ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সেরা উপহারটা নিজেই নিজেকে দিলেন ত্রিপুরার মেয়ে

প্রকাশিত: ০৬:২৯, ১০ আগস্ট ২০১৬

সেরা উপহারটা নিজেই নিজেকে দিলেন ত্রিপুরার মেয়ে

সাদা-সবুজ চকচকে ড্রেসে রিও এরিনায় দৌড়াচ্ছেন, লাফ-ঝাঁপ দিচ্ছেন ত্রিপুরার বাঙালী মেয়েটা। বাংলাদেশে তখন ভোর সাড়ে পাঁচটা। বাইশ বছরের দীপা কর্মকারের জন্য ভারতীয় জিমন্যাস্টের নতুন ইতিহাস এবারের রিও অলিম্পিকে। সবচেয়ে বড় কথা বাঙালীর খেলাধুুলার ইতিহাসেও সবচেয়ে উঁচু স্থানটা এনে দিয়েছেন দীপা। প্রথম ভারতীয় জিমন্যাস্ট হিসেবে ফাইনালে ওঠলেন তিনি নজর কাড়া নৈপুণ্য আর অদম্য সাহস নিয়ে। ৯ আগস্ট ছিল দীপার জন্মদিন। ভারত থেকে ১৪ হাজার কিলোমিটার দূরে দীপা, রিও অলিম্পিক গেমসে বাঙালীর গর্ব করার মতো ইতিহাস তার রেকর্ড বুকে। দীপা বাড়িতে নেই তাতে কী? চার ভাই-বোনের মধ্যে দ্বিতীয় দীপার জন্মদিন পালিত হয়েছে মহা দুমদামে। আর ভারতীয় সেলিব্রেটিদের অভিনন্দনের ফুলে ফুলে শোভিত হয়ে গিয়েছিল গোটা বাড়ি। গেমস ভিলেজেও মঙ্গলবার মহা উৎসবে দীপার জন্মদিন পালন করেছেন ভারতীয়রা। এখন কেবলই অপেক্ষার পালা। আগামী রবিবার ফাইনাল। পদক জিততে মনের মধ্যে প্রবল আত্মবিশ্বাস নিয়ে অপেক্ষা করছেন তিনি, তথা গোটা ভারতবাসী। ভারতীয় হিসেবে নয়, একজন বাঙালী হিসেবে আশীর্বাদ রইল বাংলাদেশের মানুষেরও। গেমস ভিলেজের এ্যাপার্টমেন্টে দীপার সঙ্গে সাক্ষাত করতে অনুমতি, পরিচয় আর যে আনুষ্ঠাকিতা দরকার সবকিছু সম্পন্ন করে কাছে পেলাম বাঙালীর গর্ব দীপা কর্মকারের। মুখে উজ্জ্বল হাসি। এ উজ্জ্বলতা যে এখন তার মুখম-লেই মানায় দক্ষিণ এশিয়ার গৌরব হিসেবে। রিসিপসন থেকে সময় বেঁধে দেয়া হয়েছিল মাত্র দশ মিনিট। মূল্যবান এ সময়ের মধ্যে কথা বলতে হলো খুব দ্রুতই। আমি তো এখন দোয়াপ্রার্থী। সবার প্রার্থনা পৌঁছে দিতে পারে অভিষ্ট, কাক্সিক্ষত পদকের মঞ্চে। আর আমার চেষ্টা তো থাকবেই। দীপা নিজেই শুরু করলেন কথাগুলো বলে। প্রত্যশা, আত্মবিশ্বাস ছিল ভাল করার। কিন্তু এতদূর উঠে আসতে পারব ভাবিনি, বিশ্বের ৯৩ প্রতিযোগীর সঙ্গে টক্কর দিয়ে ফাইনালে জায়গা করে নিতে পারায় আমি খুবই আনন্দিত। দেশ থেকে বাবা-মা, ভাই-বোন ছাড়াও ফোনে প্রশংসা করছেন অনেকেই। এটা আমার জন্য বাড়তি অনুপ্রেরণা। প্রশ্নের উত্তরে বললেন দীপা কর্মকার। এখন পদক ছাড়া অন্য কিছু ভাবছি না। মানুষের প্রশংসার প্রতিদান দিতে চাই। পদক জিতে ক্যারিয়ার আরও আলোকিত করাই আমার লক্ষ্য। ফাইনালে পৌঁছার পর সবচেয়ে ভাল লেগেছে বুকে জড়িয়ে সিমোন বিলেসের অভিনন্দন। আমেরিকার বিশ্ব খ্যাত, জিমন্যাস্টিক্সের রেকর্ডকন্য সিমোন বুকে জড়িয়ে ধরে বলেছেন, শুভেচ্ছ তোমায়, আমার বিশ্বাস তুমি পদক জিতবেই। বাবা সরকারী চাকরিজীবী আর মা পুরোদস্তুর গৃহিণী। সচ্ছল পরিবারের সন্তান দীপা স্কুল পড়ুয়া অবস্থায় জিমন্যাস্টিক্স চর্চা শুরু করেন। ভারতের সেরা মহিলা জিমন্যাস্ট বর্তমানে তিনি। এই সেরার আসনটা নিয়ে যেতে চান এভারেস্টে, রিও অলিম্পিকের পদক গলায় ঝুলিয়ে। এত প্রতিদ্বন্দ্বীর ভিড় ঠেলে ভল্ট ইভেন্টে ফাইনালে যাওয়ার স্বপ্ন ছিল। প্রথমবার অলিম্পিকে এসে সেটা করতে পেরে আমি নিজেই অবিভূত। ফাইনালের আগে বাহবা পাচ্ছি সবার। এবার পদক জিতে সবার মাঝে আনন্দের সৌরভ ছড়িয়ে দিতে চাই। দীপা জানালেন, বছরের বেশিরভাগ সময়ই প্রশিক্ষণে থাকেন। তবে রিও গেমস সামনে রেখে ছয় মাস আগে স্থানীয় ও বিদেশী প্রশিক্ষকের অধিনে ছিলেন। সেটা ভারতীয় অলিম্পিক এ্যাসোসিয়েশনের উদ্যোগে। বলতে পারেন ভাল প্রস্তুতি নিয়েই রিও এসেছি। তারই ফসল ফাইনালে জায়গা করে নেয়া। এখন অবশিষ্ট বলতে পদক। এই অর্জনটা গলায় ঝুলাতে পারলে ভাববো আমি সফল, কাজে দিয়েছে পরিশ্রম। প্রশ্নের উত্তরে দীপা বললেন, বাঙালী হিসেবে দেখছি না। একজন ভারতীয়ই মনে করছি নিজেকে। দেশপ্রেম সবার আগে। অলিম্পিক শুরুর আগে জানানো হয়েছিল টিম ইউএস থেকে কোন জিমন্যাস্ট প্রোদুনোভা ভল্টের লড়াইয়ে নাও নামতে পারেন। আর কেন এই চিন্তাধারা? জিমন্যাস্ট জগতের সবচেয়ে কঠিন আর বিপজ্জনক বাঁক রয়েছে যে ভল্টে। শূন্যে ডাবল সমারসল্ট দিয়ে ল্যান্ড করতে হয় এতে। দশবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন সিসোন বিলেস স্বয়ং যা করার কথা দু’বার ভেবেছিলেন। পরবর্তীতে প্রতিদ্বন্দ্বিতাও করেন। তিনি বলেছিলেন, প্রোদুনোভা ভল্ট করতে গিয়ে যে কোন মুহূর্তে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। বিশ্বের মাত্র তিন নম্বর জিমন্যাস্ট হিসেবে কমনওয়েলথ গেমসে এই ভল্টের জোরেই রিওর টিকেট পেয়েছিলেন দীপা। ব্যক্তিগত ভল্ট ইভেন্টের ফাইনালে যাওয়ার পথে মোট দু’বার প্রোনুদোভা ভল্ট দিয়েছিলেন দীপা। আর দু’বারেই ক্লিন ল্যান্ডিং করলেন ওই ভল্টে। তাতেই ঝুলিতে জমা পড়ল ১৪.৮৫০ পয়েন্ট। এক সময় ছয় নম্বরে থাকলেও শেষমেশ আটে চলে যান তিনি। ১৬.০৫০ পয়েন্ট নিয়ে শীর্ষে থাকলেন যুক্তরষ্ট্রের সিমোন বিলেস। ফাইনালে ওঠার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে দীপা বললেন, ট্রেনিংয়ের সময় ভালভাবে ল্যান্ডিং করলেও অলিম্পিকে সেদিন প্রোদুনোভা ভল্টটা ঠিকঠাক হয়নি। ল্যান্ডিংয়ের সময় আমার কোমড় ছুঁয়ে গিয়েছিল ম্যাটে। সত্যিই মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল। তবে, কথায় আছেÑ ‘শেষ ভাল যার সব ভাল তার’ দীপা বলতে পারলেন ফাইনালে ওঠাটা এক অসাধারণ কৃতিত্ব। জিমন্যাস্টিক্সে আমেরিকা, কানাডা, রাশিয়া ও ব্রিটেনের পরিণত যোদ্ধাদের সঙ্গে লড়াই করে কোয়ালিফাই করতে পারেন কিনা এ নিয়েই একটা সন্দেহ কাজ করছিল ভারতীয় দলে। কিন্তু দীপার মনোবল ছিল অটুট, একটা কিছু করে দেখাতেই হবে। মন থেকে ভয়ভীতি দূর করে শুরু করেছিলেন কসরত। এখন এমন পারফর্মেন্সের পর সন্তুষ্টি ঘিরে রয়েছে বলেই মনে হলো তাকে। দীপা কর্মকারকে। আলাপচারিতায় দীপার শেষ অভিব্যক্তি ছিল, জীবনের সেরা পয়েন্ট, বেস্ট পারফর্ম করেছি। এখন পদকের লড়াইয়ে এই অগ্রযাত্রা, নৈপুণ্য ধরে রাখতে চাই। আসলে এই অনুভূতির কোন তুলনা হয় না। দীপা কর্মকারের দু’চোখে যে এখন অলিম্পিকস জয়ের স্বপ্ন। আর জন্মদিনে জীবনের সেরা উপহারটা নিজেই নিজেকে দিয়েছেন ত্রিপুরার মেয়ে দীপা।
×