলে বহুবার প্রগতিশীল শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা ক্ষোভ প্রকাশ করলেও বুয়েটের ভিসি অফিস ছাড়া ডিন, বিভাগীয় প্রধান বা হল প্রভোস্টদের অফিসে জাতির পিতার ছবি দেখা যায় না। বুয়েট প্রশাসন কখনই জাতির জনক ও মহান মুক্তিযুদ্ধকে মর্যাদা প্রদানের বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়নি। বরং গত কয়েক বছর এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) ক্ষোভ প্রকাশ করে নানা নির্দেশনা দিলেও তাতে কোন পাত্তাই দেয়নি প্রশাসন। শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা বলছেন, বুয়েটে জামায়াত-শিবির ও বিএনপিপন্থী শিক্ষক-কর্মকর্তাদের একচ্ছত্র দাপটের কারণে কর্তৃপক্ষ জাতির জনক ও মহান মুক্তিযুদ্ধকে মর্যাদা প্রদানের বিষয়টিকে সামনে আনতে চান না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে উপাচার্যসহ শীর্ষপদের কর্মকর্তারা সরাসরি প্রতিক্রিয়াশীলদের পক্ষেই কাজ করেন। যদি কেউ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কোন উদ্যোগ নিতেও চান তবে তাতে শিক্ষক সমিতির সমর্থন মেলে না। তবে নতুন উপাচার্য অধ্যাপক ড. সাইফুল ইসলাম বৃহস্পতিবার জনকণ্ঠকে জানান, বাংলাদেশের সংবিধানের ৪(ক) ধারা অনুযায়ী উপাচার্য অফিস ছাড়াও ডিন, বিভাগীয় প্রধান, হল প্রভোস্টদের অফিসে জাতির পিতার ছবি টাঙানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আগামী দু-একদিনের মধ্যেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি টাঙানো হবে উল্লেখ করে উপাচার্য বলেন, এত বছর হয়নি, এখন থেকে হবে। ইতোমধ্যেই ছবি সংগ্রহ করা হয়েছে। বহুদিনের দাবি ও সরকারের আদেশ থাকার পরও বুয়েটের মতো প্রতিষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধের কোন ভাস্কর্য নেই। এ বিষয়ে কোন উদ্যোগ নিয়েছেন কিনা- এমন প্রশ্নে উপাচার্য বলেন, আমি দায়িত্ব গ্রহণ করেছি মাত্র কয়েকদিন হলো। বেশ কয়েকদিন নিয়মিত উপাচার্য ছিলেন না। তাই অনেক ফাইল জমে আছে। তাছাড়া অবকাঠামো উন্নয়ন কাজও চলছে। ১৫ আগস্ট উপলক্ষে দুটি অনুষ্ঠান করলাম। আরও একটি অনুষ্ঠান বাকি আছে। কাজগুলো একটু গুছিয়ে এনে অবশ্যই সরকারের আদেশ অনুসারে মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হবে। তবে কি কেবল সরকারের আদেশ মেনেই মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য? প্রতিষ্ঠানগুলো তো চেতনা থেকেই মুক্তিযুদ্ধকে মর্যাদা দিচ্ছে, তাহলে বুয়েট কেন নয়? এ প্রসঙ্গে উপাচার্য বলেন, আসলে আমি মাত্র এসেছি। অবশ্যই বঙ্গবন্ধুর ছবি টাঙানো হবে, মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্যও নির্মাণের উদ্যোগও নেব। এদিকে নতুন উপাচার্যের উদ্যোগে স্বস্তি প্রকাশ করছেন প্রগতিশীল শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। তাকে অভিনন্দন জানিয়ে বুয়েট বঙ্গবন্ধু পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ও পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মোঃ মিজানুর রহমান বলছিলেন, স্যার (উপাচার্য) দায়িত্ব গ্রহণের দিন আমরা বঙ্গবন্ধু পরিষদের নেতৃবৃন্দ দেখা করে জানাই উপাচার্য ও ডিএসডব্লিউ অফিস ছাড়া বাংলাদেশের সংবিধানের ৪(ক) ধারা অনুযায়ী জাতির জনকের ছবি টাঙানো হয় না। তখনই উপাচার্য মহোদয় বিষয়টিতে ইতিবাচক সাড়া দেন। বলেন, সেটা হলে আমি ব্যবস্থা নেব। দ্রুত ছবি টাঙানোর উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে বলে আমরা জেনেছি। মহান মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্যও শীঘ্রই নির্মাণ হবে বলে আশা প্রকাশ করেন অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান। এদিকে মুক্তিযুদ্ধ ও জাতির জনককে অবহেলার প্রেক্ষাপট খুঁজতে গিয়ে জানা গেছে, গত বছর জাতির জনকের শাহাদাতবার্ষিকীতে নানা আয়োজনে জাতি শোক দিবস পালন করলেও বরাবরের মতো নির্লিপ্ত ছিল বুয়েট কর্তৃপক্ষ। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আব্দুল মান্নান বুয়েট বঙ্গবন্ধু পরিষদের আলোচনা সভায় এসে তাই কর্তৃপক্ষের আচরণে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলেন। হতাশা ও ক্ষোভের সঙ্গে বলেছিলেন, ‘জাতির জনককে নিয়ে কথা বলতে যদি কারও আপত্তি থাকে, মুক্তিযুদ্ধকে যদি বিশ্বাস না হয়, তাদের জন্য বাংলাদেশ নয়, পাকিস্তান।’ অভিযোগ আছে, বুয়েট শিক্ষক সমিতির বিশেষত কর্তৃপক্ষের জামায়ত-শিবিরপ্রীতি এবং শিক্ষকদের মাঝে জামায়াতী মানসিকতার প্রভাবের কারণে অধিকাংশ সময় জাতির জনকের শাহাদাতবার্ষিকীতে কোন আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় না। কর্তৃপক্ষের কেউ কেউ চাইলেও বিশেষ এ গোষ্ঠী নাখোশ হবে এ ভয়ে দিনটিকে এড়িয়েই যেতে চান। এ রেওয়াজ বহুকাল ধরে চলছে। এবার নতুন উপাচার্য সেক্ষেত্রে অনেকটাই ব্যতিক্রম। গত বছর ইউজিসি চেয়ারম্যানের ক্ষোভের পর বুয়েটের তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক খালেদা একরাম অবশ্য বলার চেষ্টা করেন, বুয়েট কর্তৃপক্ষ নাকি বঙ্গবন্ধুকে হৃদয়ে ধারণ করে। বাহ্যিক অনুষ্ঠানে না হলেও শিক্ষকরা বঙ্গবন্ধুকে হৃদয়ে ধারণ করেন। বুয়েটে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে সংগঠন করতে গিয়ে প্রগতিশীলরা প্রতিক্রিয়াশীলদের বাধার মুখে পড়েছেন এমন ঘটনাও পুরনো নয়। গত বছরই ‘বঙ্গবন্ধু শিক্ষা ও গবেষণা পরিষদ’ নামে সংগঠন করতে চাইলে বাধার কারণে প্রগতিশীল শিক্ষক ও গবেষকরা আদর্শ, উদ্দেশ্য ঠিক রেখে ‘বুয়েট শিক্ষা ও গবেষণা পরিষদ’ গঠন করেন। তবে তার পরেও বাধার মুখে পড়েছেন তারা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধীরা সংগঠনের সদস্য হতে পারবে না- মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে এমন সব বক্তব্য থাকায় উল্টো প্রগতিশীলরাই চাপের মুখে পড়েছিলেন। তখনই প্রশ্ন ওঠে, বুয়েটে কি তাহলে বঙ্গবন্ধু নিষিদ্ধ? নিষিদ্ধ কি প্রগতিশীলদের যে কোন সংগঠন? বুয়েটে জামায়াত-শিবির ও নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন হিযবুত তাহরীরের আস্তানা নিয়ে বিভিন্ন সময় নানা তথ্য প্রকাশ হয়েছে। ট্রাইব্যুনালে দ-প্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষায় হরতালে নাশকতা চালাতে গিয়ে আটকও হয়েছেন বুয়েটের একাধিক ছাত্র। কয়েক শিক্ষকের সঙ্গে শিবির ও হিযবুত তাহরীরের সদস্যদের চাঁদা দেয়া ও ই-মেল, ফেসবুকে যোগাযোগের প্রমাণ পাওয়া গেছে। বুয়েটেই উগ্রবাদীরা হত্যা করেছে গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী মেধাবী ছাত্র দ্বীপকে। বুয়েটের আরেক প্রগতিশীল সংগঠক তন্ময় আহমেদকেও হত্যার চেষ্টা করা হয়। এ প্রতিষ্ঠানেরই উগ্রপন্থী শিক্ষক নেতা হাফিজুর রহমান রানা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফেসবুকে হত্যার হুমকি দিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রীকে হত্যার হুমকি দিয়ে হাফিজুর রহমান রানা স্ট্যাটাসে লিখেছিলেন, ‘হায়েনা ওই হায়েনা তুই দেশকে খেয়েছিস, এখন তুই বুয়েটকে খাবি... পারবি না... আমরা বুয়েটের শিক্ষকরা ও সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা হচ্ছি শিকারি। প্রথমে তোর মাথাতে গুলি করব, তারপর তোর পেটে। তারপর তোর মাথা কেটে বুয়েটের গেটের সামনে টানিয়ে রাখব। যাতে আর কোন হায়েনার আক্রমণে বুয়েট আক্রান্ত না হয়।’ এখানেই শেষ নয়, সরকারের বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থার তদন্ত প্রতিবেদনেই বেরিয়ে আসে, প্রতিষ্ঠানটির মাত্র ২২ ভাগ শিক্ষক বর্তমান সরকার ও প্রগতিশীল মতাদর্শের অনুসারী। ৭০ ভাগ শিক্ষকই বিএনপি-জামায়াত ও হিযবুত তাহরীরের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। বাকি ৮ ভাগ শিক্ষক মোটামুুটি নিরপেক্ষ। শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা হতাশা প্রকাশ করে বলছিলেন, বুয়েট প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে জামায়াতীকরণের কারণেই বুয়েটের এ দুরবস্থা। এর ফলে নতুন প্রজন্ম বঙ্গবন্ধুর জীবনচরিত এবং জীবনাদর্শ সম্বন্ধে সম্পূর্ণ ‘ব্ল্যাকআউটে’ থেকে যাচ্ছে। বুয়েটের জামায়াত-শিবির তোষণ এবং লালন-পালনের আখড়া হিসেবে পরিচিত এটা তাদের ব্যথিত করে। এ বিষয়ে সরকারের সকল সংস্থার বিশেষ নজর দেয়া প্রয়োজন।
×