ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

দশ বছরে কমেছে ২৯ শতাংশ

বাল্যবিয়ের হার শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে নানা পদক্ষেপ

প্রকাশিত: ০৫:৫৬, ১৪ আগস্ট ২০১৬

বাল্যবিয়ের হার শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে নানা পদক্ষেপ

সমুদ্র হক ॥ বাল্যবিয়ের হার গত দশ বছর আগের তুলনায় কমেছে। আগামী ২০৪১ সালের মধ্যে দেশকে বাল্যবিয়ে মুক্ত করার লক্ষ্য নিয়ে বিশেষ পরিকল্পনাসহ নানান কৌশল নেয়া হচ্ছে। ২০০৬ সালে দেশে বালিকাদের বধূ হওয়ার হার ছিল ৭৪ শতাংশ। ২০১৩ সালে তা নেমে আসে ৫২ শতাংশে। সরকারী ও বেসরকারী নানা পদক্ষেপ এবং জনসচেতনতা বাড়ানোয় এ হার বর্তমানে প্রায় ৪৫ শতাংশে নেমে এসেছে। বাল্যবিয়ে শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে বেশকিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। সূত্র জানায়, সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিবের সভাপতিত্বে এক বৈঠকে বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে বেশকিছু সিদ্ধান্ত নিয়ে তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে- বিয়ে নিবন্ধনের সময় কাবিননামায় বর-কনের ছবি সংযোজন করতে হবে। এর সঙ্গে বিয়ের তারিখ, বয়সের ক্ষেত্রে দিন মাস বছর উল্লেখ, জন্ম নিবন্ধন সনদ ও জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর উল্লেখ করে ফটোকপি সংযোজন করতে হবে। যিনি বিয়ে নিবন্ধন করবেন এবং যে মাওলানা বিয়ে পড়াবেন, তাদের নাম-ঠিকানা লিপিবদ্ধ করতে হবে। বিয়ে নিবন্ধকের উপস্থিতিতে বিয়ে পড়ানো নিশ্চিত করতে হবে। এ আইনী পদক্ষেপের সঙ্গে চলমান প্রক্রিয়ায় জনসচেতনতামূলক কর্মসূচী অব্যাহত থাকবে। মুসলিম বিবাহ ও তালাক নিবন্ধন আইন-১৯৭৪ কে মোবাইল কোর্টে তফসিলভুক্ত করাসহ বাল্যবিয়ে রোধে প্রায় ৪০ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে বাল্যবিয়ের মূল কারণ চিহ্নিত করে কিভাবে তার প্রতিকার করা যায় সে পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। এক্ষেত্রে মাঠপর্যায়ের যে চিত্র আগে ছিল, তা পাল্টে যেতে শুরু করেছে। নিকট অতীতে বাল্যবিয়ের বড় একটি কারণ ছিল অশিক্ষা ও দারিদ্র্য। বর্তমানে কৃষির অধিক উৎপাদনে গ্রামীণ দারিদ্র্য অনেকটাই দূর হয়েছে। প্রাথমিক স্কুলে ঝরেপড়ার হার প্রায় শূন্যের কোটায়। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে নারী শিক্ষার্থীর হারও বেড়েছে। এ অবস্থায় বাল্যবিয়ে রোধে সবচেয়ে বড় কাজ জনসচেতনতা বাড়ানোর পাশাপাশি বিবাহ নিবন্ধক, মসজিদের ইমাম মুয়াজ্জিন, মাঠপর্যায়ের জনপ্রতিনিধিদের প্রশিক্ষণের আওতায় আনা। বিষয়টি সমর্থন করে বগুড়া জেলা কাজী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোনায়েম বলেন, বাল্যবিয়ে নিবন্ধনের সঙ্গে জড়িত সকলকে বিশেষ প্রশিক্ষণের আওতায় আনা দরকার। তাদের প্রশিক্ষণ দিলে জনসচেতনতা বাড়ানোসহ বিয়ে নিবন্ধনের সময়ই বাল্যবিয়ে মনে হলে তা রোধ করতে বড় ভূমিকা পালন করতে পারবেন। এ বিষয়ে সূত্র জানায়, ইতোমধ্যে সিদ্ধান্ত হয়েছে বিবাহ নিবন্ধক মসজিদের ইমাম মুয়াজ্জিনসহ সংশ্লিষ্টদের প্রশিক্ষণের আওতায় আনা হচ্ছে। প্রতিটি বিবাহ চলতি মুসলিম বিবাহ ও তালাক নিবন্ধন আইনের আওতায় আনার কার্যকর কৌশল তৈরি করে বিবাহ নিবন্ধকদের (যারা কাজী হিসেবে অধিক পরিচিত) বিশেষ দায়িত্ব দেয়া হবে। যারা বিয়ে পড়ান তাদের সঙ্গে বিবাহ নিবন্ধকের সমন্বয় করা হবে। ইউনিয়ন পরিষদ পৌর এলাকা সিটি কর্পোরেশন এলাকায় যারা বিয়ে পড়ান তাদের জবাবদিহিতার আওতায় এনে প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। যারা বিবাহ নিবন্ধকের সহকারী তাদেরও দায়িত্ব দিয়ে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা তৈরির কাজও চলছে। বাল্যবিয়ে রোধে জেলা ও উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তাদের মামলা দায়েরের ক্ষমতা দেয়া যায় কিনা, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। একই সঙ্গে জেলা শিশু একাডেমির সংগঠকদের বাল্যবিয়ে রোধে দায়িত্ব দেয়ার বিষয়েও ভাবনা-চিন্তা করা হচ্ছে। যে সকল পরিবার সরকারী বিভিন্ন সুবিধা ও সহযোগিতা পায়, সেই পরিবারের সদস্য যেন বাল্যবিয়ে মুক্ত থাকে, তা নিবিড় পর্যবেক্ষণ করে সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে। প্রশাসনের তালিকাভুক্ত ইমাম মুয়াজ্জিন এবং যারা বিয়ে পড়ান জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে তাদের নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করে বিশেষ প্রশিক্ষণের আওতায় আনা হবে। প্রশাসনে তাদের তালিকা হালনাগাদ করা থাকবে। জনসচেতনতার কাজে ইমাম মুয়াজ্জিনদের অন্তর্ভুক্ত করে জুমার নামাজের খুতবার আগে ইমাম বাল্যবিবাহ রোধ এবং এর কুফল সম্পর্কে বয়ান করবেন। ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাল্যবিবাহের কুফল, বাল্যবিয়ে রোধে করণীয় বিষয়ে পয়েন্ট দিয়ে আউট লাইন তৈরি করে দেবে। ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা ও সিটি কর্পোরেশন থেকে ভুয়া জন্ম নিবন্ধন সনদ যাতে না দেয়া হয়, সে বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হবে। তারপরও এ ধরনের সনদ দেয়া হলে প্রমাণসাপেক্ষে ব্যবস্থা নেয়া হবে। মাধ্যমিক পর্যায়ে মেয়ে শিক্ষার্থীর উপবৃত্তি বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। অসহায় ও দরিদ্র শিশু বাল্যবিয়ের শিকার হতে পারেÑ এমন মনে হওয়ার সঙ্গেই এসব শিশুর সুরক্ষা প্রদানে সমাজসেবা অধিদফতরকে দায়িত্ব দেয়া হতে পারে। একই সঙ্গে এমন শিশুদের অভিভাবককে আয়বর্ধক কর্মসূচীর আওতার আনার ব্যবস্থা করা হবে। এতসব পদক্ষেপ নেয়ার পাশাপাশি বাংলাদেশ টেলিভিশনে বাল্যবিয়ের কুফল সম্পর্কে প্রচার এবং বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে তথ্যচিত্র প্রচার এবং সরকারের তথ্য অধিদফতর এসব চিত্র মাঠপর্যায়ে প্রচারের ব্যবস্থা করবে। সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে সচেতনতা বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
×