ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

গুলশান হামলার অনেক তথ্য বেরিয়ে এসেছে প্রত্যক্ষদর্শীর জবানীতে

প্রকাশিত: ০৫:২৯, ১০ আগস্ট ২০১৬

গুলশান হামলার অনেক তথ্য বেরিয়ে এসেছে প্রত্যক্ষদর্শীর জবানীতে

শংকর কুমার দে/গাফফার খান চৌধুরী ॥ রাজধানীর অভিজাত ও কূটনৈতিকপাড়া গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তুরাঁ ও বেকারিতে জঙ্গী হামলার তদন্ত প্রক্রিয়া অনেকদূর এগিয়েছে। অনেকটা শেষই বলা চলে। বর্তমানে তথ্যের দালিলিক প্রমাণাদি সংগ্রহের কাজ চলছে। এদিকে আরও অন্তত পাঁচ প্রত্যক্ষদর্শী আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী দিতে যাচ্ছেন। জবানবন্দী দিতে যাওয়া এ পাঁচজনও খুব কাছ থেকে হলি আর্টিজানের সেই দিনের ভয়াবহ চিত্র দেখেছেন। এ নিয়ে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দীদাতার সংখ্যা পনেরো জন হতে যাচ্ছে। জবানবন্দীদাতাদের মধ্যে নরসিংদীর রুমা ছাড়া অন্যরা ঘটনাস্থল থেকে নানাভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক উদ্ধার হয়েছেন। ইতোপূর্বে জবানবন্দী দেয়াদের তথ্যের সূত্র ধরেই ঘটনার মাসখানেক পরে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক হাসনাত রেজা করিম ও তাহমিদ হাসিব খানকে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার দেখিয়ে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। এদিকে নিহত এক সন্দেহভাজনসহ ছয় জঙ্গীর মধ্যে শুধু একজনের লাশ নেয়ার আগ্রহ দেখিছেন তার আত্মীয়। বাকি পাঁচজনের পরিবার লাশ নিতে ন্যূনতম যোগাযোগ পর্যন্ত করেনি। গত ১ জুলাই গুলশানে স্প্যানিশ রেস্তুরাঁ হিসেবে পরিচিত হলি আর্টিজান রেস্তুরাঁ ও বেকারিতে হামলা করে জঙ্গীরা। জঙ্গীরা রেস্তুরাঁয় থাকা সবাইকে ভারি আগ্নেয়াস্ত্রের মুখে জিম্মি করে। জিম্মিদের উদ্ধার করতে গিয়ে জঙ্গীদের গ্রেনেড ও গুলিতে নিহত হন বনানী থানার ওসি সালাহউদ্দিন আহমেদ খান ও ডিবির সহকারী পুলিশ কমিশনার রবিউল হক। এরপর জঙ্গীরা এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাতে ও গুলি করে ১৭ বিদেশীসহ ২০ জনকে হত্যা করে। পরদিন সকালে সেনাবাহিনীর কমান্ডোরা অপারেশন থান্ডারবোল্টের মাধ্যমে জিম্মি অন্যদের উদ্ধার করে। অভিযানে নিহত হয় পাঁচ জঙ্গী নিবরাস ইসলাম, খায়রুল ইসলাম পায়েল, শফিকুল ইসলাম উজ্জ্ব¡ল, মীর সামিহ মোবাশ্বের ও রোহান ইবনে ইমতিয়াজ। একই অভিযানে নিহত শরীয়তপুরের সাইফুল ইসলাম চৌকিদারও জঙ্গী ছিল বলে তদন্তকারীদের ধারণা। পরবর্তীতে গত ৮ জুলাই সন্দেহভাজন জাকির হোসেন শাওনও চিকিৎসাধীন মারা যায়। পরবর্তীতে সেনাবাহিনীর কমান্ডোরা সেখানে তল্লাশি অভিযানে শিল্পপতি লতিফুর রহমানের নাতি ফারাজ আয়াজ হোসেন, তার বন্ধু ল্যাভেন্ডার সুপারশপের মালিক এহসানুল কবিরের মেয়ে অবিন্তা কবির ও ভারতীয় নাগরিক তারশী জৈনসহ ২০ জনের লাশ উদ্ধার হয়। তদন্তকারী সংস্থা সূত্রে জানা গেছে, হলি আর্টিজান থেকে সবমিলিয়ে ৩২ জনকে উদ্ধার করা হয়। উদ্ধারকৃতদের মধ্যে জাপান, আর্জেন্টিনা, ইতালি, শ্রীলঙ্কা ও ভারতের নাগরিকও রয়েছেন। পরবর্তীতে উদ্ধারকৃত ৩২ জনেরই ১৬১ ধারায় জবানবন্দী গ্রহণ করা হয়। এরমধ্যে উদ্ধারকৃত বিদেশীদের মধ্যে ভারতীয় নাগরিক সত্য প্রকাশ আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী দেন। প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে দেয়া সেই জবানবন্দীতে উঠে এসেছে অনেক কিছুই। এছাড়া উদ্ধারকৃতদের মধ্যে আরও আটজন সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী দেন। নয় জনের জবানবন্দীতে উঠে এসেছে সেদিনের জঙ্গী হামলার লোমহর্ষক বর্ণনা। জবানবন্দীতে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক হাসনাত রেজা করিম ও তাহমিদের বিষয়টি নানাভাবেই এসেছে। জবানবন্দীতে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই মাসখানেক পরে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক হাসনাত করিম ও তাহমিদকে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার করা হয়। তাদের পাঁচ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। জিজ্ঞাসাবাদে এখন পর্যন্ত এ দু’জন গুলশানের ঘটনায় নির্দোষ হিসেবে প্রমাণিত হয়নি। ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী দেয়া প্রত্যক্ষদর্শীদের ছাড়াও ২১ জন ১৬১ ধারায় পুলিশের কাছে জবানবন্দী দিয়েছেন। সেসব জবানবন্দীতেও উঠে এসেছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। এ ব্যাপারে ডিএমপির মিডিয়া বিভাগের উপকমিশনার মাসুদুর রহমান জানান, তাহমিদ ও হাসনাত করিমের দেয়া তথ্য এবং তদন্তে পাওয়া তথ্য যাচাইবাছাই করে দেখা হচ্ছে। তবে এখন পর্যন্ত হাসনাত করিম নির্দোষ বা দোষী কোনটিই প্রমাণিত হয়নি। বিষয়টি নিয়ে গভীর অনুসন্ধান চলছে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, ভারতীয় নাগরিকসহ নয় জনের জবানবন্দী ছাড়াও নরসিংদী থেকে আটককৃত রুমাও পরবর্তীতে ১৬১ ধারায় জবানবন্দী দেন। পরবর্তীতে তিনি আদালতে গিয়ে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী দিয়েছেন। তার জবানবন্দীতেও নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই শিক্ষক ও তাহমিদের প্রসঙ্গ এসেছে। এছাড়া হলি আর্টিজানের ঘটনায় রেস্তুরাঁর ক্যাশিয়ার আল আমিন চৌধুরী ওরফে সেজান, কর্মকর্তা মিরাজ হোসেন, রাসেল মাসুদ ও মেট্রোরেল প্রকল্পের গাড়িচালক রাশেদ সর্দারও আদালতে জবানবন্দী দিয়েছেন। জবানবন্দীদাতাদের মধ্যে ভারতীয় নাগরিক সত্য প্রকাশ ও রেস্তুরাঁটির পাচক শাহীনের জবানবন্দীতে চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে। ১৬৪ ধারায় দেয়া জবানবন্দীতে পুরো ঘটনার বিবরণ রয়েছে। সূত্র বলছে, অনেকটা কাস্টমার সেজে রেস্তরাঁয় ঢুকে জঙ্গীরা। তারা ছিল কেতাদুরস্ত। পেছনে ভারি ব্যাগ। কাস্টমার ভেবে তাদের সম্মানের সঙ্গে ভেতরে ঢুকতে দেন গেটের দায়িত্বরতরা। রেস্তুরাঁয় ঢুকেই জঙ্গীরা ভারি আগ্নেয়াস্ত্র বের করে সবাইকে জিম্মি করে। এরপর আলাদা করে দেশী-বিদেশীদের। বিদেশীদের এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাতের পর অনেককেই জবাই করে। অনেককে গুলিও করে। পাঁচ জঙ্গীর কাছে পাঁচটি একে টুটু বোরের রাইফেল ছাড়াও কমপক্ষে পাঁচটি পিস্তল ছিল। অনেকের কাছে অতিরিক্ত পিস্তল ছিল বলে ধারণা করা হয়। পরবর্তীতে কমান্ডো অপারেশনের কারণে সেসব ছোট অস্ত্রের হয়ত আর হদিস মেলেনি। অনেক আগ্নেয়াস্ত্র আবর্জনা লেকের পানিতে পড়ে যাওয়া বা ফেলে দেয়াও বিচিত্র নয়। এক প্রত্যক্ষদর্শী জনকণ্ঠকে জানিয়েছেন, তাকেসহ নয়জনকে দোতলার একটি বাথরুমে আটকে রেখেছিল জঙ্গীরা। বাথরুমের ভেতর থেকেই তিনি মোবাইল ফোনে প্রথমে কথাবার্তা বলে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছিলেন। পরবর্তীতে মেসেজের মাধ্যমে যোগাযোগ করেছেন। তিনিও জবানবন্দী দিয়েছেন। পরবর্তীতে কমান্ডোরা তাদের বাথরুমের দরজা ভেঙ্গে উদ্ধার করে। এ নয়জনসহ সেনাবাহিনী ১৩ জনকে জীবিত উদ্ধার করে। সূত্র বলছে, জঙ্গীরা অভিযানকালে কিচেনে গিয়ে এক ব্রিটিশ নাগরিকের খোঁজ করছিল। তবে সেই ব্রিটিশ নাগরিক সত্যি সত্যিই ব্রিটিশ বংশোদ্ভূত ব্রিটিশের নাগরিক, নাকি বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক, তা নিশ্চিত নয়। পরবর্তীতে জঙ্গীদের সঙ্গে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হাসনাত রেজা করিমের যোগাযোগ হয়। হাসনাত করিম বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত ব্র্রিটিশ নাগরিক। ধারণা করা হচ্ছে, জঙ্গীরা ব্রিটিশ নাগরিক হাসনাত করিমকে সেই সময় কিচেনে গিয়ে খোঁজ করে থাকতে পারেন। তবে কোন প্রেক্ষিতে খোঁজ করেছেন, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। জঙ্গীরা আগাম জেনেই, নাকি পূর্ব পরিচয়ের সূত্রধরে ব্রিটিশ নাগরিক হাসনাত করিমের খোঁজ করছিলেন সে বিষয়টি জানার চেষ্টা চলছে। প্রসঙ্গত, কমান্ডো অভিযানে নিহত নিবরাস নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক হাসনাত করিমের ছাত্র ছিল। জঙ্গীদের রোজা রাখার জন্য সেহরির যে রান্না হয়েছিল, তাও খেয়েছিলেন হাসনাত করিম ও তাহমিদ। তদন্তকারী সূত্রগুলো বলছে, জঙ্গীদের একমাস আগে বাড়ি ভাড়া নেয়া থেকে শুরু করে অভিযান পর্যন্ত নানা দিক থেকেই হাসনাত করিমকে নিয়ে নানা প্রশ্নের জন্ম হয়েছে। হাসনাত করিমের যোগাযোগের প্রেক্ষিতেই নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষক তার বাড়িতে জঙ্গীদের থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন বলে নাম প্রকাশ পেয়েছে। এছাড়া হাসনাত করিমের মোবাইল ফোন ব্যবহার বড় প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। আর তাহমিদের হাতে থাকা পিস্তলটিও জন্ম দিয়েছে অনেক প্রশ্নের। তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, নিহত জঙ্গীদের লাশ সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল মর্গে রয়েছে। তাদের লাশ নিতে নিহতদের পরিবারের তরফ থেকে কেউ তাদের সঙ্গে ন্যূনতম যোগাযোগ পর্যন্ত করেননি। শুধু সন্দেহভাজন জঙ্গী সাইফুল ইসলাম চৌকিদারের লাশ নিতে তার এক আত্মীয় যোগাযোগ করেছেন। তদন্তের কারণে লাশ হস্তান্তর করতে দেরি হবে। লাশ থেকে সংগৃহীত প্রয়োজনীয় আলামতের পরীক্ষা-নিরীক্ষার রিপোর্ট হাতে পাওয়ার পর এ ব্যাপারে প্রাথমিক সিদ্ধান্ত হবে। কারণ, তদন্তের স্বার্থে নতুন করে নিহতদের কারও দেহ থেকে আরও আলামত সংগ্রহ করার প্রয়োজন হতে পারে। এজন্য তদন্ত চূড়ান্তভাবে শেষ না হওয়া পর্যন্ত লাশ হস্তান্তরের দিনক্ষণ সুনির্দিষ্ট করে বলা যাচ্ছে না। অস্ত্রগোলাবারুদ ও জঙ্গী হামলায় ব্যয় হওয়া অর্থের অধিকাংশই দেশ ও বিদেশ থেকে এসেছে বলে তদন্তে ধরা পড়েছে। প্রসঙ্গত, গত ২ জুলাই পুলিশ সদর দফতর গুলশান ও শোলাকিয়ায় জঙ্গী হামলা এবং বড় ধরনের নাশকতা চালাতে কল্যাণপুরে জঙ্গী আস্তানা স্থাপনের মাস্টারমাইন্ড হিসেবে সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত মেজর জিয়া ও বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত কানাডার নাগরিক তামিম আহমেদ চৌধুরীকে মোস্ট ওয়ান্টেড হিসেবে ঘোষণা করে। তাদের ধরিয়ে দিতে ২০ লাখ করে ৪০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেন পুলিশ মহাপরিদর্শক একেএম শহীদুল হক। তিনি বলেন, দুই মাস্টারমাইন্ডকে গ্রেফতার করা সম্ভব হলে গুলশান ও শোলাকিয়ার হামলাসহ অনেক ঘটনার রহস্য খুলে যাবে। ইতোমধ্যেই তাদের গ্রেফতারে বিমানবন্দরসহ সীমান্তে ছবিসহ বিশেষ বার্তা পাঠানা হয়েছে।
×